দেড় থেকে দু’মাসের মধ্যে করোনার নতুন ঢেউয়ের শঙ্কা ॥ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ

15

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশ্বজুড়ে নতুন করে উত্তাপ ছড়াচ্ছে করোনা। ঈদুল ফিতরের আগে বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষের চলাচলে ডেল্টা ধরনের মতো করোনার নতুন ধরন আগামী দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে নতুন ঢেউয়ের শঙ্কা জাগাচ্ছে। ইতোমধ্যে নাড়ির টানে প্রতিদিন রাজধানী ছাড়ছে মানুষ। তারা ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধিও মানছেন না। করোনা পরিস্থিতি সহনীয় হয়ে আসায় মাস্ক পরায় অনীহা এবং গণপরিবহনে অতিরিক্ত মানুষের চাপ করোনার সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে করোনা প্রতিরোধে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, করোনা আক্রান্ত হলে গুরুতর সমস্যা আপাতত সৃষ্টি না হলেও দীর্ঘমেয়াদে রোগে ভোগার লক্ষণ থেকে যাচ্ছে। নতুন ঢেউ রুখতে অবশ্যই মানুষকে সচেতন হতে হবে।
চীনের সাংহাই, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়াতে নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে করোনা। এছাড়া ভারতে শনাক্ত করোনার নতুন ধরন নিয়েও রয়েছে নানা উদ্বেগ। করোনা প্রতিরোধী টিকা নতুন ধরনটির বিরুদ্ধে কাজ না করলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নতুন করে চ্যালেঞ্জে আসবে। তবে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের করোনা টিকার দ্বিতীয় ডোজ এবং গুরুতরদের বুস্টার ডোজ সম্পন্ন করায় ঝুঁকি কমেছে। ঈদ সামনে চলে আসায় মানুষের ভিড়ে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে পারে। ভারতের সঙ্গে সবকটি সীমান্ত খুলে দেয়ায় নতুন ধরনটি বাংলাদেশেও ছড়ানোর আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আপাতত করোনা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মাস্ক পরাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ডাঃ মুসতাক হোসেন বলেন, করোনা এমন একটি ভাইরাস যা একেবারে নির্মূল হচ্ছে না। প্রতি তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে করোনার নতুন ধরনের রূপান্তর হচ্ছে। আর নতুন ধরন যদি নাও আসে তবে পুরনো ধরনেই টিকা নেয়া অথবা আগে সংক্রমিত হওয়া ব্যক্তি পুনরায় আক্রান্ত হচ্ছেন। কারণ মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তিন মাসের বেশি টিকছে না। তবে টিকা নেয়া থাকলে রোগীর গুরুতর ক্ষতির আশঙ্কা কম থাকছে। তবে করোনায় আক্রান্ত হলে সুস্থ ব্যক্তিরও পরবর্তীতে ঘুম কম হওয়া, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্তসহ নানা জটিলতা বাড়ছে। তাই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে করোনায় আক্রান্ত হওয়া উচিত নয়।
সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দেশে করোনা প্রতিরোধে বিধিনিষেধ উঠে যাওয়া এবং ঈদ উপলক্ষে কোটি কোটি মানুষের অবাধ চলাচল বাড়বে। তাই স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পালন না করলে আগামী দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে করোনার নতুন ঢেউ আসতে পারে।
ভারতের মুম্বাইতে সম্প্রতি ভাইরাসটির নতুন ধরন এক্সই এবং কাপা’র একটি করে কেস পাওয়া গেছে। এটি সেখানে এক্সই ধরনের প্রথম কেস। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের সময় মোট ৩৭৬টি নমুনা নেয়া হয়েছিল, এর মধ্যে ২৩০টি ছিল মুম্বাইয়ের। এটি ছিল জিনোম সিকোয়েন্সিং ট্রায়ালের ১১তম ব্যাচ। ২৩০টি নমুনার ২২৮টি নেয়া হয় ওমিক্রন থেকে, বাকি দুটি এক্সই ও কাপা ধরনের।
করোনার একটি নতুন রূপান্তরিত ধরন হচ্ছে এক্সই, যা ওমিক্রনের উপ-ধরন বিএ.২ থেকে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি সংক্রামক হতে পারে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। এক্সই হলো ওমিক্রনের দুটি উপরেখা বিএন.১ এবং বিএ.২ এর একটি পুনঃসংযোজক স্ট্রেন। স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যতক্ষণ না এর সংক্রমণ হার এবং রোগের আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি ওমিক্রন ধরনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এর আগে এক্সই স্ট্রেন প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯ জানুয়ারি, যুক্তরাজ্যে। এরপর ৬০০টিরও বেশি কেস নিশ্চিত করা হয়েছে।
ব্রিটেনের হেলথ প্রোটেকশন এজেন্সির প্রধান চিকিৎসা উপদেষ্টা সুজান হপকিন্স বলেছেন, এই সংক্রামক ধরনের বিরুদ্ধে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে উপসংহার টানতে এখনও যথেষ্ট প্রমাণ নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, তারা এক্সই’র মতো রিকম্বিনেন্ট ধরন থেকে হওয়া বিপদের ওপর ক্রমাগত নজর রাখছে। এই সম্পর্কিত প্রমাণ সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে আপডেট করা হবে। এক্সই ছাড়াও আরেকটি রিকম্বিনেন্ট ধরন এক্সডির দিকে নজর রাখছে স্বাস্থ্য সংস্থা, যা ডেল্টা এবং ওমিক্রনের একটি হাইব্রিড। ফ্রান্স, ডেনমার্ক এবং বেলজিয়ামে এটি পাওয়া গেছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২,৩৮০ জন। বুধবার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২,০৬৭ জন। মৃতের সংখ্যাতেও বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে। ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে নতুন বিধিনিষেধ আসছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড বুলেটিন অনুযায়ী বৃহস্পতিবার করোনা আক্রান্ত হয়ে দেশে ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কেরলে ৫৩ জন এবং দিল্লী, ওড়িশা ও মিজোরামে এক জন করে আক্রান্তের মৃত্যু হয়েছে। এক দিন আগে, অর্থাৎ বুধবার কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ৪০ জনের। নয়াদিল্লীর অবস্থা বেশ খারাপ। গত ২৪ ঘণ্টায় দিল্লীতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। নতুন করে ১,০৯৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার দেশের দৈনিক সংক্রমণের হার বেড়ে হল ০.৩১ শতাংশ।
ভারতের করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য নতুন করে আশঙ্কার কারণ আছে কিনা জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ এ্যান্ড হোপ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ লেনিন চৌধুরী বলেন, ভারতের নতুন করোনা সংক্রমণ নিয়ে তাদের বিশেষজ্ঞরাও দ্বিধাবিভক্ত। একটি পক্ষ মনে করছে, তাদের টিকাদানের হার বেশি থাকায় খুব বেশি বাড়বে না নতুন সংক্রমণটি। তবে নতুন একটি দল মনে করছে, আগামী জুন নাগাদ ভারতে নতুন ঢেউ আসতে পারে। এজন্য তারা জিনোম সিকোয়েন্স অব্যাহত রাখছে। সেখানে আরও নতুন ধরন আসছে কিনা সেটি দেখছে। মূলত ভারতে সাতটি রাজ্যে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে। তবে পশ্চিমবঙ্গে রোগী শনাক্তের হার ও মৃত্যু দুটোই কম।
লেনিন চৌধুরী আরও বলেন, ভারতে করোনা নতুন করে বাড়লেও ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন, ৭৮ শতাংশ মানুষ একডোজ টিকা নিয়েছেন আর ৭ শতাংশ মানুষ বুস্টার ডোজ নিয়েছেন। সেই কারণে আমরা বলতে পারি টিকা দেয়ার কারণে মানুষের মধ্যে যে সুরক্ষার হার তৈরি হয়েছে সেটি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অভিমত দিয়েছেন যে, এখন পর্যন্ত তারা নিশ্চিত যে করোনার বিরুদ্ধে বর্তমানের টিকা কাজ করছে। অতএব করোনার নতুন কোন টিকা প্রতিরোধী ধরন যদি তৈরি না হয়, তবে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি বাংলাদেশে করোনার নতুন ঢেউ তৈরি সম্ভাবনা নেই।