নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বাম দলে মতবিরোধ ॥ কারও দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আবার কেউ বলছেন বিষয়টি মীমাংসিত

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের বাম দলগুলোর নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। নির্বাচনের সময় সরকারের অধীনে নির্বাচন না তদারকি সরকার তা নিয়ে বাম দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট নির্বাচনকালীন তদারকি সরকার চায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ সমমনা দলগুলো তদারকি সরকারের পক্ষে নয় তাদের স্পষ্ট কথা সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাদের বক্তব্য বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। বিভিন্ন দেশের আলোকে এবং গত নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বিধায় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এখন তদারকি বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি মীমাংসা হয়ে গেছে। এটি একটি ক্লোজড ইস্যু।
বাম গণতান্ত্রিক জোট নির্বাচনের আগে নির্বাচনী আইন সংস্কার, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোসহ বেশ কিছু দাবি জানিয়েছে। তারা বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। সে জন্য নির্বাচনটা হতে হবে তদারকি সরকারের অধীনে। নির্বাচনকালীন একটা নিরপেক্ষ তদারকি সরকার হবে। তারাই দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। সেই দাবি আদায়ের জন্য বাম দল একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। আন্দোলনের মাধ্যমেই এ দাবি আদায় করা হবে। নির্বাচনের পরিবেশ থাকলে তা হলে বাম দলগুলো বিকল্প শক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে। অন্যদিকে ১৪ দলের শরিকদল জাসদ ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মতে বাম গণতান্ত্রিক জোটের তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। গত নির্বাচন যেভাবে হয়েছে সেভাবেই এবারও সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সব ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের শেষে কিংবা ২০২৪ সালের শুরুতে হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনের অনেক সময় বাকি থাকলেও প্রস্তুতি শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে বামপন্থী দলগুলো, তা জানতে আলাপ হয় বাম নেতাদের সঙ্গে। তাদের বক্তব্যে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি দলগুলোর মনোভাব উঠে এসেছে। নেতৃবৃন্দের এক অংশের বক্তব্য, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। ’৯১ তে ভোটাধিকার আদায় করতে পারলেও তার পর নানা কারণে ভোটাধিকার লংঘিত হচ্ছে। দলীয় সরকারের অধীনেই ভোটাধিকার লংঘিত হচ্ছে। সে জন্য নির্বাচনকালে একটা তদারকি সরকার প্রয়োজন। বাম দলের অপর অংশ বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। কাজেই আগামী নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনেই হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বলেছেন, এটি মীমাংসিত ইস্যু। বহু আগেই এটা সমাপ্ত হয়ে গেছে। সংবিধানে তদারকি সরকারের বিধান নেই। তারা যদি আন্দোলন করে এই ইস্যুর সমাধান করতে পারে তাতে আপত্তির কি আছে। যদি আন্দোলন করে করুক।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, দেশের বাস্তবতায় প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। আমরা মনে করি দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই নির্বাচনকালীন তদারকি সরকার আমরা চাই। আমাদের প্রধান এজেন্ডা হবে এ ইস্যুতে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা। কিন্তু তার আগে জাতীয় সরকারের বিষয়টা নিয়ে আসা মানে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া। নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ বিশ্বাসযোগ্য বাংলাদেশে হবে না। সে জন্য মনে করি নির্বাচনকালীন একটা নিরপেক্ষ ও তদারকি সরকার হওয়া দরকার। নির্বাচনকালীন একটা নিরপেক্ষ তদারকি সরকার। এই দাবি তো এমনিতে আদায় হবে না। গণআন্দোলন গণসংগ্রামের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। সরকারকে রাজনৈতিকভাবে যদি পরাজিত করা না যায়, তা হলে ভোটের অধিকার বলি আর নির্বাচন বলি বাস্তবে কোন কিছু অর্জন হবে না। সে জন্য আমাদের প্রথম বিবেচনা এই লক্ষ্যে একটি গণআন্দোলন গণসংগ্রাম চালাতে হবে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তো সরকার পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন তদারকি সরকার তারপরে নির্বাচনের প্রশ্ন। দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে আমরা মনে করি না।
আন্দোলনের প্রাথমিক বিষয়গুলো নিয়েই মূলত কাজ করছি। গত নির্বাচনে বামজোট অংশগ্রহণ করেছে। ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হলে তখন আমরা জোটগতভাবে করব বা বৃহত্তর কোন জোটের সুযোগ আছে কিনা সেটা আরও ভবিষ্যতের প্রশ্ন। এখন বাম গণতান্ত্রিক জোট আছে। আমরা নির্বাচন করলে জোটগতভাবে করব।
তার পরে অন্যান্য প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা গড়ে উঠবে কিনা সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। আমাদের দাবি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ গ্রহণ যোগ্য তদারকি সরকার। সরকারটা কিভাবে হবে সেটা এখনও বলিনি। আমরা যদি নীতিগতভাবে এ রকম একটা সরকার গঠনের প্রশ্নে একমত হতে পারি, তখন এই সরকার কিভাবে গঠন হবে, তখন নিশ্চয়ই এটা নিয়ে আলোচনা করা হবে। আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল আরও কমপক্ষে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া উচিত। তার পরে সরকার সংসদে আইন করে সেটাকে বাতিল করে দিয়েছে। নির্বাচন কালীন যে তত্ত্বাবধায়ক বিধানটা বাতিল করে দিল। যে কোন সংবিধান মানুষের জন্য দেশের স্বার্থে। সুতরাং মানুষ যদি সে রকম একটা জায়গা তৈরি করতে পারে। তখন নিশ্চয়ই আমরা সরকারকে বাধ্য করতে পারব। আরেকটা হচ্ছে গত দুটি নির্বাচনতো এক অর্থে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং আগামী নির্বাচনও যদি একই অর্থে ব্যর্থ হয় এটা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের দুর্যোগ ডেকে আনবে বলে আমাদের আশঙ্কা। তাই আমরা মনে করি সরকারকে এই সব প্রশ্নে একটা রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়া দরকার। কিভাবে নেয়া দরকার কিভাবে নেবে এটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা করে কিভাবে এ ধরনের একটা সরকার গঠন করা যায় তা আলোচনা করতে হবে। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা দরকার। সরকার যদি সে পথে না হাঁটে তখন তো বিরোধী দলগুলোর সামনে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা ছাড়া কোন পথ খোলা থাকবে না।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আক্তার এমপি বলেছেন, তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রশ্নই আসে না। আমরা সরকারের সঙ্গে আছি। গত নির্বাচন যে ভাবে হয়েছে, এবারও সংবিধান সম্মতভাবে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন পুরো নির্বাচনটা পরিচালনা করবে। এবং সেটা করার জন্য প্রশাসন তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে সমস্ত নির্বাচন হয়েছে কখনও সকল পক্ষকে সন্তুষ্ট করা যায়নি। সবাই বলেছে কোন না কোন নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। ফলে এই কথা বলে সঙ্কট সমাধান হয় না। বরঞ্চ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে যেভাবে হয়, সেভাবেই নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে; নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী থাকবে। শিরদাড়া খাড়া করে থাকবে। প্রশাসন তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত থাকবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার নেই। ২০১৪ এবং ২০১৮ নির্বাচনে এটা আমরা দেখলাম। জনগণ ভোট দিতে পারেননি। এর আগেও বিভিন্ন সময় মানুষ ভোট দিতে পারেননি। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ’৯০’র দশকে ২৩ দিন পদযাত্রা করে ঢাকায় এসেছিল। একেবারেই পায়ে হেঁটে। তখন আমরা বলেছি আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব। এর পর ’৯১ তে আমরা ভোটাধিকার আদায় করতে পেরেছিলাম। তার পর নানা কারণে ভোটাধিকার লংঘিত হচ্ছে। সুতরাং আজকে আমাদের প্রধান দাবি হলো জনগণের ভোটাধিকার আদায় করা। নির্বাচন অভিজ্ঞতা বলে দলীয় সরকারের নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায়। নির্বাচনকালে একটা তদারকি সরকার প্রয়োজন। সেই দাবি আদায়ের জন্যই আমরা সংগ্রাম করছি।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেছেন, আমরা এখন নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। আমরা বলছি নির্বাচনের সংস্কারটা দরকার। নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের যে অনাস্থা সেটা দূর করা দরকার। নির্বাচনী আইনও সংস্কার করা দরকার। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা আগে ঠিক করা দরকার। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। বিগত দুটি নির্বাচন হয়েছে। জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। সে জন্য নির্বাচনকালীন তদারকি সরকারের কথা আমরা বামগণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে বলে আসছি। নির্বাচনকালীন তদারকি সরকারের জন্য একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।