রোহিঙ্গা সমস্যা দ্রুত নিষ্পত্তি চাই

32

সামরিক শাসন যে শাসকদের স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনাকে বিকৃত করে তুলতে পারে এবং হিতাহিত জ্ঞানের ভান্ডারকে যে করতে পারে অস্বাভাবিক, তারই নিদর্শন হিসেবে মিয়ানমারকে উল্লেখ করা যেতে পারে। সামরিক শাসন ও শাসকের আচরণের ভয়াবহতা যে কি হতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পায় সে দেশের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীসহ সাধারণ জনগণ। সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত রোহিঙ্গারা। জান্তারা সেখানে গণহত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিকান্ডসহ সব ধরনের অপকর্ম চালিয়েছে। তাদের ঘরবাড়িই শুধু নয়, নিজ মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। সেদেশের জান্তা শাসকদের বৈষম্যমূলক, মানবতাবিরোধী অমানবিক, নির্মম বিকৃত আচরণের বহির্প্রকাশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা। নিজ দেশের সামরিক শাসক ও তাদের প্ররোচিত রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন দীর্ঘদিন আগেই রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে একপর্যায়ে সকল অধিকারই লুণ্ঠন করে। এটা শুধু একদিনে হয়নি। সেই সত্তর দশক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারের জান্তারা রোহিঙ্গাদের নির্মম নির্যাতন শেষে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ সেই থেকে তাদের আশ্রয় দিয়ে আসছে। সর্বশেষ গত বছরের আগস্ট থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল এখনও থামেনি। পুরনো-নতুন মিলিয়ে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ এক হাজার দুইশ’ জন। এরা টেকনাফ, উখিয়ার বিভিন্ন শিবিরে এমনকি বাইরেও অবস্থান করছে। শিবিরে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের নিয়ে বাংলাদেশও চরম সঙ্কট মোকাবেলা করছে। আসন্ন বর্ষায় পাহাড় ধস, বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। অথচ তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে নানা রকম চতুরতার আশ্রয় যে নেয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট। প্রত্যাবাসনের চুক্তি সইÑএর চার মাস পরও একজন রোহিঙ্গাও ফেরত যায়নি। বরং সদ্য রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনকারী মিয়ানমারের সফরকারী সমাজকল্যাণমন্ত্রী প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে যে শর্তারোপ করেছেন তা কতটা বাস্তবসম্মত এবং মর্যাদাপূর্ণ রোহিঙ্গাদের ভাষ্যেই পরিষ্কার। এই শর্ত কঠিন ও সমস্যা বাড়াবে। মন্ত্রী ব্যাখ্যা করেছেনÑ রাখাইনে ফিরে যাওয়ার পর মিয়ানমারের নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের সুযোগ পাবে। তবে তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নির্দেশিত আইন অনুযায়ী। কিন্তু যে রোহিঙ্গারা হাজার বছর ধরে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে বসবাস করে আসছে, তারা কেন আবার নতুন করে নাগরিকত্ব পরীক্ষা দেবে? সঙ্গত কারণেই রোহিঙ্গারা আপত্তি জানিয়েছেন। বংশ পরম্পরায় যারা সেদেশে বসবাস করে আসছে, তারা কেন স্বীকারোক্তিতে সই দিয়ে নাগরিকত্ব নিতে যাবেন। কোফি আনান কমিশন পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদানের সুপারিশ করেছিলেন। তারপরও আপত্তি সামরিক জান্তাদের। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, ভোটাধিকার, মৌলিক অধিকার সবই ছিল। তাদের সেই সব অধিকার কেড়ে নিয়েই তো সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নাগরিকত্ব নিয়ে ছলচাতুরি পূর্ণ আচরণসহ টালবাহানা করছে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে এক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশ বার বার আবেদন জানিয়ে আসছে। দেশটির উপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত না থাকলে তারা নানা কৌশলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘ করার চেষ্টা করবে।