ভাষাতত্ত্বের বিবর্তন

62

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :

(পূর্ব প্রকাশের পর)
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পাদে প্রদত্ত উইলিয়াম জোনস-এর ঐ ভাষণ থেকে ভারত, ইরান ও ইউরোপের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ভাষার উদ্ভব ও বংশ পরিচয় সম্পর্কিত ধারণার বিকাশ ঘটে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশের অস্তিত্ব অনুমতি হয় এবং ঐ ধারণা ও অনুমান পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘তুলনামূলক-কালানুক্রমিক’ ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। জোনস-এর উপরি-উক্ত মন্তব্যের যথার্থতা নিরূপণের জন্যে ইউরোপের বিভিন্ন কেন্দ্রে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার জোয়ার আসে এবং ‘ভাষাতত্ত্ব’ একটি বিশিষ্ট শাস্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ইউলিয়ম জোনস-এর ভাষণ থেকে আধুনিক ভাষাতত্ত্বের সূত্রপাত বলেও অনেকে মনে করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিশিষ্ট শাস্ত্র হিসেবে ভাষাতত্ত্বের উদ্ভবে জার্মান পণ্ডিত ফ্রেডরিক ফন শ্লেগেল রচিত উইবার দি ¯প্রাখ অ্যান্ড ইউশিট দার ইন্ডিয়ের (১৯০৮ খ্রি.) গ্রন্থটি পথিকৃত। তিনি বেশ কিছু সংস্কৃত শব্দ তালিকাবদ্ধ করেন যা অবিকল লাতিন ও গ্রিক ভাষায় পাওয়া যায়। এ-সাদৃশ্যকে তিনি আকস্মিক বা কৃতঋণজাত বলে মনে করেননি বরং সংস্কৃত ও ইউরোপীয় ভাষার মিলের কারণ ভাষাসমূহের উদ্ভব-ইতিহাসের মধ্যে নির্দেশ করেছেন। তিনি ভাষার শ্রেণীবিন্যাস করারও চেষ্টা করেছিলেন। পৃথিবীর সমস্ত ভাষাকে তিনি দুই শ্রেণিতে ফেলেছিলেন; প্রথম শ্রেণিতে সংস্কৃত এবং সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত ভাষাসমূহ আর বাকী সব ভাষা দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত।
প্রথম শ্রেণীর ভাষাসমূহে ধাতুর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন লক্ষ্য করে এর জৈবিক বা আঙ্গিক বিকরণের জন্যে এর নামকরণ করে ‘ফ্লেকশান’। অপরদিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর ভাষায় পরিবর্তন বাহ্যিক হওয়ার ফলে অজৈবিক। শ্লেগেলই প্রথম পৃথিবীর ভাষাসমূহের ব্যাকরণিক শ্রেণিবিন্যাসের প্রচেষ্টা চালান, ফলে ‘অর্গানিক’ ও ‘এ্যাফিক্স’ এই শ্রেণীবিন্যাস চালু হয়। ভাষা শ্রেণীবিন্যাসের তৃতীয় রূপটিরও সূত্রপাত ঘটে; তাঁর পর্যলোচনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে চীনা ভাষা ‘অ্যাফিক্স’ শাখা বহির্ভূত একটি স্বতন্ত্র শ্রেণীর অন্তর্গত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তিনজন মহাপণ্ডিত বপ, রাস্ক ও গ্রিম তাঁদের অমিত প্রতিভার দ্বারা ভাষাতত্ত্ব শাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেন। বপ্-এর কনজুগেশান-সিসটেম ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে রাস্ক-এর উন্ডারসোগেলস ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে, গ্রিম-এর গ্রামাতিক্ ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ ফ্রঞ্জ বপ্ (১৭৯১-১৮৬৭) তুলনামূলক ব্যাকরণের প্রতিষ্ঠাতা বলে খ্যাত। