নেতাকর্মীদের প্রতি শেখ হাসিনার আহবান ॥ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করুন

14
আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনে ৯ম বারের মত সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং ২য় বারের মত সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় ওবায়দুল কাদেরকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ ও ত্যাগের মহিমা নিয়ে নিজেদের গড়ে তোলা, দলকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে কাজ করতে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, গত দশ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। দেশের উন্নয়নে অনেক কাজ করেছি। আমাদের আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে দলের নেতাকর্মীদের বলব- সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে, মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। কি পেলাম, কি পেলাম না সে চিন্তা না করে মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণে সবাইকে কাজ করতে হবে।
শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে নির্মিত প্যান্ডেলে আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে সূচনা বক্তব্যে এবং রেকর্ডসংখ্যক টানা নবমবারের মতো দলের সভাপতি পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আপনারা যে গুরু দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন, তা পালন করার চেষ্টা করব। কিন্তু আমার বয়স হয়েছে, আমার বয়স এখন ৭৩। তাই আগামীতে আপনাদের নতুন নেতা খুঁজতে হবে, নতুন নেতৃত্ব আনতে হবে’। এ সময় ‘নো নো’ স্লোগান দিয়ে গোটা প্যান্ডেল প্রকম্পিত করে তোলেন সারাদেশ থেকে আসা কাউন্সিলরা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। দেশের এই উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা যেন থাকে, সেটাই আমরা চাই। নানা চড়াই-উৎরাই, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র পেরিয়ে আওয়ামী লীগ এখন অনেক শক্তিশালী ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল। তাই দলকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে।
দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের সেভাবেই কাজ করতে হবে, যাতে মানুষ যেন আবারও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের ভোট দিয়ে বিজয়ী করে। আমরা যেন জনগণের সেবা করে যেতে পারি। সংগঠনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সবাইকে জাতির পিতার আদর্শ মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, স্বভাবতই ক্ষমতায় থাকলে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যায় না। কিন্তু আমরা সেটা করতে পেরেছি, আমরা মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছি, এই জনপ্রিয়তা আমাদের ধরে রাখতে হবে।
১৯৮১ সাল থেকে গত ৩৮ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দেয়া প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলার কথা তুলে ধরে বলেন, জাতির পিতা এমনভাবে সংগঠনটি গড়ে তোলেন এবং এর মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেন। আওয়ামী লীগের ত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের যত অর্জন রয়েছে, তা করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি শহীদ হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতি পিতা সপরিবারে নিহত হওয়া এবং তার পরবর্তী বাংলাদেশের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার পর সেখানে গণতন্ত্র ছিল না। দেশে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন গণতন্ত্র নয়, তখন কার্ফিউ গণতন্ত্র চলেছে, স্বৈরশাসন চলেছে। দুর্নীতি, অপশাসন, মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র-অর্থ তুলে দিয়ে অবক্ষয়ের মাধ্যমে পুরো দেশকেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
কাউন্সিলরদের উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। জাতির পিতার আদর্শ মেনে সবাইকে চলতে হবে। যেসব জেলায় এখনও সম্মেলন হয়নি, সেগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে। তিনি বলেন, জাতির পিতা যে লক্ষ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেই স্বাধীনতার অধিকার যাতে মানুষ পায়, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন, ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং বিশ্বের দরবারে মর্যাদা নিয়ে চলবে- জাতির পিতা সেই লক্ষ্য নিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন। তাই আমাদের একটাই লক্ষ্য- বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণ করা। সেটা আমরা পূরণ করব। দেশকে আমরা ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব। যা দেখে আমার বাবা-মা’র আত্মা যেন শান্তি পায়। লাখো শহীদের আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়।
তিনি বলেন, বিশ্বসভায় দেশের মানুষ স্থায়ীভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর দেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলেছিল, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখনই দেশের মানুষ বুঝতে পারে সরকার জনগণের সেবক, সরকার জনগণের কল্যাণ করতে পারে। কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে জনগণ কিছু পায়, দেশের উন্নয়ন হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দেশ এগিয়ে যায়।
বিএনপি-জামায়াত সরকারের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতায় যারা উড়ে এসে জুড়ে বসে, তারা শুধু নিজেদের ভাগ্য গড়ে। জনগণের কল্যাণ করতে পারে না। এই যে ঋণখেলাপী কালচার, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মাদক ও মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তারা সমাজটাকেই ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কোন দেশ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে চলতে যদি না পারে, সেই দেশ যে ধ্বংসের পথে যায়, সেটাই তখন প্রমাণ হয়েছে। একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেই দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নত হয়, সেটা আজকে প্রমাণিত।
সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীর উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে চলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচার পর আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যেসব এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) রিপোর্ট করেছিল সেসব সংগ্রহ করে তাই খ- খ- বই আকারে প্রকাশ করছি। এই রিপোর্টে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস, অনেক নেতার নাম ও ঘটনা যেসব কালের বিবর্তনে হারিয়ে গিয়েছে, সেইসব তথ্য এসব রিপোর্ট থেকে দেশের মানুষ ও তরুণ প্রজন্ম জানতে পারবে।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার মুহূর্তটি বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন দেশে ফিরে আসি তখন কী অবস্থা ছিল? বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর খুনীরা ভেবেছিল আওয়ামী লীগ আর কোনদিন দাঁড়াতে পারবে না, ক্ষমতায় যেতে পারবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ জনগণের সমর্থন নিয়ে টানা তৃতীয়বারসহ মোট চারবার ক্ষমতায় এসে দেশের মানুষের সেবা করে যাচ্ছে। দেশের দারিদ্র্য ৪১ ভাগ থেকে কমিয়ে এখন ২০ ভাগে আনতে আমরা সক্ষম হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিকৃত ইতিহাস সৃষ্টি এবং বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার নানা ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫-এর পর জাতির পিতার নাম মুছে ফেলার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু সত্য ইতিহাস কখনও মুছে ফেলা যায় না। জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ইউনেস্কো একসঙ্গে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরকারের উন্নয়ন ও সফলতার চিত্র তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বের সামনে উন্নয়নের রোলমডেল। আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছি। জাতির পিতার আদর্শ চলতে হবে দেশকে আরও উন্নত-সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তুলতে। আমরা উন্নয়নের গতিশীলতা ধরে রেখে দেশকে আরও উন্নত করতে চাই। লক্ষ্য স্থির থাকলে যে দেশের উন্নয়ন করা যায়, আমরা তা প্রমাণ করেছি। আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে।
তাকে নবমবারের মতো সভাপতি নির্বাচিত করায় কাউন্সিলরদের উদ্দেশে করে আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাবা-মা, ভাইসহ সবাইকে রেখে আমরা দু’বোন বিদেশে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেশে ফিরে পরিবারের কাউকে ফিরে পাইনি। কিন্তু দেশে ফিরে সারাদেশের মানুষের ভালবাসা পেয়েছি, দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের মধ্যে আমার বাবা-মা’র ভালবাসা পেয়েছি। কিন্তু আমার বয়স হয়েছে। আগামীতে নতুন সভাপতি সবাইকে খুঁজে নিতে হবে। তবে আমার ওপর যে গুরুত্বদায়িত্ব সবাই দিয়েছেন, তা আমি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করব।
সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের অধিকাংশ পদে মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন এবং সংসদীয় বোর্ড ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের নামও ঘোষণা করেন। আর এর মাধ্যমেই শেষ হয় উপমহাদেশের প্রাচীণ ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দু’দিনব্যাপী ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন।