নিষ্ফল অবরোধের চার মাস পার ॥ তবুও প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নেই

104

1430761457কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাস্তবে কোনো কার্যকারিতা না থাকলেও আজ মঙ্গলবার চার মাস পূর্ণ করছে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা ‘অনির্দিষ্টকালের অবরোধ’। সংখ্যার দিক থেকে অবরোধের আজ ১২০তম দিন। কার্যকারিতা না থাকলেও জোটের পক্ষ থেকে অবরোধ প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনও দেয়া হয়নি। যার ফলে দেশের আন্দোলনের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই অবরোধের কারণে নতুন এক রেকর্ড গড়লো বিএনপি। নজিরবিহীন এই অবরোধের শুরু থেকেই রাজনৈতিক কার্যকারিতা না থাকলেও ছিল নাশকতা, বিশেষ করে পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ভীতসন্ত্রস্ত ছিল জনজীবন।
প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে ডাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করে ওইদিন নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেতে পুলিশি বাধা পেয়ে গুলশান কার্যালয়ের ফটকের ভেতরেই দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সামনে লাগাতার অবরোধের ডাক দেন ২০ দলীয় জোট প্রধান ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ওইদিন তিনি বলেছিলেন, ‘পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা না করা পর্যন্ত অবরোধ চলতে থাকবে’। এরপর ১৯ জানুয়ারি এবং ১৩ মার্চ দু’দফায় সংবাদ সম্মেলনেও তিনি বলেছেন, ‘যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত অবরোধ চলবে।’
তবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া গত ৫ এপ্রিল আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়ে গুলশানের বাসায় ফিরে যাওয়ার পর থেকেই ঘোষণা ছাড়াই অবরোধ ‘অকার্যকর’ হয়ে যায়।
‘গত ৫ জানুয়ারি আপনি যে অবরোধ ডেকেছিলেন, তা এখনও অব্যাহত আছে কি-না’- ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দু’দিন আগে গত ২৬ এপ্রিল খালেদা জিয়ার ডাকা সংবাদ সম্মেলনে তার কাছে এই প্রশ্ন রেখেছিলেন এই প্রতিবেদক। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘অবরোধ আমি ডাকিনি, এটা ছিল ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচি। আপনারা জানেন, আমরা এখন নির্বাচন (সিটি)সহ কিছু ঝামেলায় আছি। যার কারণে ২০ দলীয় জোটের বৈঠকও ডাকা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া আপনারা তো দেখছেন অবরোধ এখন আর তেমন সক্রিয় নেই, এই মোটামুটি আছে আর কী।’
গত ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই অবরোধ এখনও বহাল আছে কী নাই-এনিয়ে সৃষ্ট অস্পষ্টতা কিংবা ধূম্রজাল সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান গতকাল সোমবার বলেন, ‘অবরোধের এখন আর কার্যকারিতা নেই, আমাদের দল ও জোটের নেতা-কর্মী ও দেশবাসী সবাই এভাবেই বিষয়টিকে মেনে নিয়েছে। এটিই হচ্ছে বাস্তবতা। তাছাড়া অবরোধ কর্মসূচি পালনের জন্য আমরা নতুন করে আহ্বানও জানাইনি। যার কারণে এখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে এটিকে প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয়তাও আছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে এই অবরোধের বিষয়ে নতুন চিন্তার সুযোগ দেয়াও সমীচীন হবে না।’ তাহলে ভবিষ্যতে কেউ যদি প্রশ্ন তোলে যে, বিএনপি ইতিহাসের দীর্ঘতম সময়….দিন ধরে অবরোধ করেছিল, তখন বিএনপি কী জবাব দেবে? এই প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘এটা অবশ্য একটা বিষয়। তবে সেটি বলার সুযোগ নেই।’
তবে ২০ দল শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী গতকাল বলেন, ‘অবরোধ ওই অবস্থায় আছে আর কী! প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়নি-এটা ঠিক। যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে প্রহ্যাহার করা হয়নি, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় অবরোধ এখনও বহাল রয়েছে।’
অবরোধ চলমান আছে কী নেই-এনিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দল শরিকদের সমন্বয়হীন বক্তব্য থাকলেও রাজনৈতিক কর্মসূচিকেন্দ্রিক সহিংসতার দীর্ঘতম এক রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে এই অবরোধে, যাতে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। ২০ দলের টানা এই অবরোধে নিহত হয়েছেন ১৫৩ জন, যার ৯০ জনই সাধারণ মানুষ। এরমধ্যে বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয়েছে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটানা এত সময় ধরে অবরোধের ইতিহাস নেই। অতীতে এরকম নাশকতা বা সাধারণ মানুষের প্রাণহানির এত ঘটনাও ঘটেনি। তা ছাড়া আগে কখনোই সাপ্তাহিক ছুটি বা জাতীয় দিবসে আন্দোলন কর্মসূচি থাকতো না। যা এবার হয়েছে। অতীতের সব আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষকে নিশানা করে আগে কখনো হামলা হয়নি। আগে রাজনৈতিক আন্দোলন মানে ছিল পুলিশের হামলা, তাদের সঙ্গে মারামারি কিংবা দুই পক্ষের সংঘর্ষ। কিন্তু এবার রাজনীতিতে নতুন  অস্ত্র হিসেবে যুক্ত হয়েছে পেট্রোল বোমা। যদিও এনিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক জোট একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের গ্রন্থ বাংলাদেশের তারিখ, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সংবাদপত্রে হরতালচিত্র (১৯৪৭-২০০০) বইয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর আগে টানা অসহযোগ কর্মসূচি চলেছে ২০ দিন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বিএনপি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আওয়ামী লীগ এই কর্মসূচি দিয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, সবচেয়ে বড় আন্দোলন হয়েছে এরশাদ সরকারের পতনের দাবিতে। আট বছর বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন হলেও ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে চিকিত্সক শামসুল আলম মিলন মারা গেলে এরশাদ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এরপরই টানা আন্দোলনের ঘোষণা আসে। নয় দিনের মাথায় (৫ ডিসেম্বর) এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
এবারের টানা অবরোধ-হরতালে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নিয়েও স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এরইমধ্যে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছে। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রকাশ উপলক্ষে বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি জানিয়েছে, টানা হরতাল-অবরোধ, সহিংসতাসহ রাজনৈতিক অস্থিরতায় চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। তাই চলতি অর্থবছরে ১ শতাংশ কমে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেয় বিশ্বব্যাংক। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত ৫ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে, জানুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত আড়াই মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতায় উৎপাদন ব্যবস্থায় ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। যা মোট জিডিপি’র দশমিক ৫৫ শতাংশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে সমপরিমাণ পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হতো, যা জিডিপিতে যোগ হয়ে এর আকার বড় করতো বলেও মনে করে সিডিপি।