সারে ভর্তুকি ২৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
শুধুমাত্র কালক্ষেপণের কারণে এবার সার আমদানির ভর্তুকিতে অতিরিক্ত প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। ‘লিন পিরিয়ডে’ (মন্দা মৌসুমে) দরপত্র আহ্বান না করা, দরপত্র আহ্বানের পর সময়ক্ষেপণ, যথাসময়ে কার্যাদেশ না দেয়া, দাম দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সার কেনার ক্রয়াদেশ দেয়া, উচ্চমূল্যে চাহিদার অতিরিক্ত সার আমদানি এবং জি টু জি পদ্ধতিতে ইউরিয়া সার ক্রয়ের কারণে এ বছর সারে ভর্তুকির পরিমাণ আট হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াচ্ছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সারের ভর্তুকিতে ২৮ হাজার কোটি টাকা লাগবে। এখন পর্যন্ত ১৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত আরও ৯ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি ও পরিবহন ব্যয় বাড়ার ফলেই এ বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি লাগবে। এমনিতে আমাদের প্রতিবছর ৮-৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি লাগে।
সারে এ বছর অস্বাভাবিক ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় সরকারও উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগের কথা কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকও গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তিনি ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, সারের দাম আবার বাড়ানো হবে কি না? তবে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, সারের দাম বৃদ্ধির কোন প্রস্তাব নেই। ফলে কৃষক আগের দামেই সব ধরনের সার পাবে।
এ বছর সারে ভর্তুকি আলোচনায় উঠে এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে যে, এ বছর হঠাৎ সারে ভর্তুকির পরিমাণ তিনগুণেরও বেশি বেড়ে গেল কেন? এই ভর্তুকি বৃদ্ধির বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে ৬টি কারণ। সবগুলোর জন্যই দায়ী কর্মকর্তারা। তাদের সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই এ বছর আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সার কিনতে গিয়ে সরকারকে বিপুল অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। অথচ তড়িত সিদ্ধান্ত নিতে পারলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির আগেই সার কেনা হয়ে যেত। অন্তত অর্ধেক টাকা সাশ্রয় করা যেত।
তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের সুবিধার্থে সরকার দুই ধরনের সার আমাদানি করে ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করে থাকে। একটি হচ্ছে নন-ইউরিয়া এবং অন্যটি হচ্ছে ইউরিয়া সার। উভয় প্রকার সারই সরকার নিজস্ব তত্ত্বাবধানে আমদানি করে ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিয়ে থাকে। তবে নন-ইউরিয়া সারের ৪০ শতাংশ সার ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে বেসরকারী খাতে আমদাািন করা হয়, যা পরবর্তীতে ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকের কাছে সরবরাহ করা হয়। আর বেশিরভাগই অর্থাৎ ৬০ শতাংশ সার সরকার বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে আমদানি করে ডিলারদের মাধ্যমে বাজারজাত করে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সার আমদানির জন্য সরকার চলতি বছরের ২৪ মে আন্তর্জাতিক দরপত্র বা টেন্ডার আহ্বান করে। এই দরপত্র খোলা হয় ২৭ মে। আর সার কেনার জন্য ক্রয়াদেশ দেয়া হয় দরপত্র খোলা ২৪ দিন পর ২০ জুন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃত বিধান অনুযায়ী একটি দরপত্রের মেয়াদ থাকে মাত্র ৭ দিন। এ সময়ের মধ্যে ক্রয়াদেশ না দিলে দরপত্রের দরে আর নির্বাচিত দরদাতার পক্ষে সার সরবরাহ সম্ভব হয় না। তখন সার সরবরাহ নির্ভর করে যখন ক্রয়াদেশ দেয়া হয় ওই সময়ের আন্তর্জাতিক দরের ওপর। এর পর যত দেরি করে ক্রয়াদেশ বা অর্ডার দেয়া হবে, তখনকার আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী দরে দরদাতা সার সরবরাহ করবে-এটাই আন্তর্জাতিক দরপত্রের নিয়ম।
অথচ এ বছর সার কেনার জন্য ২৪ দিন পর ক্রয়াদেশ দেয়া হয়েছে। এই বিলম্বের কারণে ওই ২৪ দিনে আন্তর্জাতিক বাজারের সারের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এ বছর যখন নন-ইউরিয়া সার কেনার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলো, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে ডাই-এ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের দাম ছিল ৫৮৫ থেকে ৫৯৯ মার্কিন ডলার। এই দরে সার সরবরাহের জন্য মোট মোট ১৭টি প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত হয়েছিল এবং মোট সার সরবরাহের পরিমাণ ৬ লাখ ৮০ হাজার টন।
এই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) সারের দাম ছিল ৬১৯ থেকে ৬৪৯ মার্কিন ডলার। এই দরে এক লাখ ৮২ হাজার টন টিএসপি সার সরবরাহের জন্য নির্বাচিত হয় ১১টি প্রতিষ্ঠান। অপরদিকে, একই দরপত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে মিউরেট অব পাটাশ (এমওপি) সারের দর ছিল ৩৩৩ থেকে ৩৫৩ ডলার। এই দরে এক লাখ ৯৮ হাজার ২০০ টন এমওপি সার সরবরাহের জন্য নির্বাচিত হয় ১১টি প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু, সিদ্ধান্তহীনতার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওই দরে এবার সার কেনার কার্যাদেশ প্রদান করা হয়নি। ফলে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে হু হু করে সারের দাম বাড়তে থাকে। এতে ২৪ দিন পর যখন সার কেনার জন্য ক্রয়াদেশ দেয়া হয় তখন আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ডিএপি ৯৭৫ থেকে এক হাজার ৬০ ডলার, টিএসপি ৭৩৯ থেকে ৭৯৭ মার্কিন ডলার এবং এমওপি ৬১৯ থেকে ৬৪৩ মার্কিন ডলারে।
এই দামে প্রথম দফা দরপত্রের সার কেনার পর, দ্বিতীয় দফায় ওই বাড়তি দামেই আরও অতিরিক্ত সার কেনা হয়েছে। এ বছর ডিএপি সারের লক্ষ্যমাত্রা ৮ লাখ টন হলেও কাটছাট করে বলা হয়েছিল ৬ লাখ টন কেনা হবে। কিন্তু পরবর্তীতে দাম বেড়ে যাওয়ার পর নতুন করে আবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আরও ১ লাখ ৭০ হাজার টন ডিএপি কেনা হয় ৯৭৫ থেকে এক হাজার ৬০ মার্কিন ডলারে।
এ বছর টিএসপি সারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ টন। বিলম্বে ক্রয়াদেশ দিয়ে ৭৩৯ থেকে ৭৯৭ মার্কিন ডলারে এক লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টন সার কেনার পর পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিয়ে আরও ৫০ হাজার টন টিএসপি সার কেনা হয় ৭৯৭ মার্কিন ডলার দরে। একইভাবে এ বছর এমওপি সারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ টন। প্রথম দফা দুই লাখ টন আমদানির পর দ্বিতীয় দফায় সেই বাড়তি দামেই আরও ৯০ হাজার টন এমওপি সার কেনা হয় বাড়তি ৬২০ থেকে ৬৪৩ ডলারে।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় হলো, বাংলাদেশে নন-ইউরিয়া সারের মধ্যে বেশিরভাগ সারই চীন থেকে আমদাািন করা হয়। অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে চীনে মন্দা মৌসুমে সারের দাম কিছুটা কম থাকে। বাংলাদেশ যখন সার আমদানির উদ্যোগ নেয়, তখনই আন্তর্জাতিক বাজারে এই খবর ছড়িয়ে পড়েছিল যে, চীন মে মাসের পর সার রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। সার-সংক্রান্ত সব বুলেটিনেই তখন এই খবর প্রকাশিত হয়। এটা জানার পরও আমাদের কর্মকর্তারা নন-ইউরিয়া সার আমদানিতে কালক্ষেপণ করেন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেলে তখন দরপত্রকৃত সার আমদানির ক্রয়াদেশ দেয়া হয়। এতে বাড়তি তথা প্রায় দ্বিগুণ দামে সার কিনতে গিয়ে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, যার কারণে এ বছর সার আমাদানিতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। অথচ দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হলে ডিএপির সব সার ৬০০ ডলারের মধ্যেই কেনা যেত এবং ভর্তুকির পরিমাণও কম হতো। অন্যান্য সারও প্রথম দফা দরপত্রের দরেই কেনা যেত।
