এক যুগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলভীবাজারে ব্যাপক উন্নয়ন

66

মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজার জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের অন্তর্ভুক্ত একটি সীমান্তবর্তী জেলা। বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ও পর্যটনবান্ধব জেলাটি চা বাগানের জন্য বিখ্যাত। জেলার উন্নয়নে এবং মান স¤পন্ন নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে বিগত এক যুগে নানাবিধ প্রকল্প হাতে নেয়ায় এবং বাস্তবায়ন করায় সীমান্তবর্তী এই জেলাটি হয়ে উঠেছে আধুনিক বাংলাদেশের এক ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি।
সমন্বিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের অংশ হিসেবে মৌলভীবাজার জেলায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, অবকাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষিসহ বিভিন্নখাতে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
নি¤েœ মৌলভীবাজার জেলার উন্নয়ন কর্মকান্ডসমূহ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
কৃষি :
গত এক যুগে মৌলভীবাজারের কৃষিখাতে এক নীরব বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রামের আওতায় ৫২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলার কৃষকদের হাতে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি এবং উন্নতজাতের বীজ হস্তান্তর করা হয়েছে। ২০২১ সালে শেষ হওয়া প্রকল্পটির সফলতা এখন মৌলভীবাজার জেলার ফসলের খেতে দৃশ্যমান, প্রধান প্রধান ফসলের উৎপাদনশীলতা ফসলভেদে বেড়েছে ১০-১৫ শতাংশ।
মৌলভীবাজারের মাটি, কন্দালফসল (আলু, মিষ্টিআলু, কচুইত্যাদি) তেল জাতীয় ফসল (সরিষা, সূর্যমুখী, তিল, বাদাম ইত্যাদি) এবং লেবু জাতীয় ফসল (লেবু, মাল্টা, কমলা ইত্যাদি) উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত। মাটির এ উর্বরতাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ং স¤পূর্ন করার লক্ষ্যে মৌলভীবাজার জেলায় তেল, লেবু এবং কন্দাল জাতীয় ফসল উৎপাদনে সরকার মোট ৫০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে জাতীয় উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি লাভবান হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষক। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় মৌলভীবাজারের কৃষিখাতে উদ্ভাবন ও গবেষণায় জোর দেয়া হয়েছেযার অংশ হিসেবে রাসায়নিক সারের বদলে জৈব সার ব্যবহার করে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্যের পুষ্টিমান নিশ্চিত করার প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে ১৭২ কোটি টাকা।
সৌরশক্তি ও পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পে ৬৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ১১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলায় “কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প” বাস্তবায়ন করা হয়েছে যার ফলে এখন ঝড়, বৃষ্টি, খরা, কুয়াশা ইত্যাদি বিষয়ে কৃষকদের আগে থেকে সতর্ক করা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে। সঠিক সময়ে সঠিক মূল্যে সঠিকজাতের উন্নতমানের বীজসহজ লভ্য করে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ২৭০ কোটি টাকার প্রকল্প চলমান আছে। এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে কৃষক পর্যায়ে উন্নত মানের ধান, গম ও পাট বীজ বিতরণ করা হয়েছে।
অবকাঠামো :
১২ কোটি টাকা ব্যয়ে মৌলভীবাজারের জুড়ী ও বড়লেখা থানা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। পুলিশের কাছ থেকে সেবা প্রাপ্তি জনগনের জন্য হয়েছে আরো সহজ। ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজনগর উপজেলায় ফায়ারসার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে।
৬ কোটি টাকা ব্যয়ে মৌলভীবাজার জেলার শেরপুরে হাইওয়ে আউট পোস্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
আউট পোস্ট নির্মাণের ফলে অপরাধ প্রবণ শেরপুর হাইওয়ে এখন স¤পূর্ন নিরাপদ।
বিচার প্রার্থীদের সেবা প্রাপ্তি সহজ করতে জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন ৫ম তলা থেকে ৮ম তলা পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে। মোট ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও ইসলামিক সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে বড়লেখা, কমলগঞ্জ এবং রাজনগর উপজেলা মডেল মসজিদের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। মৌলভীবাজারের অধিকাংশ পরিবারের দু’একজন সদস্য প্রবাসে থাকেন। প্রবাসে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ এবং দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বড়লেখা উপজেলায় নির্মিত হয়েছে টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার। বিদেশ যাত্রীদের পাসপোর্ট প্রাপ্তি ও নবায়ন সহজতর করতে জেলায় ৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস।
“মনুনদীর ভাঙন হতে মৌলভীবাজার জেলার সদর, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলা রক্ষাপ্রকল্প “বাস্তবায়িত হচ্ছে ৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৮৫.৯১কিঃমিঃ বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ পুনর্বাসনের মাধ্যমে প্রায় ১, ০০, ০০০ হেক্টর ফসলী জমি বন্যার কবল হতে রক্ষা পাবে।
যোগাযোগ :
জেলাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে মৌলভীবাজারে মোট ৫৬ কিলো মিটার সড়ক উন্নয়ন, ৮৩ মিটার কংক্রিট ব্রিজ নির্মাণ, ৩৮০ মিটার কংক্রিট কালভার্ট নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজ স¤পন্ন হয়েছে।
এছাড়া ৩৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে “জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ (সিলেট জোন)” প্রকল্প চলমান আছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জেলার আন্তঃ উপজেলা যোগাযোগ আরো সহজ ও গতিময় হবে। ৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩২.৯৪ মিটার রাজাপুর সেতু এবং ৭.৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজ চলমান আছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার সাথে ভারত সীমান্তে অবস্থিত চাটলা চেকপোস্টের সরাসরি উন্নত ও নিরাপদ যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে “গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্তকরণ “প্রকল্পের অংশ হিসেবে মৌলভীবাজারের ২৪ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন স¤পন্ন হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ঢাকা-মৌলভীবাজার-সিলেটসড়ক যোগাযোগে এসেছে নতুন মাত্রা, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিরাপদ, আরামদায়ক, সময় এবং ব্যয় সাশ্রয়ী সড়ক নেটওয়ার্ক।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি :
বই ও পত্রিকা পাঠকদের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে জেলা সরকারী গ্রন্থাগার ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
২২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে জেলা শিল্পকলা একাডেমি। চারতলা এ ভবনে আছে লাইব্রেরি, প্রশিক্ষণ হল এবং সেমিনার হল। মোট ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, বড়লেখা এবং কুলাউড়াতে অডিটোরিয়াম নির্মিত হয়েছে। প্রতিটি অডিটোরিয়ামে আছে ৫০০ টি আসন। মনিপুরী সংস্কৃতির সংরক্ষণ, প্রচারণা এবং প্রসারের লক্ষ্যে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে মনিপুরী ললিতকলা একাডেমি প্রশিক্ষণ সেন্টার।
৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার দুঘর শ্রীমতি উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মিত হয়েছে। ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে আজমনি উচ্চ বিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের প্রথম তলা। ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ কলেজের অসমাপ্ত নির্মাণ কাজ স¤পন্ন করা হয়েছে, আরো ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে কলেজটির সীমানা প্রাচীর এবং প্রধান ফটক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আইসিটি কম্পিউটার ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানবৃদ্ধি করার লক্ষ্যে জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে দুই পর্যায়ে শেখ রাসেল ডিজিটালল্যাব স্থাপনের কাজ স¤পন্ন হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা :
মৌলভীবাজার জেলার বিত্তহীন মহিলাদের জন্য “দু:স্থ মহিলা উন্নয়ন (ভিজিডি) কর্মসূচি” প্রকল্পের অধীনে মাসিক ৩০ কেজি হারে ২০১২-২০২২ সময় কালে ৩২৮৩২ মেট্রিকটন চাল বিতরণ করা হয়েছে। অসহায়, দুঃস্থ গর্ভবতীমায়েদের মাসিক ৮০০ টাকাহারে একই সময়ে মোট প্রদান করা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ১৪২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে প্রত্যেক চা শ্রমিককে এককালীন অনুদান প্রদান করা হয়েছে ৫০০০ টাকা। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৮৫টি পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে দুর্যোগসহনীয় বাসস্থান।
১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩২ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণ করা হয়েছে এবং ৬৫০১ জন গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
উপজেলা পর্যায়ে মহিলাদের আর্থিকভাবে সাবলম্বী করার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ৩ কোটি টাকা যেখানে প্রশিক্ষণার্থীদের জনপ্রতি দৈনিক ভাতা হিসেবে দেয়া হয়েছে ২০০ টাকা।
স্বাস্থ্য :
মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলায় ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে। রাজনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে। জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে মোট ২২টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। এসব সেবাকেন্দ্র থেকে নিয়মিতভাবে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হয়।
উল্লিখিত প্রকল্পগুলোর বাইরেও জেলার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্নখাতে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছে। জেলার ইউনিয়নগুলোর অভ্যন্তরীণ কাঁচা রাস্তাগুলোতে দেয়া হয়েছে ইটের সলিং। ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক মসজিদ, মন্দির, শ্মশানঘাট, কবরস্থান ইত্যাদি স্থাপনা সংস্কার এবং পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। জেলায় অবকাঠামো ও যোগাযোগখাতে বেশ কিছু বড় বড় প্রকল্প চলমান আছে। চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে মৌলভীবাজার জেলা হয়ে উঠবে আরো আধুনিক ও নাগরিকবান্ধব। দিন বদলের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রা চলমান থাকবে জেলার সাধারণ মানুষের এটাই প্রত্যাশা।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো.সামছুদ্দিন আহমদ বলেন, জেলা উন্নয়ন হওয়াতে কৃষকরা বিভিন্নভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। বিশেষ করে ফসলের উৎপাদন বাড়ছে। যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল না, তাদেরকে বিনামূল্যে সার ও বীজ দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে।
মৌলভীবাজার এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ আব্দুল্লাহ বলেন, সরকারের উন্নয়নের লক্ষে বড় বড় প্রকল্পসমূহের গুণগতমান বজায় রেখেই সড়ক নির্মাণে বিদ্যামান যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো দক্ষ ব্যবস্থাপনায় মোকাবিলা সক্ষম হচ্ছে যার ফলে উন্নয়নের সুফল ভোগ করছেন জেলার মানুষজন।
মৌলভীবাজার ৪ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক চীফ হুইপ উপাধ্যক্ষ ড. মো.আব্দুস শহীদ এমপি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলছে। তিনি সর্বক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে বার বার আওয়ামীলীগ সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে হবে। যার ফলে মৌলভীবাজার জেলায় এই বিশাল উন্নয়ন হয়েছে।’