॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের অবস্থা আরো ভয়াবহ। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা “ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেম্স্ বেলফোর তাঁর দেশের ইহুদী নেতা ব্যারন রথচাইন্ডকে লিখিত এক পত্রের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের আরব ভূমিতে একটি ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্র“তি দেন। যাকে ঐতিহাসিক বেলফোর ঘোষণা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।” অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী ইঙ্গ-মার্কিন অন্যয়ভাবে অসহায় ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূখন্ড থেকে উৎখাত করে সেখানে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরবদের পরাজিত হওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। ইসরাইল কর্তৃক একের পর এক ফিলিস্তিনি ভূখন্ড জোরপূর্বক দখলের মাধ্যমে বহু ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। এরপর প্রায় সাত দশক পেরিয়ে গেলেও উদ্ধাস্তু ফিলিস্তিনিরা আজো তাদের নিজ আবাসে ফিরতে পারেনি। বরং ইসরাইলের নির্যাতনে প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষ, শিশু নিহত হচ্ছে। নির্বিচারে বর্ষিত বোমার আঘাতে তাদের ঘর-বাড়ি চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে। ইসরাইলী দখলদার বাহিনী নানা অজুহাতে ফিলিস্তিনিদের তাদের আবাস থেকে উচ্ছেদ করছে। তাদের জায়গা-জমি দখল করছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয়সহ বহু পশ্চিমা দেশ নীরবে তাদের এসব অন্যায় কর্মকান্ডের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যা অজুহাতে ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে। সেখানে নির্বিচারে হাজার হাজার নিবীহ ও নিরপরাধ নারী-পুরুষ, শিশু, যুবক ও বৃদ্ধকে হত্যা করা হয়েছে। আফগানিস্তানও একই পরিণতি ভোগ করেছে। একজন ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে গিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা হরা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে বহু জনপদ। বন্দী করা হয়েছে বহু মানুষকে। শুধু বন্দী করেই ক্ষান্ত দেয়া হয়নি। বন্দীদের উপর চালানো হয়েছে অমানবিক নির্যাতন। গুয়ানতানামো কারাগারের কথা আমরা জানি। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগার, যা বন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দীদের বিনাবিচারে আটক রাখা হয় এবং তথ্য আদায়ের লক্ষ্যে ওয়াটার বোর্ডিংসহ বিবিধ আইন বহির্ভূত উপায়ে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের প্রকার ও মাত্রা এতই বেশি যে এই কারাগারকে মর্ত্যের নরক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন ও লিবিয়ার ন্যায় সিরিয়া, মিসর ও ইয়ামেনেও যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে। অন্যায়-অত্যাচার ও জুলুম-নির্যাতনে সেখানের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। সেখানে অমুসলিমদের চেয়ে মুসলিমদের দ্বারাই অন্য মুসলিম নির্যাতিত হচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর মুসলিমরা এ সব বন্ধে সেখানে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তারা পাশ্চাত্যের বৃহৎ শক্তিগুলো দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে। মুসলিম নামধারী কিছু অত্যাচারী শাসক দ্বারা তারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতা করছে অমুসলিমরা।
এছাড়া বর্তমানে সারা বিশ্বের অমুসলিম সমাজেও চরম অশান্তি বিরাজমান। বর্তমানের পরিবর্তিত ও কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষের বানানো বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদ মানুষের সামগ্রিক জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের সঠিক সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তাওহীদ ও আখিরাত বিমুখ কোন জড়বাদী নীতি কখনো সমাজে সার্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করতে পারে না। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ইনসাফপূর্ণ কোন কর্মসূচী নেই। এ কারণে আমরা দেখতে পাই, পাশ্চাত্যের পারিবারিক জীবন আজ হুমকির মুখে। সেখানে পিতা তার সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করছে না। একইভাবে সন্তানও পিতা-মাতার প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন করছে না। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের হক আদায় করছে না। ফলে সেখানে এক অশান্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। এছাড়া পাশ্চাত্যের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো নানাভাবে বিশ্বের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর তাদের অন্যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। যে কারণে বিশ্বশান্তি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
