ওসমানীনগর থেকে সংবাদদাতা :
ভোট আইলে হখলেওউ লাম্বা মাত মাতইন, আর অখন আইছইন ফটো তুলবার লাগি। এক সাফতা ধরি ফটো তুলতে-তুলতে আমরা হেরান অইগেছি। ফটো তুললে কিতা পেট ভরবোনি কউকা চাই’। এভাবেই সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ক্ষোভ কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ওসমানীনগর উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ তাজপুর গ্রামের বানভাসি ও ত্রাণ বঞ্চিত আফছর আলী (৬০) ও পাশ্ববর্তী লামা তাজপুর গ্রামের ছায়ারুন বেগম (৩৮)। অনুরূপ ভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেন বালাগঞ্জ সদর ইউনিয়নের রাধাকোনা গ্রামের পানিবন্দী হাছনা বেগম। তার ভাষায়- প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা সহ সব বয়সী মানুষেরা হাসিমুখে খালি হাতে পানিবন্দী লোকজনের কাছে আসছেন আর ছবি তুলছেন। যুবকরা দল বেঁধে এসে আমাদেরকে বলে তারা নাকি কি বুকে (ফেইসবুকে) সেলফি তুলতে এসেছে।
হাছনা বেগম আক্ষেপের সুরে বলেন, শত কষ্টে থাকলেও আমাদের দু:খ দেখার কেউ নেই। ভোটের সময় জনপ্রতিনিধিরা লাখ-লাখ টাকা বিলিয়ে দেন। কিন্তু বানভাসিদের কাছে এসে তারা বলেন-সরকারী বরাদ্দ আসলে দেয়া হবে আমাদের কিছু করার নাই। সরজমিন বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলার বন্যা কবলিত এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, দুই উপজেলার প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ এখন পানিবন্দী রয়েছেন। বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলার প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। চৈত্রের অকাল বন্যায় দুই উপজেলার শতভাগ বোরো ফসল বিপর্যয়ের পর এক মাসের স্থায়ী বন্যায় পানিবন্দী লোকজন অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। প্রতিদিনই পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বন্যা কবলিত এলাকার বাসিন্দারা পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গোখাদ্যের সংকটে গৃহপালিত পশু নিয়ে মানুষজন বিপাকে পড়েছেন। গৃহস্থালী জিনিসপত্র পত্র নিয়ে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান খুঁজছেন। অনেকেরই ঠাঁই হয়েছে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ী কিংবা নিকটস্থ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তবে বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র খোলার কথা বললেও দৃশ্যত এগুলোর কোনো অস্তিত্ব মিলছে না বলে বন্যা দুর্গত লোকজনের অভিযোগ। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু বানভাসি লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে। তাদের বাড়ীঘর বন্যা আক্রান্ত হওয়ায় তারা নিজেরাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ওঠেছেন। নিজ-নিজ বাড়ীতে পানিবন্দি ও আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নেয়া ত্রাণ বঞ্চিত লোকজনের ভাগ্যে একটু শুকনো খাবারও জুটছে না। বন্যার্ত মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের প্রার্দুভাব, রোগ বালাই দমন ও পানি বিশুদ্ধকরণে স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আক্রান্ত এলাকায় না গিয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন কর্মীদের দিয়ে তাদের বাসস্থানের পাশ্ববর্তী এলাকায় ফটোসেশন করিয়ে তাদের দায়িত্বের পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সচেতন নাগরিক সমাজের লোকজন জানান, বিগত বছরগুলোতে বন্যা ও বিভিন্ন দুর্যোগে প্রবাসী বিভিন্ন সংগঠন, প্রবাসী ব্যক্তি, বিদেশেী দাতা সংস্থা, এনজিও ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা দেয়া হলেও এবার সেরকম কাউকে বন্যা দুর্গত এলাকায় দেখা যাচ্ছেনা। বিগত বছরের বন্যাকালীন সময়ে উল্লেখিত সংগঠনের অর্থায়নে এবং সরকারী ভাবে মানুষকে শুকনো খাবার দেয়া হলেও এবার সেরকম কোনো চোখে পড়ছে না।
বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলায় সরকারী বরাদ্ধ থেকে আংশিক এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা হলেও অধিকাংশ মানুষ রয়েছেন ত্রাণ বঞ্চিত। দুই উপজেলার প্রায় চার লক্ষাধিক বানভাসি মানুষের জন্য সরকারী ভাবে দেয়া এই যৎ সামান্য এই বরাদ্ধ কতটুকু সহায়ক হবে এই নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। এদিকে রবিবার দিনব্যাপি বালাগঞ্জের কিছু সংখ্যক দুর্গত এলাকায় সরকারী ত্রাণ বিতরণ করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার। বালাগঞ্জে ত্রাণ বিতরণকালে জেলা প্রশাসকের সাথে ছিলেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদাল মিয়া, ইউএনও প্রদীপ কুমার সিংহ, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তাকুর রহমান মফুর, ইউপি চেয়ারম্যান আনহার মিয়া ও সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন প্রমুখ। রবিবার ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জে সরকারী বরাদ্ধ থেকে বন্যা কবলিত কিছু এলাকায় ত্রাণ বিতরণে অংশ নেন আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিছবা উদ্দিন সিরাজ, জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী। ওসমানীনগরে ত্রাণ বিতরণকালে আওয়ামীলীগের দুই নেতার সাথে ছিলেন ইউএনও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সহ আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ওসমানীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ কমিউনিটি ক্লিনিক সংশ্লিষ্টদের বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষদেরকে সার্বক্ষণিক সেবা প্রদানের জন্য কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর উপজেলায় চৈত্রের অকাল বন্যায় শতভাগ বোরো ফসলের বিপর্যয় ঘটে। গত দেড় মাসের দুই দফা বন্যা ও সাম্প্রতিক কালের এক মাসের স্থায়ী বন্যায় দুই উপজেলার প্রায় দুই হাজার হেক্টর আউশ ও রোপা আমন জমি তলিয়ে যায়। দুই উপজেলার পানিবন্দী প্রায় চার লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে অধিকাংশ লোকই হত দরিদ্র। হত দরিদ্র লোকজনের এখন অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটছে।