শিপনের স্বপ্ন ভঙ্গ, যাওয়া হলো না ইতালি, আসলো না পরিবারের সচ্ছলতা

14

আতিকুর রহমান মাহমুদ ছাতক থেকে :
টানাপোড়নের সংসারে একটু স্বাচ্ছন্দ্য ফেরানোর স্বপ্ন দেখতেন শিপন। নিজের স্বপ্ন পূরণে বুকভরা আশা নিয়ে সমুদ্রপথে ইতালি যেতে চেয়ে দালালের খপ্পরে পরে সর্বস্ব হারিয়ে এখন সে নিঃস্ব। তিউনেশিয়া থেকে উদ্ধার হওয়া ১৭ বাংলাদেশীর একজন তিনি। সোমবার দুপুরে মা বাবার কাছে ফিরেছেন এই যুবক। সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের মুনিরজ্ঞাতি গ্রামের যুবক শিপন আহমেদ এলাকায় সিএনজি চালিত অটোরিক্সা চালাতেন। তার পরিচিত যুবক পার্শ্ববর্তী গ্রামের লুৎফুর রহমান তাকে সমুদ্রপথে ইতালি পৌঁছে দেবে বলে কথা দিয়েছিলো। কিন্তু শিপনকে আটকে রেখে পরিবারের কাছ থেকে লুৎফুর রহমানসহ দালালরা কৌশলে আদায় করে নেয় ১০ লাখ টাকা। লুৎফুরের পিতা জমির আলী শিপনের পরিবারের কাছ থেকে কয়েক দফায় এই টাকা নেয়। উত্তাল সমুদ্রে তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ভাসতে থেকে মৃত্যুর মুখ থেকে তিউনেশিয়া হয়ে বেঁচে ফিরেছেন শিপন। ওই সময়ে দালালদের পক্ষ থেকেও কোন তৎপরতা না থাকায় পরিবারের কাছে নিখোঁজ ছিলেন শিপন। শিপনের কোন খবর না পাওয়ায় দুঃশ্চিন্তায় পাগলপ্রায় ছিলেন শিপনের পিতা-মাতাসহ পরিবারের অন্য লোকজন। দুপুরে শিপন তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসলে মা মিনারা বেগম তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। তাকে দেখতে বাড়িতে জড়ো হন এলাকার বাসিন্দারা। এ সময় এই প্রতিবেদককে এই ভ্রমণের বিষয়ে বলেন শিপন।
শিপন আহমেদ বলেন ‘তিন সপ্তাহ মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বিদেশে যাওয়ার শখ মিটে গেছে। আমাদের অবস্থা এমন ছিলো যে বাঁচার জন্য যে যা পেয়েছে তাই খেয়েছে। অনেকে নিজের প্রস্রাব পর্যন্ত খেয়েছে। আর এক দিন থাকলে আমরা হয়তো মরেই যেতাম। আমি আমাদের দূতাবাসকে এবং সেখানকার আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই, আল্লাহর পরম করুণায় তারা আমাদের বাঁচতে সহযোগিতা করেছেন।’
শিপন বলেন ‘আমি একেবারে কম লেখাপড়া করেছি, তাই এলাকায় সিএনজি চালাতাম। আমার পরিচিত পার্শ্ববর্তী গ্রাম মায়েরকোলের জমির আলীর পূত্র দালাল লুৎফুর রহমান বেশ কিছুদিন হলো লিবিয়া গিয়েছে। সে প্রায়ই আমাকে ফোনে বলতো বিদেশ নিবে, আমি যাতে টাকা পয়সা জোগার করি। অভাবের সংসারটা বদলাতে চাইছিলাম। আমাদের অসচ্ছলতা আর থাকবেনা ভেবে এইটাকে একটা সুযোগ মনে করে জমি বন্ধক রেখে, গরু-বাছুর বিক্রি করে মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে টাকা এনে এমনটা হবে সেটা কোনদিন চিন্তাও করিনি।’
শিপন আরও বলেন ‘লিবিয়া নিয়ে যাওয়ার পর আমাকে আটকে রেখে টাকা নেয়া হয়েছে। মারধর তো করতোই, লিবিয়া থেকে ইতালি নিবে বলে আমার বাড়িতে ফোন করে আরও ৩ লাখ টাকা নিয়েছে। আমার কাছ থেকে সব মিলিয়ে লুৎফুর ও তার বাবা জমির মিলে ১০ লাখ টাকা নিয়েছে। এখন কি আর করার, ক্ষতিপুরণ তো চাইতে পারবো না, জমির আলী ও তার দালাল ছেলের এই এলাকায় অনেক প্রভাব রয়েছে। এরজন্য হয়তো কোনদিন ওদের বিচারও হবেনা। পুলিশের কাছেও যেতে ভয় হচ্ছে, কারণ দালালের লোকজন রাস্তায় আমাকে মেরে ফেলবে।’
