শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরে আত্মহননকারী পলো উৎসব ॥ হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ এবং মাছের প্রজনন

66

সাইফুল ইসলাম মৌলভীবাজার থেকে :
হাওরে এক সাথে পলো বাওয়া মৎস্য আইনে নিষিদ্ধ। যা হাওরের পরিবেশ, প্রতিবেশ মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ এবং দরিদ্র মৎস্যজীবী পরিবারের জন্য একটি অশনি সংকেত। কিন্ত এ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে সমাজের একটি সংঘবদ্ধ চক্র শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরে পলো উৎসবের নামে বিলের মাছ শিকারে তৎপর হয়ে উঠছে।
আর এসব পলো বাওয়া উৎসবকে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য বলে ওই স্বার্থন্বেষী মহলটি শহর ও গ্রাম গঞ্জে মাইকযোগে প্রচার-প্রচারণা ও ঢোল পিটিয়ে মাছ ধরার আহবান জানিয়ে উৎসাহ যোগাচ্ছে। ফলে তাদের এহেন কর্মকান্ডে হাইল হাওরের দেশীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে।
গত ২৩ জানুয়ারী হাইল হাওরের হালকাটা বিলে সকাল থেকে দিনব্যাপী পলো উৎসবে নামে একটি মহল। এতে হাওরের মাছ ধরে সাধারণ মানুষের লোভ লালসা অনেকাংশে বেড়ে যায়।
কিন্তু হাইল হাওরে উন্মুক্ত জলাশয় না থাকায় এক সময় সংরক্ষিত এলাকায় বা ইজারাকৃতবিলে মাছ ধরতেও তারা পিছ পা হবে না এমন আশংকাও করছেন মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা। এমনকি পলো বাওয়ার নামে হাইল হাওরে বিল ইজারাদার ও পলো বাহিনীদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টির আশংকাও করছেন তারা।
গত ১০ ফেব্রুয়ারী শনিবার সকাল ১১টায় ওই চক্রটি আবারো হাইল হাওরের বাইক্কা বিলের সংযোগ বেয়াইবিলের খাড়ায় উপজেলার লামুয়া, সিরাজ নগর, রাজাপুর, কাকিয়াবাজার, নোয়াগাঁও এলাকার একশ্রেণীর শতাধিক মৎস্যশিকারী পলো দিয়ে মাছ ধরতে যায়।
সেখানে স্থানীয় ক্রেল প্রজেক্টের বড় গাঙিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা (বাইক্কা বিল) স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সংগঠনের লোকদের প্রবল বাধার মুখে পড়েও তাদের রুখতে পারেনি। ওই সংগঠনটির সেক্রেটারী মিন্নত আলী বলেন-‘১০০/১৫০জন মানুষ সংযোগ বিল বেয়াই বিলের খাড়ায় সকালে পলো, কুচা ইত্যাদি দিয়ে মাছ ধরতে নামে। এ বিলে প্রচুর পানি ও কচুরিপানায় ভরপুর ছিল। প্রথমে আমরা বাধা দেই। এর পরেও তারা বাধা না মেনে মাছ ধরতে নেমে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে এ সংবাদ আমরা মৎস্য কর্মকর্তা, ইউএনও এবং পুলিশকে জানাই। ইউএনও স্যারের নেতৃত্বে তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে বিলে মাছ ধরতে নিষেধ করেন।
শ্রীমঙ্গল হাইল হাওরে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জীব বৈচিত্র্য এবং মাছের উৎপাদন ও প্রজাতির বৃদ্ধিকল্পে হাইল হাওরে কর্মরত বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান হাওরে পলো বাওয়া উৎসবের নামে হাওরের মাছের প্রজনন ও পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংসের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন- ‘হাইল জলাভূমির একটা নিজস্ব পরিবেশ ও প্রতিবেশ আছে যা একসাথে পলো বাওয়ার মাধ্যমে তছনছ হয়ে যায়। মাছের ব্যাপক মড়ক রোগ দেখা দেয়। একসাথে পলো বাওয়ার মাধ্যমে মাছসহ আরো অসংখ্য উদ্ভিদ ও জলজ প্রানীর আবাসস্থল নষ্ট হয়। একই সঙ্গে অসংখ্য মানুষজন নিয়ে একসাথে পলো বাওয়ার ফলে ঘোলা পানিতে অসংখ্য ছোট মাছ মরে যায় যা বড় মাছ ও কিছু পাখির খাবার ছিল। এই ছোট মরা মাছের পচন থেকে বড় মাছগুলোর পচন শুরু হয়। মা মাছ গুলো মরে যায়। পানির গুণাগুণও বিনষ্ট হয়। ফলে মাছের বসবাসের ও প্রজননের ক্ষেত্র নষ্ট হয়ে উঠে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন- আমরা কেউ কি একবার হিসাব কি করেছি পলো উৎসবের নামে হাওরে কতগুলো জলজ উদ্ভিদ নষ্ট হচ্ছে কিংবা যারা হয়তো আর কোনদিন মাথা তুলতে পারবে না ?।
এটা কি কেউ লক্ষ্য করেছেন যে- পলো উৎসবের নামে কতগুলো দরিদ্র জেলে পরিবারের ক্ষতি করেছেন যারা হয়তো এই এলাকায় দিনের পর দিন মাছ ধরে সংসার চালাতো?। যারা এ কাজটি করছেন তাদের সকলের প্রতি অনুরোধ থাকবে যে কাজটিই করেন আগে চিন্তা করে করেন যাতে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও মানুষের জীবন জীবিকার কোন ক্ষতি না হয়। দয়া করে কোন হুজুগে যোগ না দিয়ে চিন্তাভাবনা করে কাজ করার আহবান জানান তিনি’।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. শহীদুর রহমান সিদ্দিকী বলেন- ‘শনিবারে দুপুর দেড়টারদিকে গিয়ে দেখি বেয়াই বিলের খাড়ায় বিভিন্ন এলাকার ১০০ থেকে ১৫০ লোক হবে হাতে পলো ও অন্যান্য মাছ ধরার জিনিসপত্র নিয়ে হামলে পড়ে। স্থানীয়ভাবে এ সংবাদ পেয়ে দ্রুত আমি ও ইউএনও স্যার ও পুলিশ নিয়ে সেখানে যাই এবং মাছ ধরার জন্য নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে তাদেরকে বিদায় দেই। তিনি বলেন-‘হাইল হাওরে মাইকিং করে পলো বাওয়া মৎস্য আইনের পরীপন্থী হলেও একটি মহল এসবের তোয়াক্কা না করে উল্টো মাছ ধরার আহবান জানিয়ে হাওরে মাছ ধরে উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষতে এ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে। এ আইনে যে কারো ১ থেকে ২ বছরের জেল জরিমানা হতে পারে’।
মাইকিং করে হাইল হাওরে পলো বাওয়া প্রসঙ্গে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবাশশেরুল ইসলাম বলেন- ‘গ্রামবাংলার আবহমান ঐতিহ্যর নামে মাছের প্রজনন বিনষ্ট করা হবে এটি মৎস্য আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। শনিবারেও হাইল হাওরে ১০০/১৫০ জন লোককে বেয়াই বিল থেকে তুলে দিয়েছি’।
তিনি জানান, মাইকিং ও ঢোল পিটিয়ে পলো বাওয়া উৎসবের নামে যারা এসব কর্মকান্ডে উৎসাহ প্রদান করছে তাদের সম্পর্কে প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থা ইতিমধ্যে খোঁজ খবর নিচ্ছে। ভবিষ্যতে এসব কর্মকান্ডে যারাই জড়িত হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি জেল জরিমানা প্রদান করা হতে পারে।