কিন্তু কী কারণে সময়ক্ষেপণ করে বেশি দামে নন-ইউরিয়া সার কেনা হলো এবং সারের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ার পরও এবার অতিরিক্ত সার কেন কেনা হলো, সেটি তদন্ত করে বেব করা দরকার বলে মনে করছেন সার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ বছর করোনা মহামারীর কারণে এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম গত বছরের চেয়ে বেশি। ফলে দরপত্রে কম দামে সার পেয়েও কেন কালক্ষেপণ করে বেশি দামে সার কেনা হলো, সেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার। দরপত্র অনুযায়ী সময়মতো সার কেনা হলে এ বছর ভর্তুকি ১৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যেত। এখানে অন্য কোন বিষয় আছে কিনা- তা খতিয়ে দেখা দরকার।
অন্যদিকে, দেশের প্রধান সার হচ্ছে ইউরিয়া। দেশে বর্তমানে ইউরিয়া সারের চাহিদা ২৬ লাখ টন। এর মধ্যে দেশীয় কারখানাগুলো উৎপাদন করে ১০ লাখ টন। অবশিষ্ট ১৬ লাখ টন ইউরিয়া সার আমদাািন করা হয়। গত তিন বছর ধরে এই সার কেনা হচ্ছে জি টু জি অর্থাৎ সরকার টু সরকারের মাধ্যমে। কোন দেশের সরকার যখন অন্য কোন দেশের সরকারের কাছে সরাসরি কোন পণ্য বিক্রি করে, তখন তার দর নির্ধারিত হয় সারা বছরের গড় দরের ভিত্তিতে। আর কোন দেশ সাধারণত অন্য দেশের সরকারের কাছ থেকে পণ্য কেনে আপৎকালীন। স্বাভাবিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দরপত্রের মাধ্যমে পণ্য কেনা হয়। কিন্তু বর্তমানে দেশে গত তিন বছর ধরে আমদানিকৃত ইউরিয়ার পুরোটাই সরকার টু সরকার ব্যবস্থায় কেনা হচ্ছে। এতে গড় দরের ভিত্তিতে ইউরিয়া কেনার কারণে দামও বেশি পড়ছে। ফলে প্রতি কেজি ইউরিয়াতে বর্তমানে ৮৪ শতাংশ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এ বছর শুধু ইউরিয়া সারেই ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। কারণ, বর্তমান জি টু জির মাধ্যমে কেনা প্রতিটন সারের দাম পড়ছে বাংলাদেশী টাকায় এক লাখ টাকা। এই এক লাখ টাকার মধ্যে ৮৪ হাজার টাকাই সরকারকে ভর্তুকি হিসেবে দিতে হচ্ছে। অথচ দরপত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজার যাচাই করে এই সার কেনা হলে ভর্তুকির পরিমাণ আরও কম হতো।
বিশ্বের কৃষি প্রধান সব দেশই সাধারণত ‘লিন পিরিয়ড’ বা মন্দা মৌসুমে সার কিনে থাকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও এ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির আগেই তাদের চাহিদার সব সার কিনে ফেলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ মন্দা মৌসুমে সার না কেনার কারণে এবং দরপত্র আহ্বান করেও সময়মতো সেই দরপত্রের দরে সার না কেনার কারণে এ বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এমনিতেই সরকার কৃষি পণ্যের উৎপাদন ক্ষমতা কমাতে কৃষকদের কম মূল্যে সার সরবরাহের জন্য দাম কমিয়ে এনেছে। যার সুফল কৃষক পাচ্ছে। এতে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু সেই ভর্তুকির সারও সময়মতো না কেনার কারণে এ বছর প্রায় তিনগুণেরও বেশি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। অথচ সার আমাদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সংসদীয় কমিটিও সারের বিষয়ে দ্রুত বৈঠক করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাগাদা দিয়েছিল। কিন্তু সেই বৈঠকও শেষ পর্যন্ত আর করা হয়ে উঠেনি।