উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে সংবাদপত্রকে বিকল্প সংসদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সংসদে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়। সংবাদপত্রেও সরকারের কাজকর্মের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা হয়। উন্নত দেশগুলোতে এর জন্য সংবাদমাধ্যমকে নানাভাবে সহযোগিতা করা হয়। এর উল্টোটা হয় তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে। ক্ষমতাসীনরা বরাবর সেখানে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধেরই সুযোগ খুঁজতে থাকে। বাংলাদেশও যেন তার ব্যতিক্রম নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল ২০১৮ নামে একটি আইন পাস করার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এসেছে। অথচ এই আইনের ৩২ ধারাসহ অন্তত আটটি ধারা সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোসহ সংশ্লিষ্ট মহলগুলো প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছে। আইনটি আগেই মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। গত সোমবার সেই ধারাগুলো প্রায় অপরিবর্তিত রেখেই সংসদীয় কমিটি সংসদে তাদের প্রতিবেদন পেশ করেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই আইন বাস্তবায়িত হলে এ দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার আর কোনো সুযোগই থাকবে না।
সম্পাদক পরিষদ প্রস্তাবিত আইনের আটটি (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৩) ধারা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল ৩২ ধারা নিয়ে। সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে ‘ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি’ শব্দটি বাদ দিয়ে তার সঙ্গে ঔপনিবেশিক আমলের ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ সংযুক্ত করা হয়েছে। সেই মোতাবেক ৩২(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতাভুক্ত অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ আইনের ৩২(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা-১-এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ পাশ্চাত্যের ১০টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরাও ৩২ ধারাসহ এই আইনের চারটি ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি আইনের ৯টি ধারা সম্পর্কে তাদের আপত্তি জানিয়েছিল। সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে এসব আপত্তি বস্তুত কোনো গুরুত্বই পায়নি। সংবাদপত্র-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এরপর কোনো সাংবাদিকের পক্ষে সরকারি প্রতিষ্ঠানের খবর সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। সরকারি দপ্তরের প্রায় সব নথিই গোপনীয় এবং সেগুলোর কপি সংগ্রহ করা অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে। তাহলে কি এ দেশে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের কোনো প্রয়োজনই নেই এমন প্রশ্ন অনেকেরই।
আমরা আশা করি, আইনটি সংসদে পাস হওয়ার আগে সংবাদপত্র-সংশ্লিষ্টদের আপত্তিগুলো আবারও পর্যালোচনা করা হবে এবং এমন কোনো আইন পাস করা হবে না, যা সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করবে।