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর উপরোল্লিখিত গ্রন্থে সংস্কৃত ও অপর কয়েকটি ভাষার তুলনামূলক পর্যালোচনা ভাষাতত্ত্বের প্রসারে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলে স্বীকৃত। বপই প্রথম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের পরস্পরিক সম্পর্কে নির্ণয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। প্রায় একই সময়ে ডেনিশ পণ্ডিত র‌্যাসমাস ক্রিশ্চিয়ান রাস্ক (১৭৮৭-১৮৩২) স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে তাঁর গ্রন্থে গ্রিক ও লাতিন ভাষার তুলনামূলক পর্যালোচনা করেন। পৃথিবীর ভাষাসমূহের বংশানুক্রমিক শ্রেণীবিন্যাস তিনিই প্রথম করেছিলেন। তাঁর শ্রেনীবিন্যাস ছিলো এইরূপ: ভারতীয় (হিন্দুস্তানি ও দক্ষিণ), ইরানিক (ফার্সি আরমেনিয়ান, ওসেটিক), থ্রেশিয়ান (গ্রিক ও লাতিন) সার্মাশিয়ান (লেটিক ও শ্লাভোনিক), গথিক (জার্মানিক ও স্কান্ডেনেভিয়ান), কেল্টিক (ব্রিটানিকা ও গোলিক)। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে চালুকৃত তাঁর এই শ্রেণিবিন্যাস বহুদিন প্রচলিত ছিলো। জ্যাকব গ্রিম (১৭৮৫-১৮৬৩) তাঁর গ্রন্থে গথিক,জার্মান, ডাচ, ইংরেজি, ফ্রিশিয়ান ও স্কান্ডেনেভী ভাষাসমূহের অর্থাৎ জার্মানিক ভাষাগোষ্ঠীর ব্যাকরণ বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে ইতিহাসমূলক বা কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্বের জনক বলে অভিহিত হন। ভাষা বিশ্লেষণ পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিলো [ গ্রিম (১৮২২, মুখবন্ধ)] : আমি ব্যাকরণের সর্বজনীন তত্ত্বের বিরোধী, কেননা তা সংজ্ঞাকে সুন্দর করলেও ভাষার পর্যবেক্ষণে বাধার সৃষ্টি করে। আমি মনে করি পর্যবেক্ষণ হচ্ছে ভাষাবিজ্ঞানের আত্মা..কারণ আমার অনুসন্ধনের সূত্রপাত সময় ও স্থানের পার্থক্য পরিবর্তমান ভাষার সেই চিরন্তন উপাদানের সন্ধান, সে জন্যেই আমি একের পর এক উপভাষার স্বীকৃতি দিয়েছি। এমনকি আমাদের ভাষার সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত বিদেশি ভাষাসমূহের দিকে আমি দৃষ্টিপাতও করতে পারিনি। ভাষা যে ক্রমপরিবর্তমান এবং বিবর্তনশীল জ্যাকব গ্রিমের মন্তব্য থেকে সে-ধারণা স্পষ্ট হয়। গ্রিম তাঁর পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত গ্রামাতিক-এর দ্বিতীয় বা নব সংস্করণে প্রথম ফোনোলজি বা ধ্বনিতত্ত্ব-এর কথা উল্লেখ করেন। একই সংস্করণে গ্রিম তাঁর সুবিখ্যাত ও ঐতিহাসিক ‘সাইন্ড শিফট’ বা ধ্বনি-পরিবর্তন তত্ত্বের উত্থাপন করেছিলেন, ম্যাক্সমুলার যার নামকরণ করেছিলেন ‘গ্রিমের সূত্র’। যদিও এর নাম হওয়া উচিত ছিলো ‘রাস্কের সূত্র’; কারণ রাস্কই তাঁর গ্রন্থে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ধ্বনি পরিবর্তন প্রক্রিয়া প্রদর্শন করেছিলেন। রাস্ক অবশ্য ধ্বনি-পরিবর্তনের সমান্তরাল প্রক্রিয়া লক্ষ করলেও গ্রিমের মতো সমস্ত পরিবর্তনকে একটি সূত্রাকারে বর্ণনা করার চেষ্টা করেননি; তাই ধ্বনি-পরিবর্তন সূত্র উদ্ভাবনের কৃতিত্ব একভাবে গ্রিম পেয়ে গেছেন। গ্রিম অসংখ্য উদাহরণের সাহায্যে ধ্বনি পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে একটি সূত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। সংক্ষেপে গ্রিমির সূত্র ছিলো ‘ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষার বর্গের চতুর্থ তৃতীয় ও প্রথম ধ্বনি জার্মান শাখায় যথাক্রমে তৃতীয়, প্রথম ও দ্বিতীয় ধ্বনিতে পরিণত হয়। পরবর্তী কালে হেরম্যান গ্রাসম্যান নামক একজন পণ্ডিত গ্রিমের সূত্রের ব্যতিক্রম নির্দেশ করে লিখেছিলেন, ‘ইন্দো-ইউরোপীয় মূলভাষার বর্গের মহাপ্রাণ ধ্বনি প্রাচীন গ্রিক ও সংস্কৃতে স্বল্পপ্রাণ ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে এবং মূলভাষার কোনো শব্দে পাশাপাশি দুটি সিলেবল-এ বর্গের চতুর্থ ধ্বনি থাকলে শাখা ভাষার তাদের মধ্যে একটি বর্গের তৃতীয় ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়েছে। অপর একজন পণ্ডিত কার্ল ভার্নারও গ্রিমের সূত্রের কিছু ব্যতিক্রম নির্দেশ করেছিলেন; তিনি ধ্বনি পরিবর্তনে স্বরাঘাতের প্রভাব লক্ষ করে লিখেছিলেন, ‘ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষায় শব্দে অব্যবহিত পূর্ববর্তী সিলেবল্-এ স্বরাঘাত না থাকলে বর্গের প্রথম ধ্বনি জার্মানিক শাখায় বর্গের দ্বিতীয় ধ্বনি না হয়ে তৃতীয় ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ পূর্ববর্তী সিলেবলে স্বরাঘাত থাকলে গ্রিমের সূত্রানুযায়ী ইন্দে-ইউরোপীয় মূল ভাষার বর্গের প্রথম দ্বিতীয় ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে, কিন্তু যদি স্বরাঘাত পরবর্তী সিলেবলে পড়ে, তা হলে ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষার বর্গের প্রথম ধ্বনি যথাক্রমে উচ্চ জার্মান ভাষায় বর্গের তৃতীয় ধ্বনিতে পরিণত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছিলো, সংস্কৃত ভাষা থেকেই গ্রিক, লাতিন এবং অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার উদ্ভব। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের উদ্ভব-ইতিহাস সম্পর্কে তুলনামূলক-কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্বের প্রথম যুগের সেই ধারণাকে খণ্ডন করেছিলেন ফ্্রাঞ্জ বপ্। তিনি লিখেছিলেন [দ্র: বপ (১৮২০)] আমি মনে করি না যে ভারতীয় গ্রন্থসমূহে সংস্কৃত ভাষার যে রূপ পাওয়া যায়, তা থেকে গ্রিক, লাতিন এবং অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার উদ্ভব হয়েছে; বরং আমার ধারণা যে সংস্কৃত এবং ওই সমস্ত ভাষা প্রকটি আদি ভাষার বিবর্তিত ও পরবর্তী রূপ, অবশ্য সেই আদি ভাষার রূপ অন্যান্য সম্পর্কিত ভাষার চেয়ে সংস্কৃতেই অধিকতর অবিকৃত রূপ রক্ষিত।
বপ্ ‘কনজুগেশান-সিসটেম’-এর উপরোক্ত পরিবর্তিত, পরিবধিত ইংরেজি সংস্করণে ইন্দো-ইউরোপীয় মূলভাষার বিবর্তনে সংস্কৃত, লাতিন ও গ্রিক ভাষার যে স্থান নির্দেশ করেন পরবর্তী গবেষণায় সে-ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি সংস্কৃত,গ্রিক ভাষার তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যাাকরণের সাদৃশ্যযুক্ত প্রাচীন রূপগুলোর উদ্ভব আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলেন এবং ঐ ভাষাগুলোর সাদৃশ্য থেকে তাদের বিলুপ্তপূর্ব বা প্রত্নরূপের বা ইন্দো- ইউরোপীয় মূলভাষার পুনর্গঠনে ব্রতী হয়েছিলেন।
ভাষার শ্রেণিবিন্যাস বপ্ পৃথিবীর ভাষাগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেছিলেন। প্রথম শ্রেণী- যে সব ভাষার শব্দ গঠনে ধাতু এবং প্রত্যয় বিভক্তি সংযোজন ব্যবস্থা নেই, চীনা ভাষা এই শ্রেণিভূক্ত। দ্বিতীয় শ্রেণি-একাক্ষরিত ধাতু সম্বলিত ভাষাসমূহ; যে- শ্রেণীর ভাষায় শব্দ গঠনের রীতি হলো ক্রিয়া এবং প্রত্যয় বিভক্তি সংযোজন ব্যবস্থা সেই, চীনা ভাষা এই শ্রেণিভুক্ত। দ্বিতীয় শ্রেণি-একাক্ষরিক ধাতু সম্বলিত ভাষাসমূহ; যে- শ্রেণির ভাষায় শব্দ গঠনের রীতি হলো ক্রিয়া এবং বিশেষ্যের ধাতুর সম্পর্ক। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহ এই শ্রেণিভুক্ত। তৃতীয় শ্রেণী- দ্ব্যক্ষরিক ধাতু এবং ত্রিব্যঞ্জন সম্বলিত শব্দ-সেমেটিক ভাষাসমূহ এই শ্রেণীর। এ শ্রেণীর ভাষার ব্রাকরণিক রূপসমূহ দ্বিতীয় শ্রেনীর ভাষার মতো কেবল সংযোজন পদ্ধতিতে নয় সঙ্গে সঙ্গে ধাতুর অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের মাধ্যমে গঠিত। বপ্ রাস্ক এবং গ্রিম ছাড়া জর্জ কুর্টিয়াস (১৮২০-১৮৮৫)এবং ফ্রেডরিক পট (১৮০২-১৮৮৭) তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে অবদান রেখেছেন। কুটিয়াস ভাষার পুরাতত্ত্ব অধ্যয়নে তুলনামূলক পদ্ধতির প্রয়োগ করেন আর পট মূলত শব্দের ব্যুপত্তি অনুসন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন। তিনি মনে করতেন শব্দের আদিরূপ বা অর্থের জন্যে নয় বরং ভাষার প্রাচীন রূপ খোঁজার জন্যেই ব্যুৎপত্তির প্রয়োজন।
জার্মান ভাষাবিদ আগস্ট শ্লেইশার (১৮৩১) প্রাণীর বিবর্তন সম্পর্কিত ডারউইনতত্ত্ব ভাষাতত্ত্বে প্রয়োগ করার প্রয়াসী হন। ভাষার বিকাশ ও বিবর্তনে বিশেষত ইন্দো-ইউরোপীয় মূলভাষার পুনর্গঠনে তিনি উৎসাহী ছিলেন। তাঁর ধারণায় ভাষা একটি জীবন্ত অঙ্গ এবং তা মানব নিরপেক্ষ; তাঁর মতে ভাষার বিকাশ নির্ভরশীল বিবর্তনের সাধারণ নিয়মের ওপরেই। একটি ভাষার জন্ম বা সৃষ্টি হয় তা একটি নির্দিষ্ট সময়ে জীবন্ত থাকে, তার থেকে অন্য ভাষার সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তী হয় এবং পরবর্তী ভাষা পূর্ববর্তী ভাষার স্থান গ্রহণ করে। এই নিয়মেই ভাষার উত্তরাধিকার সৃষ্টি হয়, সুতরাং ভাষারও মানুষের মতো বংশপরস্পরা আছে, মানুষের মতোই আছে পূর্বপুরুষ এবং উত্তরসূরী। শ্লেইশারের ধারণায় ভাষা ধ্বনিতে সমর্পিত মানব চিন্তা, ভাষা ব্যতিরেকে চিন্তা বা চিন্তা ব্যতিরেকে ভাষা সম্ভবপর নয়। শব্দের অর্থ তার ধাতুতে নিবদ্ধ যা আবিস্কার করা যায়। প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের মতো ভাষারও স্বাভাবিক অঙ্গ এবং রূপ রয়েছে। শ্লেইশার তিন প্রকারের মৌলিক ভাষা-শ্রেনীর কথা বলাছেন। প্রথম শ্রেণী যেখানে শব্দের ক্রম এবং অবস্থানের ওপর ভাষার ব্যাকরণিক সম্পর্কে এবং পদক্রমিক কার্যক্রম নির্ভরশীল যেমন-চীন ভাষা। দ্বিতীয় শ্রেণী যেখানে ব্যাকরণিক সম্পর্ক বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিক উপাদান দ্বারা নির্দেশিত; ওই সব উপাদানে এক একটি শব্দ গঠিত যার প্রতিটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট অর্থ বা তাৎপর্যমণ্ডিত, যেমন-হাঙ্গোরিয় ভাষা। তৃতীয় শ্রেণী যেখানে শব্দ গঠনকারী ধাতু ছাড়াও ধাতুর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য ভাষাতাত্ত্বিক উপাদানের দ্বারা ব্যাকরণিক অর্থ নিয়ন্ত্রিত। শ্লেইশার মনে করতেন স্কটিক, উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সঙ্গে ভাষার ঐ তিনটি শ্রেণী সরাসরিভাবে সমান্তরাল। তিনি এই তিনটি ভাষা-শ্রেণির নাম করেছিলেন যথাক্রমে- আইসোলেটিং, এবং ফ্লেকশনাল। শ্লেইশারের মতে, একই কালে একই সঙ্গে মানুষের মুখে ঐ তিন শ্রেণীর ভাষা থাকে না, তারা ভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তনের তিনটি স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে; ফলে ‘ফ্লেকশনাল’ স্তরের পরে আর ভাষা অপর কোনো স্তরে উন্নীত হতে পারে না। অবশ্য তিনি এ কথা বলতে পারেন নি যে, কোনো একটি ভাষা ‘ আইসোলাটিং’ এবং ‘এ্যাগলুটিনেটিং’ স্তর পার হয়ে কালক্রমে ‘ফ্লেকশনাল’ হযেছে।
শ্লেইশারের উপরোক্ত ‘বংশপরম্পরা-তত্ত্ব সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন, তাঁরই শিষ্য জোহানেস স্মিট। তাঁর মতে কোনো নতুন ভাষার সৃষ্টি বা ভাষাতাত্ত্বিক আগম একটি নির্দিষ্ট বাক্পরিমণ্ডলে ঘটে থাকে এবং তা অন্যত্র শাখা-প্রশাখায় বিস্তারিত হয় না। ভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তন অনেকটা তরঙ্গের মতো ঘটে থাকে, কোনো ভাষাতাত্ত্বিক আগম বা উদ্ভবের দ্বারা কোনো ছোট বা বড় ভাষা সম্প্রদায়ের প্রভাবিত হওয়া একটি সম্ভাবনার ব্যাপার। অনেক সময় এমনও দেখা গেছে যে, একটি ভাষা সম্প্রদায়ের মধ্যে হয়তো কোনো ভাষাতাত্ত্বিক আগম বা উদ্ভব ঘটেছে অথচ তার পাশ্ববর্তী ভাষা সম্প্রদায়কে তা স্পর্শ করেনি। স্মিট্ তাঁর মতামতের সমর্থনে কতগুলো ‘আইসোপ্লোস’বা সমশব্দরেখার ভিত্তিতে একদিকে জার্মানিক ও বালতোস্লাভিক এবং অপরদিকে গ্রিক ও সংস্কৃত কিভাবে একই ভাষাবংশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার উল্লেখ করেছেন। উভয় ক্ষেত্রেই অবশ্য স্মিট নির্দেশিত সমশব্দরেখাগুলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার প্রাথমিক বিভাগ শতম-কেন্তুমের পার্থক্য সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যের সীমাকে অতিক্রম করে যায়। শ্লেইশারের মতামতকে কিছুটা সংশোধিত আকারে গ্রহণ করেন ম্যাক্সমুলার (১৮২৩-১৯০০)। তাঁর মতে, ভাষা কোনো ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া নয়, বরং প্রকৃতির অন্যান্য বিষয়ের মতো একটি স্বত:স্কূর্ত ব্যাপার। তিনি ভাষার সঙ্গে চিন্তার সম্পর্ক স্বীকার করেন। ম্যাক্সমুলারের দৃষ্টিতে ভাষা মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়ার প্রত্যক্ষ রূপ। তিনি অবশ্য শ্লেইশারের মতো ভাষাকে একটি স্বাধীন ও জীবন্ত অঙ্গ বলে মনে করেননি; বরং ভাষা মানুষের বাক্-প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত বলে বিশ্বাস বলে বিশ্বাস করতেন, তবে যেহেতু একবার যা উচ্চারণ করা হয় তবে আর পুনরুক্তি সম্ভবপর নয় সেহেতু ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই বাক্- প্রক্রিয়ার আবসান ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাতত্ত্ববিদ জার্মানির উইলহেল্ম ভন হামবোল্ট (১৭৬৭-১৮৩৫)। তাঁক সাধরণ ভাষাতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা বলেও কেউ কেউ মনে করেন। হামবোল্ট উদ্ভব ও বিবর্তন অর্থাৎ কালানুক্রমিক বা ঐতিহাসিক পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেননি, তিনি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে উৎকীর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক উপাদান ভিত্তি করে তার পর্যালোচনা করেছেন। বিভিন্ন ভাষার তুলনামূলক বিশ্লেষণে তিনি তাদের বংশগত সম্পর্কের দিকে দৃষ্টি দেননি, হামবোল্ট প্রাচীন ব্যাকরণের অনুকরণে বিশ্বজনীন রচনার বিরোধী ছিলেন; তিনি প্রত্যেকটি ভাষার সংগঠন বিশ্লেষণ করে ব্যাকরণের সূত্র রচনার পক্ষপাতি ছিলেন; ভাষাকে তিনি একটি গতিশীল ব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন। যদিও তার স্থবির দিকটাই কেবল দৃশ্যমান। তিনিও ভাষার সঙ্গে চিন্তার সম্পর্কে গুরুত্বদান এবং বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে ধ্বনি ও বাক্-এর সাযুজ্যের কথা বলেছেন। তাঁর মতে চিন্তা ও ধ্বনির অনুষঙ্গ ছাড়া ভাবনার জগৎ কিছুতেই বস্তুর জগতে রূপান্তরিত হতে পারেনা। ভাষা সম্পর্কে হামবোল্ট-এর ধারণা তাঁর উদ্ভাবিত ভাষার ‘অভ্যন্তরীণ রূপ’ তত্ত্বের সঙ্গে জড়িত।
ভাষার অভ্যন্তরীণ রূপ বলতে তিনি ভাষাভাষীর মনস্তাত্ত্বিক সংগঠনকে বুঝেছেন, বুঝেছেন, যে সংগঠনের সঙ্গে ভাষার ধ্বনি ও অর্থ সংগঠন সম্পর্কিত। হোমবোল্ট-এর তত্ত্বে কেন্দ্রীয় বিষয় হলো ভাষা সংগঠন ও জাতীয় মানসের সম্পর্ক; তাঁর মতে ভাষা হচ্ছে একটি জাতিয় চেতনার অভিব্যক্তি, অভ্যন্তরীণ রূপের বাহ্যক প্রকাশ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ঐ জাতির ধারণার প্রকাশ রূপ। একটি ভাষার বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর ওই জাতির মানস সংস্কৃতি ও সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সুতরাং ভাষা ও জাতীয় ইতিহাস অচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। হামবোল্ট তাঁর তত্ত্বের সমর্থনে এই যুক্তি দেনযে, ভাষা জাতিয় চেতনার অভিব্যক্তি বলেই একটি ভাষাসম্প্রদায় বা জাতি অপর একটি সম্প্রদায় বা জাতিকে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারেনা, জগৎ সম্পর্কে তাদের ধারণা এক প্রকার নয়। হামবোল্ট তাঁর ঐ তত্ত্ব ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই ‘বার্লিন একাডেমি অব সায়েন্স’-এ প্রদত্ত ভাষণে উত্থাপন করেছিলেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘উয়েবার দি কাউসপ্রাখ অউফ দ্য ইনজেল যাওয়া’ প্রন্থে ভাষাকে একটি চলমান প্রক্রিয়া বলে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে জড় পদার্থ বা সমাপ্ত কর্ম নয়, বরং জীবন্ত প্রবাহ। প্রত্যেকটি ভাষার এমনকি অবহেলিত উপভাষারও একটি সামগ্রিক সংগঠন রয়েছে, যা আর সব ভাষা থেকে স্বতন্ত্র। একটি সামগ্রিক সংগঠন রয়েছে, যা আর সব ভাষা থেকে স্বতন্ত্র। একটি ভাষা ওই ভাষাভাষীর ব্যক্তিত্বের প্রকাশক, একটি জাতির মানস প্রতিফলন, ভাষা জাতীয় চরিত্রের প্রতীক। ভাষার শ্রেণীকরণে হামবোল্ট অনবরত ‘বিশ্লিষ্ট’ বা সংশ্লেষগত শ্রেণীর সঙ্গে ‘ইনকরপোরোটিভ’ বা ‘সাধিত’ শ্রেণীর কথা বলেছেন। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান ভাষাসমূহকে তিনি তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁর মতে প্রত্যেক ভাষার মধ্যেই ওই শ্রেণীসমূহের এক বা একাধিক উপাদান বর্তমান। তিনি মনে করতেন সংস্কৃত ও চীনা ভাষা ভাষাতাত্ত্বিক সংগঠনের দুই বিপরীত কোটিতে অবস্থিত এবং উভয় ভাষাই আপন শ্রেণীতে পূর্ণাঙ্গ।
জার্মানিতে এইচ স্টেইনথেল (১৮২৩-১৮৯৯) মনস্তাত্ত্বিক ভাষাতত্ত্বের উদগাতা। তিনি হার্বাট-এর ‘মানব চেতনার আনুষঙ্গিক সংগঠন’ তত্ত্বের আদলে ভাষার ক্ষেত্রেও অবচেতনার সাদৃশ্য বাহ্যিক ধারণায় মস্তিষ্কে একের পর এক চিন্তা বা ভাব স্বতস্ফূর্তভাবে উদ্রিক্ত হতে থাকে সে কথা বলেছেন। স্টেইনথেল ও ল্যাক্তারাস যুগ্নভাবে ভাষা ও জাতীয় চেতনা বা মনন্তত্ত্বের পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব নির্দেশ করেন। জাতীয় সংস্কৃতির তত্ত্বে উৎসাহী জার্মান চিন্তাবিদদের মধ্যে এ সময়ে ‘ফোকারসাইকলজি’ কথাটি খুব চালু হয়ে পড়ে। স্টেইনথেল বিশ্বাস করতেন, ভাষা যেমন মানব চেতনার বহিঃপ্রকাশের বাহন, তেমনি একটি সম্প্রদায় বা জাতির মিলিত চেতনা বা মানসেরও প্রকাশ; আবার ভাষা একজন মানুষের ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্বের প্রকাশও বটে। তাঁর মতে, শব্দের অর্থ বিচ্ছিন্নভাবে নির্দিষ্ট নয়, কোনো ব্যক্তি যখন শব্দ উচ্চারণ করে তখন তা তাঁর ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার ব্যক্তি-চেতনার বা মনস্তত্ত্বের আলোকেই করে; শব্দের প্রকৃত অর্থ তখনই কেবল নির্ণীত হয় যখন তা ব্যবহৃত হয়। স্টেইনথেলের ভাষা সম্পর্কিত তত্ত্বেই সর্বপ্রথম ‘জাতীয় মানস’ বা ‘জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি’র প্রতি আলোকপাত করা হয়। তিনি তাঁর ভাষা অনুসন্ধান ভাষার ইতিহাস প্রণয়ন ছাড়াও বিভিন্ন ভাষার উদ্ভব ও সংগঠনের মধ্যে যে সাদৃশ্য বা পার্থক্য রয়েছে, তাতে সম্প্রসারিত করেছেন। জার্মানিতে ‘এক্সপেরিমেন্টাল সাইকলজি ল্যাবরেটরি’র প্রতিষ্ঠাতা উইলহেলম উন্ড (১৮৩২-১৯২০) স্টেইনথলের মতো জাতীয় মনস্তত্ত্ব বিষয়েও উৎসাহী, ছিলেন, তিনি এই ধরনের সমর্থক ছিলেন যে, মানুষের মস্তিস্ক বোধের সাহায্য বাহ্যিক পৃথিবী থেকে ধারণা সংগ্রহ করে এবং তা অভিব্যক্ত হয় ভাষার সাহায্য তিনি মনে করতেন, একটি বিশেষ ভাষা সংপ্রদায়ের মনস্তত্ত্ব বা মানস তাদের যৌথ জীবনপ্রণালি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং ঐ মনস্তত্ত্বের অনুসন্ধান জীবনের বিভিন্ন অভিব্যক্তি যেমন- ভাষা, আচার, আদর্শ বা সমগ্র সংস্কৃতিকে ভিত্তি করেই করা উচিত। উন্ড-এর সমসাময়িক ‘নিউগ্রামারিয়ান’ বা ‘নববৈয়াকরণেরা’ ভাষার প্রতি মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির তাৎপর্য স্বীকার করতেন না। (অসমাপ্ত)