শিপন বলেন ‘আমাকে বড় জাহাজে করে পাঠানোর কথা ছিলো, সে শর্তে টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মতো আরও ৭৩জনকে নিয়ে একটা ছোট নৌকায় উঠিয়ে দিলো দালালরা। এটা এতোই ছোট ছিলো যে তাদের পরিকল্পনা ছিলো আমরা যেনো সাগরের মাঝখানে ঢুবে যাই। কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করেছেন। প্রত্যেকটা দিন আমরা চিৎকার করে কাঁদতাম, কিন্তু এই কান্না শোনার মতো কেউ ছিলো না। দু’সপ্তাহ আমরা কিছু খাইনি। চিন্তা করতাম আর কোনদিন হয়তো মায়ের কাছে ফিরে আসতে পারবো না। বড় ভুল করেছি সেটাও ভাবতাম। ওই সময়ে আল্লাহর কাছে বিচার চাইতাম, আল্লাহ যেনো ওই দালালদের বিচার করেন।’
সহায়-সম্পদ সব হারিয়ে গেলেও নিজেদের ছেলে ফিরে আসায় হৃদয় খুশিতে ভরে উঠেছে বাবা হেলাল মিয়া ও মা মিনারা বেগমের। তবে তারা সরকারের কাছে এই দালাল চক্রের দৃষ্টান্তমুলক বিচার দাবি করেন।
শিপনের মা মিনারা বেগম বলেন ‘আমার সব বিক্রি কইরা, জমি বন্ধক দিয়া ছেলেরে বিদেশে পাঠাইতাম চাইসি, কিন্তু দালালরা আমার ছেলেরে মারার চেষ্টা করসে। এতো টাকা নিয়া গেছে, আমারে ঠকাইসে, আমি এর বিচার চাই।’
বাবা হেলাল মিয়া বলেন ‘গত মার্চ মাসে শিপনকে লিবিয়া নেয়ার কথা বলে টাকা নেয় দালাল লুৎফুর রহমান ও তার পিতা জমির আলী। পরে শিপনকে লিবিয়া নিয়ে আটকে রেখে তার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। পরে ইতালি নেয়ার কথা বলে গত ২১ মে আরও তিন লাখ টাকা চেয়ে নেয় লুৎফুরের পিতা জমির আলী। টাকা নেয়ার পর লুৎফুর আমাদের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে ছেলের কোন খোঁজ পাইনি। পরে টিভিতে খবরে জানলাম আমার ছেলে উদ্ধার হয়েছে। এই ঘটনায় আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই।
শিপন অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসায় খুশি তার ভাই শোয়েব আহমেদ রিপন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই যে আমাদের মাঝে এসেছে এরজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। শিপনের জন্য আমার মা-বাবা রোজ কান্নাকাটি করতেন। মা-বাবা কতো রাত তার চিন্তায় ঘুমাননি।’
প্রতারিত ও অত্যাচারের শিকার হওয়া যুবক শিপন আহমেদ আর কোন বাংলাদেশীকে সমুদ্রপথে বিদেশ না যেতে আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন ‘আমি সারাদিন যদি কথা বলি তবুও বুঝাতে পারবোনা যে আমি কতো বড় বিপদে ছিলাম। এমন পরিস্থিতির শিকার আল্লাহ যেনো আর কাউকে না করান। যারা বিদেশ যেতে চান তাদের কাছে আমি করজোড়ে অনুরোধ করি, তারা যেনো পরিবারের সাথে থাকেন। নিজের পরিবারের সাথে অভাব অনটনেও কষ্ট করে থাকা অনেক সুখের। কখনোই নিজের পরিচিত কারো মাধ্যমে নৌ পথে কোন দেশে যেতে রাজি না হতে অনুরোধ জানান তিনি।’
শিপন তার পরিবারে ৪ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। বাকি ৩ ভাই বাড়িতেই থাকেন। বর্তমানে তার পরিবার প্রকটভাবে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন।