জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খান মাসুদ আর নেই

3

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক এবং গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ আর নেই। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সোমবার ভোরে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নাল্লিাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)।
জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খান মাসুদ সোমবার ভোরে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন। রাজধানীর ক্যান্টনম্যান্টের নিজ বাসভবনে অসুস্থতা বোধ করলে ভোর সাড়ে পাচঁটার দিকে তাকে নিকটস্থ এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর।
সকালে মৃত্যুর সংবদ শুনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আতিক উল্লাহ খান মাসুদের বাসায় ফোন দেন। এ সময় তিনি মাসুদের ভগ্নিপতি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খানের সঙ্গে ১৫ মিনিট কথা বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তার কাছ থেকে মাসুদের পরিবারের খোঁজ খবর নেন।
মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ খান মাসুদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, মন্ত্রি পরিষদের সদস্য, এমপি, বিভিন্ন রাজনৈতক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
শোক বার্তায় রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অনুসারি আতিক উল্লাহ খান মাসুদের মৃত্যুতে জাতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির বাতিঘরকে হারাল। সংবাদপত্র প্রকাশনার জগতে মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ দিয়েছেন নতুন মাত্রা। তার মৃত্যুতে দেশ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন মহান মুক্তিযোদ্ধাকে হারালো। তিনি নতুন প্রজন্মের সংগঠক ও উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
আতিক উল্লাহ খান মাসুদ একজন সজ্জন ও ভীষণ সহসী একজন মানুষ হিসাবে আখ্যায়িত করে শোক বার্তায় আরও বলা হয়, তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ ও এদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি একজন বুদ্ধিবৃত্তিক পুরোধাকে হারাল।
সোমবার বাদ জোহর ঢাকা সেনানিবাসের আল্লাহু মসজিদে মরহুমের প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপি এবং আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খান উপস্থিত ছিলেন। দৈকিন জনকণ্ঠ প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক আতিক উল্লাহ খান মাসুদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত সময়ে দৈনিক জনকণ্ঠের সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করেন।
জানাযা শেষে তার মরদেহ দৈনিক জনকণ্ঠ অফিসে আনা হয়। দুপুর ২টার দিকে মরহুমের লাশ দৈনিক জনকণ্ঠে আনা হলে এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরে মাসুদের মরদেহ বারডেমের হিমাঘরে রাখা হয়। বর্তমানে মরহুমের বড় ছেলে মিশাল এ খান রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তিনি দেশে এলে আতিক উল্লাহ খানের দাফন হবে।
অতন্ত সাহসী মাসুদ যুব বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ২ নং সেক্টরের অধীনস্থ মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানা কমান্ডার হিসাবে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেন এবং অনেক বড় বড় অপারেশনে অংশ নেন। বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে ১৯৭২ সালে সফলভাবে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে কর্মজীবন শুর করেন। তৎকালীন সফল তরণ শিল্পপতিদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তিনি বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন।
১৯৭৮ সালে তিনি সাফল্যের সাথে জাপানের কারিগরী সহযোগিতায় গ্লোব ইনসেক্টিসাইডস লিঃ নামে দেশের প্রথম মশার কয়েল প্রস্তুতকারী শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ধোঁয়াবিহীন মশা নিবারক গ্লোব ম্যাট ও তেলাপোকা ধ্বংসকারক গ্লোব এ্যারোসল এই দুটি পণ্য উক্ত কারখানায় উৎপাদন শুর করা হয়। ১৯৯০ সালে গণচীনের কারিগরী সহযোগিতায় গ্লোব মেটাল কমপ্লেক্স লিঃ নামে আরো একটি ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৯৩ সালে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সফল শিল্পপতি হিসাবে তার জীবনের সবচেয়ে সফল সংযোজন দেশের অন্যতম এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকা “দৈনিক জনকন্ঠ” প্রকাশ করেন। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসাবে তিনি এই জাতীয় দৈনিকটি সর্বপ্রথম অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সমন্বয়ে দেশের ৪টি স্থান থেকে একই সাথে প্রকাশ করে দেশের সংবাদপত্র শিল্পে ব্যাপক আলোড়ন সৃস্টি করেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্ব ও দুরদর্শিতায় খুব দ্রুতই জনকণ্ঠ দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনায় পরিণত হয়। প্রকাশের তিন বছরের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে র্বজনস্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য পত্রিকা হিসাবে দেশের শীর্ষ স্থান দখল করতে সক্ষম হয়। পত্রিকাটি প্রকাশ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে চেতনা ধারণ এবং প্রচার করে আসছে। পাশাপাশি পত্রিকাটি সব সময় স্বাধীনতা বিরোধীদের বিপক্ষে স্বরব অবস্থানে রয়েছে। তার অন্যতম প্রকাশনা হচ্ছে ‘সেই রাজাকার’। এই বইটি দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
মাসুদ ১৯৯৭ সালে ডেইরি ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য গ্লোব খামার প্রকল্প নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৯৯৮ সালে দেশের গৃহায়ন সমস্যা বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত নাগরিকদের জন্য গৃহায়ন সমস্যা সমাধানকল্পে গ্লোব কনস্ট্রাকশন লিঃ নামে আরও একটি গৃহ-নির্মাণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
২০০০ সালে তার উপরোক্ত সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সমন্বয়কারী হিসাবে গ্লোব জনকন্ঠ শিল্প পরিবার লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তিনি নিজস্ব সাংগঠনিক মেধা ও প্রশাসনিক দক্ষতার গুণে প্রতি বছর দেশের কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে দেশে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং দেশে উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে অদ্যাবধি কয়েক হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। বর্তমানে “গ্লোব জনকন্ঠ শিল্প পরিবার লিমিটেড” অবস্থানগতভাবে বাংলাদেশে সফল, সুপরিচিত ও বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে একটি অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃত।
জন্মলগ্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে এবং নীতির প্রশ্নে আপসহীন দৈনিক জনকন্ঠ যে সাহসী ভূমিকা এ যাবৎ পালন করে আসছে তা সহ্য করতে না পেরে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী সেই চক্র ওয়ান ইলেভেনের শুরতেই অর্থাৎ ২০০৭ সালের ৭ মার্চ মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে জনকন্ঠ ভবন থেকে রাত ১০.০০ টায় গ্রেফতার করে ৪২টি মিথ্যা মামলা ৪৫ কোটি টাকা জরিমানা এবং ৪৮ বৎসর কারাদন্ড প্রদান করে দীর্ঘ ২২ মাস ১২ দিন কারান্তরীণ রাখে। গণতন্ত্র ফিরে এলে ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
এ সময় মাসুদ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন। ১৯৮৪-৮৬ তিনি সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সহ-সভাপতি ও ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮৫-৮৬ সালে গরীব ও অনাথ শিশুদের বিনা খরচে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি বিক্রমপুরের লৌহজং মহাবিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন।