ওদের মুখোশ উন্মোচনের দাবিতে সোচ্চার দেশবাসী ॥ জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়ারা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পুরস্কৃত করেন

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
একজন প্রকৃত নেতার যেসব গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, তার সব গুণ নিয়েই জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল বহুবর্ণিল, যাঁর কণ্ঠে ছিল জাদু। যিনি রচনা করেছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিজয় ইতিহাস। নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন ও বিশ্বাস করতেন এদেশের মানুষকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে বাঙালী নামক কিছু বেইমান-বিশ্বাসঘাতক হায়েনাদের হাতে। পৃথিবীর ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকান্ডের পর দীর্ঘ ২৬ বছর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচার না করে উল্টো লালন-পালন-পুরস্কৃত ও রাজনীতিতে পুনর্বাসনের নগ্ন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী।
বিশ্বের ইতিহাসে এত নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের নজির নেই বললেই চলে। তবুও কী আশ্চর্য, এই ভয়ঙ্কর হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত আত্মস্বীকৃত খুনীদের চূড়ান্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে কেটে যায় একে একে ৩৪ বছর। জাতি দেখেছে জিয়া-এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলের দীর্ঘ সময়ে নিষ্ঠুর এই ঘাতকদের প্রকাশ্যে পুরস্কৃত করার ঘৃণ্য চিত্র। ঘৃণ্য ঘাতকরা এক সময় নিজেদের বিচারের ঊর্ধ্বে ভেবেছিল এবং তাদের কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করতে পারবে না বলে দম্ভ করেছিল, দীর্ঘ ৩৪ বছর পর এই বিচার ও দন্ডাদেশ কার্যকর করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে বাংলার মাটিতে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
আর বিচারের দীর্ঘতম প্রক্রিয়া শেষে রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের অত্যন্ত মর্মস্পর্শী করুণ এক অধ্যায়ের। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হলেও এসব ঘৃণ্য নরপশুদের প্রতি বাঙালির ঘৃণা-ধিক্কার এতটুকুও কমবে না। বরং দেশ যতদিন থাকবে, ততদিন এসব ঘাতকের কবরে প্রজন্মের পর প্রজন্মের সন্তানরা তাদের হৃদয়ের ঘৃণা জানাতে এতটুকুও ভুলবে না।
কিন্তু এখনও বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনী বিদেশে পলাতক। বিদেশের মাটিতে বসে এখনও ঘৃণ্য খুনী ও তাদের দোসররা দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এবারের শোক দিবসের প্রাক্কালে পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ড ও মদদদাতাদের নতুন প্রজন্মের সামনে মুখোশ উন্মোচন করতে দ্রুত জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবিতে সোচ্চার দেশের মানুষ। সরকারও এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। কৃতজ্ঞ বাঙালি মনে করে, নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ডদের খুঁজে বের করে তাদের মুখোশ উন্মোচন না করলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস কখনও রচনা করা সম্ভব হবে না।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও স্বীকার করেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে মঞ্চের খুনীদের পেছনে যারা, তাদের খুঁজে বের করা দরকার। এ সকল নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে তদন্ত করে তাদের স্বরূপ উন্মোচন করতে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য। গণতন্ত্র, মূল্যবোধ ও আদর্শকে একে একে আক্রমণ করা হচ্ছে। তাই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে চিরতরে নির্মূল করতে হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও বলেছেন, এটি দুঃখজনক যে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী যখন আমরা উদ্যাপন করছি, তখনও স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি রাজনীতি করছে। যারা দেশটাই চায়নি, তারা এখনও বাংলাদেশে আস্ফালন করে, রাজনীতি করে এবং বিএনপির মতো একটি বড় দল তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আর তাদের রাজনীতি করার সুযোগটাও করে দিয়েছিল জিয়াউর রহমান। তাই ইতিহাসকে ঠিক তথ্যনির্ভর করার জন্য জিয়াউর রহমানসহ যারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের কুশীলব ছিল তাদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন। এটি আজ সময়ের দাবি, অন্যথায় ইতিহাসের দায়টা আমরা এড়াতে পারব না।
জিয়া-এরশাদ-খালেদা’র খুনীদের লালন-পালন : বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ঘাতকচক্রকে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে বেইমান ও মীরজাফর খ্যাত খন্দকার মোশতাক আহমাদের সরকার। এরপর সেনা আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান রক্তপিপাসু হিংস্র খুনীদের প্রায় সবাইকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত ও পুনর্বাসিত করেন। পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদ ও জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও একই পথ অনুসরণ করে খুনীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও পুরস্কৃত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন।
দেশবাসীকে বঞ্চিত করেছেন পিতৃহত্যার বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থেকে। বিচার পেতে ৩৪টি বছর অপেক্ষা করতে হলেও খুনীদের পুনর্বাসনে কার কি ভূমিকা, আর এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের নেপথ্যের নায়ক ও বেনিফিশিয়ারি কারা তা দেশবাসীর সামনে এখন দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। মিথ্যা দিয়ে কখনও সত্য ইতিহাসকে ধামাচাপা দেয়া যায় না। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা এবং নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের সময় বাংলাদেশে অনুসন্ধানী কাজে থাকা বিখ্যাত অনেক সাংবাদিকের লেখনীতেও সুষ্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে, কারা ঘৃণ্য খুনীদের বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে উৎসাহিত এবং নেপথ্যের নায়ক হিসেবে কাজ করেছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই নেপথ্যের মূল কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচিত হতে থাকে দেশবাসীর সামনে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে জাতিকে প্রগতি-সমৃদ্ধির অগ্রমিছিল থেকে কেন পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল, হিংস্র রক্তপিপাসু হায়েনার দল দেশীয়-আন্তর্জাতিক কার কার মদদে-ইন্ধনে এমন রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল, কালের বিবর্তনে তাও জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর খুনী মোশতাককে সরিয়ে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান প্রকাশ্য আত্মস্বীকৃত খুনীদের পক্ষ নেন। খুনীদের প্রায় সবাইকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কূটনৈতিক পদে নিয়োগ দিয়ে পুনর্বাসিত করেন। পরবর্তী এরশাদ সরকারও হত্যাকারীদের তোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে এবং এরশাদের আমলেই খুনীরা রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করে। আর জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। বিদেশে পলাতক এক খুনীকে বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেয়া হয়। জাতির পিতার নির্মম হত্যাকান্ডের দিন পনেরো আগস্ট মিথ্যা জন্মদিন পালনের নামে উল্লাস করে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পক্ষে তাঁর অবস্থান সুস্পষ্ট করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার পর জনরোষ থেকে খুনীদের অব্যাহতি দিতে তৎপরতা শুরু করে খন্দকার মোশতাক সরকার। ৩ নভেম্বর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় আলোচনার পর খুনী মেজরদের দেশত্যাগের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। তৎকালীন মোশতাক-জিয়াদের সহযোগিতায় ওইদিন সন্ধ্যায় ফারুক-রশিদসহ ঘৃণ্য খুনী ১৭ সামরিক কর্মকর্তা ব্যাঙ্ককগামী প্লেনে নির্বিঘ্নে দেশ ছেড়ে চলে যায়। প্লেনটি চট্টগ্রামে রিফিলিং করে সরাসরি ব্যাঙ্কক পথে উড়ে যায়। সরকারী অর্থে খুনীরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে গিয়ে বিদেশে অবস্থান করতে থাকে।
পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয় এর পর থেকেই। পালিয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর খুনীরা বিদেশে অবস্থানের সময় ১৯৭৬ সালে মার্চ মাসে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মস্বীকৃত খুনী কর্নেল রশিদ ও কর্নেল ফারুক দেশে আসে। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে বনিবনা না হওয়ায় ওই দুই খুনীর সঙ্গে জিয়াউর রহমানের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে জিয়াউর রহমান ফারুক-রশিদকে জোর করে লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেন। লিবিয়ায় ব্যবসা শুরু করে ফারুক-রশিদরা সেখান থেকে রাষ্ট্রবিরোধী নানা তৎপরতা চালাতে থাকে।
১৯৭৬ সালের ৮ জুন জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ১২ খুনীকে বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত ও পুনর্বাসিত করেন। এর আগে খুনী ডালিম, আজিজ পাশা, শাহরিয়ার রশিদ, আহমেদ শরিফুল হোসেন, বজলুল হুদা, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী, এ কে এম মহিউদ্দিন, নাজমুল হোসেন, কিসমত হোসেন, খায়রুজ্জামান ও মাজেদের চাকরি সামরিক বাহিনী থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। তাদের নিয়োগ দেয়া হয় বিভিন্ন দূতাবাসে।
এর মধ্যে খুনী ডালিমকে চীনে, আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনা ও মহিউদ্দিনকে আলজিরিয়ায় প্রথম সচিব, শাহরিয়ারকে ইন্দোনেশিয়ায়, বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে, রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে, নূর চৌধুরীকে ইরান ও আহমেদ শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব এবং কিসমতকে আবুধাবিতে, খায়রুজ্জামানকে মিসরে, নাজমুলকে কানাডায়, মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে তারা আরও বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি করেছেন। ১৯৮০ সালে খুনীদের চাকরি পররাষ্ট্র ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করে সরকারী সকল সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের পথ উন্মুক্ত করা হয়। তবে খুনী ফারুক ও রশিদ সরকারী চাকরি নেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮০ সালের ১৭ জুন ঢাকায় একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান হয়। তখন খুনী হুদা পাকিস্তানে ও শাহরিয়ার ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব এবং ডালিম চীনে প্রথম সচিব পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার দায়ে আটক হতে পারেন আশঙ্কায় বজলুল হুদা, শাহরিয়ার রশিদ খান ও ডালিম কর্মস্থল ছেড়ে তখন পালিয়ে যান। অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে আজিজ পাশাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ওই মামলায় তিনি রাজসাক্ষী হয়ে ছাড়া পান এবং রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে আবার কূটনীতিকের দায়িত্ব পান। এছাড়া দেশে অবাধে যাতায়াতসহ জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে নানা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা।
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ব্যাপারে সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও জিয়াউর রহমানের নীতি অনুসরণ করেন। এরশাদ সরকারের আমলেই বঙ্গবন্ধুর খুনীদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয় বাংলাদেশ। ওই সময়ই নির্ভয়ে দেশে ফিরে আসে পাষন্ড খুনী হুদা ও শাহরিয়ার। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি (প্রগশ) নামে একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করে। এরশাদের সঙ্গে সমঝোতা করে খুনী ফারুক-রশিদরা ঢাকায় আসে এবং ফ্রিডম পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। ফ্রিডম পার্টির উপদেষ্টা কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট করা হয় আরেক খুনী রশিদকে। ফ্রিডম পার্টির কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য লিবিয়ায় পাঠানো হয়। তারা প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে যুব কমান্ড গঠন করে।
এরশাদ সরকার ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আত্মস্বীকৃত খুনী ফারুককে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেন। ১৯৮৭ সালে বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনেও ফ্রিডম পার্টি অংশ নেয় এবং বজলুল হুদাকে বিজয়ী করে পবিত্র সংসদে বসার সুযোগ করে দেয়া হয়। ১৯৯৩ সালে ফ্রিডম পার্টি বিভক্ত হয়ে যায়। এক পক্ষে নেতৃত্ব দেয় সৈয়দ ফারুক রহমান, অপর অংশে থাকে কর্নেল রশিদ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে যুব কমান্ডের সশস্ত্র ক্যাডারদের ধরপাকড় শুরু হয়। খুনী ফারুক, শাহরিয়ার গ্রেফতার হওয়ায় রশিদ ও বজলুল হুদা পালিয়ে যায়।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও খুনীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদ দেয়া হয়। আগেরবার ক্ষমতায় থাকতেও খালেদা জিয়া তাঁর বিতর্কিত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের ভোটারবিহীন নির্বাচনে আত্মস্বীকৃত খুনী রশিদকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করিয়ে বিরোধী দলের নেতা পর্যন্ত বানান।
১৯৯১-১৯৯৬ বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় বঙ্গবন্ধুর খুনীরা চাকরিতে পদোন্নতি পান। ২০০১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেও একই ধারা বজায় রাখে। আওয়ামী লীগ আমলে বিদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত বঙ্গবন্ধুর এক খুনীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে ওই খুনীর চাকরি ফিরিয়ে দিয়ে অবসরকালীন সরকারী সকল সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পুরস্কৃত করে দেশবাসীকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তারা বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরই পক্ষে।
এমনকি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশে কানাডায় অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনী নূর চৌধুরীকে গোপনে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেয়ার অভিযোগ ওঠে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত অনেক খুনীই গোপনে দেশে যাতায়াত করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ’৭৫ পরবর্তী ২১ বছর এবং পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোটের ৫ বছর মিলিয়ে ২৬টি বছর ধরে নানা কায়দায় খুনীদের রক্ষা করা হলেও এখন প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রচলিত আদালতে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি কর্নেল ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, একে মহিউদ্দিন আহমেদ ও মহিউদ্দিন আহমদের ফাঁসির রায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর করা হয়। এরপর আরেক পলাতক খুনী আবদুল মাজেদকে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ঢাকা থেকে গ্রেফতার করার পর কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। পলাতক থাকা অবস্থায় বিদেশেই মারা যায় আরেক খুনী আজিজ পাশা। এতে দেশ কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হয়।
এখনও বিদেশে পলাতক রয়েছে পাঁচ খুনী। এসব খুনী হচ্ছে- কর্নেল আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএম এইচ নূর চৌধুরী। অধিকাংশ পলাতক খুনীরা কোন দেশে পালিয়ে আত্মগোপনে রয়েছে তা শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক দুই খুনীকে দেশে ফেরত পাঠাতে ইতোমধ্যেই ওই দুটি দেশের রাষ্ট্র প্রধানের কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। জোর কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে পালিয়ে থাকা সব খুনীদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকরের মাধ্যমে পিতৃহত্যার কলঙ্ক থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।