রাসূলুল্লাহ (স.) ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ ধারণার শ্রেষ্ঠত্ব ঃ রাসূলুল্লাহ (স.) এর রিসালাতের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল সমাজের সকল স্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে প্রত্যেককে তার পরিপূর্ণ হক দিয়ে দেয়া। আল্লাহ তা’য়ালা (স.) কে অধিক গুরুত্বসহকারে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল-কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে-অতএব তুমি লোকদেরকে (সেই বিধানের দিকে) ডাকো এবং নিজে অটল থাকো যেভাবে তুমি আদিষ্ট হয়েছো। তাদের ইচ্ছার অনুসরণ করো না। বলো, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তা বিশ্বাস করেছি। আর আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ আমাদের প্রভু এবং তোমাদেরও প্রভু আমাদের জন্য আমাদের কর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম। আমাদের এবং তোমাদের মাঝে কোনো বিবাদ নেই। আল্লাহ আমাদেরকে একত্রিত করবেন। তাঁর কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন। আল-কুরআনের আবেদন অনুসারে তিনি সকলকে এমন এক সমাজ ব্যবস্থার দিকে আহ্বান করেন যেটা পরিপূর্ণ ইনসাফভিত্তিক। এ জন্য তিনি সর্বপ্রথম নিজেকে সমস্ত ভাল গুণে গুণান্বিত করেন। ন্যায়বিচার, আমানতদারী, সত্যবাদিতা, ওয়াদা রক্ষা, ক্ষমা, বিনয় পভৃতি উত্তম মানবিক গুণাবলী ছোটকাল থেকেই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। বিশেষ করে তৎকালীন আরব সমাজের নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা তাঁকে ব্যথিত করত। সে সময় গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকত। তাদের মধ্যে কোন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য বিদ্যমান ছিল না। সবলরা দুর্বলের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাতো। সুদের যাঁতাকলে পিষ্ট হতো গরীবরা। আর ধনীরা অর্থনৈতিক নির্যাতনে গরীবদের নিঃস্ব করে দিত। চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি ছিল আরবদের নিত্যদিনের ঘটনা। তাদের এই অবস্থার বর্ণনায় আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-বেদুঈনরা কুফরী ও মুনাফিকিতে অধিক পারদর্শী এবং আল্লাহ তাঁর রাসূসের ওপর যা নাযিল করেছেন তার সীমারেখা সম্বন্ধে তারা অধিকতর অজ্ঞ। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ।
সমাজের এই অশান্তিময় অবস্থা রাসূলুল্লাহ (স.)কে সারাক্ষণ কষ্ট দিত। তিনি সব সময় চিন্তা করতেন কিভাবে সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়। এ কারণে আমরা দেখতে পাই নুবুওয়াতের আগেই যুবক মুহাম্মদ (স.) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুবকদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। এর নামকরণের ব্যাপারে বলা হয়েছে-কেননা তাঁরা এই মর্মে অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তাঁরা নিজেদের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবে। তাঁদের কোন ক্ষমতাবান ব্যক্তি কোন দুর্বল ব্যক্তির ওপর জুলুম করলে তা প্রতিহত করা হবে এবং কোন স্থানীয় লোক কোন বিদেশী অভ্যাগতের হক ছিনিয়ে নিলে তা ফিরিয়ে দেয় হবে। দাওয়াতী জীবনের প্রথম দিকে একবার রাসূলুল্লাহ (স.) বানূ হাশিম গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি বৈঠক আহবান করেন। সেখানে তিনি তাঁর দাওয়াতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন যে “আমি তোমাদের নিকট এমন দাওয়াত নিয়ে এসেছি, যে দাওয়াত দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করবে।” অর্থাৎ এর মাধ্যমে দুনিয়ার এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে কোন অকল্যাণ ও অশান্তি থাকবে না। আর এ দাওয়াত কবুল করলে আখিরাতেও সফল হওয়া যাবে। এর কিছুদিন পর তিনি কুরাইম প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনা করার সময় বলেন, “আমি যে দাওয়াত পেশ করছি তা যদি তোমরা গ্রহণ করো, তাহলে তাতে তোমাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের কল্যাণ নিহিত আছে।
এখানে দুনিয়ার কল্যাণ বলতে দুনিয়ার সামগ্রিক কল্যাণকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে দুনিয়ার জীবন সর্বাঙ্গীন সুন্দর হবে। সমাজব্যবস্থা নিষ্কলুষ ও নিখুঁত হবে স্থায়ী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। রাসূলুল্লাহর (স.) উদ্দেশ্য ছিল সমাজের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে সেখানে ন্যায়-নীতি ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। এ কারণে কুরাইশদের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি আবার আহ্বান করেন এভাবে যে, একটি মাত্র কথা যদি তোমরা আমাকে দাও, তবে তা দ্বারা তোমরা সমগ্র আরব জাতির ওপর আধিপত্য লাভ করবে এবং যত অনারব আছে তারা তোমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে। মাক্কী জীবনে রাসূলুল্লাহ (স.) ও তাঁর সাহবীরা যখন প্রচন্ড বিবোধিতা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন, তখন সাহাবীরা একবার রাসূলুল্লাহর (স.) কাছে তাঁদের নির্যাতনের কথা বলে এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য দু’আ চাইলেন। তখন তিনি সাহাবীদের সুসংবাদ শুনিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহ এ দীনকে একদিন অবশ্যই পূর্ণতা দান করবেন। (ফলে সর্বত্রই নিরাপদ ও শান্তিময় অবস্থা বিরাজ করবে)। এমনকি তখনকার দিনে একজন উষ্ট্রারোহী একাকী সান’আ থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত নিরাপদে সফর করবে, অথচ আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয়ে সে ভীত থাকবে না, এমনকি তার মেসপালের ব্যাপারে নেকড়ে বাঘের আশঙ্কাও তার থাকবে না। কিন্তু তোমরা (ঐ সময়ের অপেক্ষা না করে) তাড়াহুড়া করছো। এখানে রাসূলুল্লাহ (স.) এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিলেন, যেটা সম্পূর্ণ ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিময়। যেখানে কোন চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি ও লুন্ঠন থাকবে না। কেউ অন্যের জান-মাল, ইজ্জত, সম্ভ্রম অন্যায়ভাবে স্পর্শ করার সাহস করবে না। বাস্তবিকই রাসূল (স.) এ রকম এক শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
হিজরতের পর আদী ইব্ন হাতিম (রা.) রাসূলুল্লাহ (স.) এর কাছে এসে তাঁকে নানাভাবে পরখ করতে লাগলেন। এ সময় রাসূল (স.) আগন্তুকের চিন্তাধারার সাথে সঙ্গতি রেখে অনেক কথাই বললেন। এক পর্যায়ে তিনি ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন-অচিরেই তুমি শুনবে, এক মহিলা সুদূর কাদিসিয়া থেকে একাকী তার উটে সওয়ার হয়ে এ মসজিদ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে এবং সম্পূর্ণ নির্ভয়ে এসে পৌঁছেছে। সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি হিজরতের পরে মদীনার জীবনের প্রথমেই মদীনায় বসবাসরত বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীদের সাথে এক ঐতিহাসিক চুক্তি করেন। যেটি হতিহাসে ‘মদীনার সনদ’ হিসেবে স্বীকৃত। এ সন্ধির মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সেখানে এক শান্তিময় ঐক্য গড়ে তোলেন।
শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ (স.) এর সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রধান দিকসমূহ ঃ মাক্কী জীবনে রাসূলুল্লাহ (স.) যেমন মনে-প্রাণে কামনা করতেন সকল অন্যায়-অবিচারহীন একটি শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণের, তেমনি মদীনায় গিয়ে তাঁর প্রধান লক্ষ্যই ছিল সমস্ত অন্যায়-অবিচার দূর করে সাম্যের ভিত্তিতে এক শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। প্রকৃত অর্থেই মদীনায় রাসূল (স.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজের বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ তার সমস্ত সামাজিক সম্পর্কসহ এমনভাবে সংশোধিত হয়েছিল, যার ফলে সমাজের সকল স্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল। সেখানে কেউ অন্যায়ভাবে অন্যের হক নষ্ট করত না। প্রত্যেকে নিজ নিজ অধিকার ভোগ করত। কারো প্রতি সামান্যতম জুলুম করা হত না। বিশেষ করে ওহুদ যুদ্ধের পর নাযিলকৃত সূরা আন-নিসা এবং আল-মা’ইদাতে বর্ণিত ইসলামের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান রাসূলুল্লাহ (স.) তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করেছিলেন। জীবন, জগৎ ও মানুষের মাঝে যে মূলগত ঐক্য বিদ্যমান তার ভিত্তিতে সাম্য ও ইনসাফপূর্ণ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল রাসূলের (স.) মূল লক্ষ্য তবে এই সাম্য মানুষের ব্যক্তিগত যোগ্যতা অনুসারে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি, বরং যোগ্যতামাফিক প্রত্যেক তার সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার ভোগ করত। আর এ সব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গৃহীত রাসূলুল্লাহ (স.) এর সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রধান যে দিকসমূহ লক্ষ্য করা যায় তা হচ্ছে-
আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব ও একত্ব প্রতিষ্ঠা করা ঃ রাসূলুল্লাহ (স.) এর সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রধান ভিত্তিই ছিল আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর একত্ব প্রতিষ্ঠা করা। কারণ আল্লাহ তা’য়ালাকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া সমাজে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আসমান-যমীন ও এখানে যা কিছু আছে সবই তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, অতি মহান ও শ্রেষ্ঠ তিনি যাঁর হাতে রয়েছে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের কর্তৃত্ব। তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতা রাখেন। অন্যত্র বলা হয়েছে। যিনি পৃথিবী ও আকাশের রাজত্বের মালিক, যিনি কাউকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেননি, যার সাথে রাজত্বে কেউ শরীক নেই, যিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন তারপর তার একটি তাকদীর নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এছাড়া আল-কুরআনে আরো বহু আয়াত বিদ্যমান, যেখানে পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার সার্বভৌম ক্ষমতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (স.) সকলকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছিলেন। তাঁকে এ ব্যাপারে আদেশ দিয়ে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- বলো, হে কিতাবধারীগণ! তোমরা আমাদের ও তোমাদের মাঝে একটা অভিন্ন কথায় আসো যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করবো না, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবো না এবং আল্লাহর পরিবর্তে কেউ কাউকে প্রভু বানাবো না। আসলে আল্লাহর যমীনে আল্লাহকে রব, সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, পালনকর্তা ও বিধানদাতা হিসেবে স্বীকার করে সেই অনুযায়ী গোটা সমাজ ব্যবস্থা পরিচালনা না করলে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব না। এ কারণে রাসূলুল্লাহ (স.) তাঁর জাতিকে সর্বপ্রথম এ দিকে আহ্বান করেন। আর আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর একত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেন। (অসমাপ্ত)