বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব

394

আল-আমিন

মাঠ-ঘাট চৌচির করে চারদিকে ঝড় বৃষ্টি নিয়ে হাজির হয় বৈশাখ। কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না বৈশাখের প্রলয় নৃত্যের কথা। মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। নতুন বছরের শুরুর লগ্নে ধুয়ে মুছে পবিত্র হোক ধরণী, কবিগুরুর এমন আকুতি আমাদের বাঙালি সত্ত্বাকে প্রতি বছর নিয়ে যায় ঐতিহ্যের দিকে। পহেলা বৈশাখ উদযাপন আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রবাহকে বাঁচিয়ে রাখে। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের সবচেড়ে বড় সার্বজনীন উৎসব। এদিন সবাই পেছনে ফেলে আসা শোক, দুঃখ, হতাশা সবকিছু ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশা করে আসন্ন বছর যেন হয় সুখের, সবকিছু যেন হয় সৌন্দর্যময়।
২.
বাংলা নববর্ষ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হয়। একুশে ফেব্র“য়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালনের সঙ্গে রয়েছে আমাদের জাতিসত্ত্বার পরিচয় এবং স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস। পহেলা বৈশাখ নববর্ষ পালনের পেছনে রয়েছে আমাদের হাজার বছরের লোক সংস্কৃতি ও লোক ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাঙালি সংস্কৃতির পুননির্মাণের প্রয়াস।
পাকিস্তানি শাসকরা বাংলা নববর্ষকে কোনোদিন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে তারা মনে করেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব। বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে শহর এবং গ্রামে মেলা ও অন্যান্য আনন্দ উৎসব হয়। শুভদিন হিসেবে দিনটিতে ব্যবসায়ীরা নতুন বছরের হিসাবের খাতা চালু করেন। পহেলা বৈশাখকে ‘হালখাতা’ খোলার দিন হিসেবেও পরিচিত।বাংলা নববর্ষের সাথে আমাদের গ্রামীণ জীবন, লোক উৎসব এবং গ্রামীণ নানা খেলা দাড়িয়াবান্ধা, কাবাডি, গোল্লাছুট, জারিগান, সারিগান, ভাটিয়ালি গান, বাউল গান এবং বাঙালির সংস্কৃতি পুতুল নাচ, পান্তা ইলিশের বৈশাখী মেলা হয়। বাংলা নববর্ষের দিনটি কখনো কোনো ধর্মের ধর্মীয় উৎসবের দিন ছিল না, বাংলা নববর্ষ সর্বজনীন বর্ষবরণের দিন ছিল।
৩.
বাঙালির নববর্ষ পালন, বাংলা নববর্ষকে বাঙালির স্বতন্ত্র জীবনধারাকে জঙ্গিবাদ এবং মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার এবং আধুনিক নাগরিক জীবনে নববর্ষ পালন জাতীয় গৌরববোধের। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা সর্বজনীন বিশাল জাতীয় উৎসবে পরিণত করেছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ, শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ তরুণী এবং সবধর্মের মানুষের সমাবেশ ও সর্বজনীন উৎসব। বাংলা নববর্ষ শহর ছাড়িয়ে এখন দেশের সর্বত্র, গ্রাম-গঞ্জ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা আয়োজনের ভেতর দিয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালিত হয়। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পহেলা বৈশাখের দিন জাতীয় ছুটি ঘোষণা করেন। এখন বাঙালির আত্মপরিচয় ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসব হিসেবে পহেলা বৈশাখ, বিশেষত বাংলাদেশে নতুন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
৪.
পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের বাঙালির শ্রেষ্ঠ চিরায়ত জাতীয় উৎসব। আর এ কারণে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলোর বর্ষবরণ উৎসবকে টার্গেটে করে রমনার বটমূলের ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমাবর্ষণ করে প্রাণহানি ঘটিয়েছিল। কিন্তু জঙ্গি-মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর এই হিংস্র আক্রমণ পহেলা বৈশাখ নববর্ষ পালনকে বন্ধ করতে পারেনি। বরং মানুষের অংশগ্রহণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে এই উৎসব। পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উদযাপন কোনো রাষ্ট্রীয় আদেশ-নির্দেশ বা অর্থানুকূল্যের ওপর নির্ভর করে না। একুশে ফেব্র“য়ারি যেমন ভাষা শহিদদের আত্মদানের ভেতর দিয়ে বাঙালির সর্বজনীন শোক ও গৌরবের দিন হিসেবে পালিত হয় তেমনি পহেলা বৈশাখও বাংলার সংস্কৃতি বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়।
বাংলা নববর্ষের সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্য, সামাজিক সম্পর্ক, ইত্যাদি অভিব্যক্তি করে সংস্কৃতি। মানুষের সার্বিক জীবনকে নিয়েই সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। প্রত্যেক শিশুই সর্বপ্রথম তার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয় পরিবার থেকে। পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের সংস্কৃতি আজ হুমকির মুখে। বাংলা সংস্কৃতির চর্চা থেকে দূরে সরে যেন না যায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্ম যেন বাংলায় ভালো করে কথা বলে, বাংলা উচ্চারণ ভালো জানে, বাংলা গান শোনে। তাদের পোশাকেও যেন দেশের সংস্কৃতির ছোঁয়া দেখা যায়। যেন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ছায়া আমলে না নেয়। বাংলা সংস্কৃতিকে বিদায় জানিয়ে ভিনদেশি সংস্কৃতি চর্চাতেই অভ্যস্ত না হয়ে তরুণদের দেশি সংস্কৃতির বন্দনা বাঙালিয়ানা উৎসবে পরিণত হোক। পুরো একদিনের জন্য আমরা সবাই যেন মনে-প্রাণে বাঙালি না হই।
৫.
বৈশাখ উদযাপনে প্রাণের সাড়া দিয়ে হৃদয়ের টানে ছুটে এসে এ দেশ, এ মাটি ও এ বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং বাংলা সংস্কৃতিকে ধরে রাখা ও তার বিকাশে তরুণ প্রজন্মে কে অবদান রাখতে হবে। বাংলা সংস্কৃতির উন্নতি জন্য, নতুন প্রজন্মের কাছে বারংবার তুলে ধরতে হবে। বাংলাকে সাজাতে হবে, আত্মস্থ করতে হবে এবং সেভাবেই নতুন প্রজন্মের কাছে তা উপস্থাপন করতে হবে। বাংলা নববর্ষের হাজারও মানুষের এ মিলনমেলাকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। এখান থেকেই বীজ বপন করতে হবে বাংলা সংস্কৃতি কে ভালোবাসার। তবেই প্রকৃত প্রাণের স্পন্দন মেলানো যাবে প্রাণের মেলায়, জনতার এই ঢল আর এ উৎসব শুভ-সুন্দর ও কল্যাণময় হোক।
সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।