উন্নত চিকিৎসার জন্য ওবায়দুল কাদের সিঙ্গাপুরে

68

কাজিরবাজার ডেস্ক :
গুরুতর অসুস্থ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়েছে। ভারতের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠী সোমবার দুপুরে হাসপাতালে ওবায়দুল কাদেরকে দেখার পরই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চিকিৎসকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পর বিকেল সোয়া চারটায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের এয়ার এ্যাম্বুলেন্স সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদেরকে নিয়ে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে। সেখানে তাঁকে সিঙ্গাপুরে নেয়ার জন্য রবিবার থেকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত ছিল। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও ওবায়দুল কাদের এখনও ঝুঁকিমুক্ত নন বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডাঃ কনক কান্তি বড়ুয়া।
স্ত্রী ইশরাতুন্নেসা কাদের এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের অধ্যাপক ডাঃ আবু নাসের রিজভী সিঙ্গাপুরে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে রয়েছেন। আর ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুরের পথে কাদেরকে নিয়ে যাওয়ার সময় এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের দুজন চিকিৎসক, একজন নার্স ও একজন টেকনিশিয়ান। রবিবার সন্ধ্যায় এয়ার এ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে তারা ঢাকায় এসেছিলেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান এবং পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ও দলের উপদফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ বিমানবন্দরে দলের সাধারণ সম্পাদককে বিদায় জানাতে উপস্থিত ছিলেন।
ডাঃ দেবী শেঠীর জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটার নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন পিছিয়ে বেলা আড়াইটায় অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া এবং কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। তবে ওই সংবাদ সম্মেলনে ডাঃ দেবী শেঠী উপস্থিত ছিলেন না।
ডাঃ দেবী শেঠীকে উদ্ধৃত করে অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারতের নামকরা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠী ওবায়দুল কাদেরকে দেখেছেন। সর্বশেষ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার পর তিনি মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন। দেবী শেঠী বলেছেন, আপনারা যে চিকিৎসা দিয়েছেন, চমৎকার চিকিৎসা হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা হলেও একই চিকিৎসা হতো। এই রোগে এর বেশি কিছু করা সম্ভব না। ওনার অবস্থা কালকের চেয়ে মোটামুটি ভাল। তবে তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন। কালকের চেয়ে অবস্থা ভাল হওয়ার কারণে তাকে আজ শিফট করা যেতে পারে। কারণ, এর চেয়ে অবস্থা খারাপ হলে তখন আর শিফট করা যাবে না। তার এখনও ঝুঁকি আছে। তবে এ অবস্থায় চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে শিফট করা যাবে বলে জানান অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া। ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক জটিলতার বিষয়ে এবং তিনি ঝুঁকিমুক্ত কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, তার ডায়াবেটিক অনিয়মিত পরীক্ষা করা হতো। আগেও হার্ট এ্যাটাক করেছিল। এরপর ঠিকভাবে শরীর চেকআপ করা হয়নি। তাঁর রক্তে ইনফেকশনের ব্যাপার আছে। সেটাও বেড়ে গেছে। তাঁকে শিফট করার এখনই ভাল সময়।
সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সৈয়দ আলী আহসান বলেন, আজ (সোমবার) সকাল নয়টার পর থেকে তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল। প্রেসার ১১০ থেকে ৭০ হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ১২০-১৩০ হচ্ছে। ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালান্সের যে বিষয়টি ছিল, সেটাও এখন নরমাল। তাঁর হাই ব্লাড সুগার ছিল, সেটাও নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানান সৈয়দ আলী আহসান।
আগেও ওবায়দুল কাদেরের হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল : সোমবার বেলা আড়াইটায় সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ওবায়দুল কাদেরের ডায়াবেটিস ছিল অনিয়ন্ত্রিত। এর আগেও তাঁর হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল। ওনাকে স্ট্যান্টিং করার জন্য আগেও পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। গত ২০ ডিসেম্বর আমার এখানে আসার পর আমি একটা মেডিক্যাল বোর্ড করে ওনাকে পরামর্শ দেই। ওই সময় আমার মেডিক্যাল বোর্ড তাঁকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে ভর্তি থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ইলেকশন ৩০ তারিখে। ইলেকশনের পর পরেই এসে ভর্তি হবেন বলে জানিয়েছিলেন ওবায়দুল কাদের। তারপরেও ওনার সঙ্গে দেখা হলে ওনাকে অনুরোধ করেছিলাম আমরা। কিন্তু তিনি নিজেকে সুস্থ ও ভাল আছেন বলে জানিয়ে একসময় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা বলতেন। ওবায়দুল কাদেরের ফুসফুসেও সমস্যা রয়েছে বলে জানান অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া।
ওবায়দুল কাদেরকে দেখেন ডাঃ দেবী শেঠী : হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অবস্থা দেখতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে যান ভারতের বিখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন দেবী প্রসাদ শেঠী। বেলা দেড়টায় দেবী শেঠী ওবায়দুল কাদের দেখতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ নেতাকে দেখেন এবং সব কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের প্রিভেনটিভ এ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ হারিসুল হক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ সোমবার দুপুরে শাহজালাল বিমানবন্দরে ডাঃ শেঠীকে স্বাগত জানান। তারপর তারা সরাসরি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে যান। ভারতের নারায়ণ ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেসের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ দেবী শেঠীর ১৫ হাজারের বেশি অস্ত্রোপচার করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। স্বল্প খরচে হৃদরোগের চিকিৎসা দেয়ার উদ্যোগ নিয়ে আলোচিত এই চিকিৎসককে ২০১২ সালে পদ্মভূষণ খেতাবে ভূষিত করে ভারত সরকার।
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা : ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসায় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ রবিবারই একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে। কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে এই বোর্ডে রয়েছেন প্রিভনটিভ এ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হারিসুল হক, অধ্যাপক চৌধুরী মেশকাত আহমেদ চৌধুরী, এ্যানেসথেশিয়া বিভাগের অধ্যাপক দেবব্রত ভৌমিক, অধ্যাপক একেএম আক্তারুজ্জামান, কার্ডিও সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক মোঃ রেজওয়ানুল হক, অধ্যাপক অসিত বরণ অধিকারী, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান ও তানিয়া সাজ্জাদ।
হাসপাতালে ভিড় জমায় দলীয় নেতাকর্মীরা : প্রিয় নেতাকে দেখতে ও খোঁজখবর নিতে সোমবারও বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভিড় জমায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এদিন সকাল থেকে নেতাকর্মীদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কনক কান্তি বড়ুয়া রবিবার রাতে নেতাকর্মীদের হাসপাতালে ভিড় না করার আহ্বান জানান। আর হাসপাতালে ভিড় না জমানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব কিছুর পরও হাসপাতালের দলীয় নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীদের ভিড় ছিল বেশ চোখে পড়ার মতো। তবে দোতলায় কার্ডিয়াক ইউনিটের সিসিইউর বারান্দায় যেখানে রোগীদের স্বজনদের বসার জায়গা, সোমবার সকালে সেখান থেকে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, প্রিয় নেতা কেমন আছেন, সেটা জানার জন্যই তারা হাসপাতালের সামনে এসে অপেক্ষা করছেন। সোমবারও সকালেও ভিড় না করার আহ্বান জানিয়ে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কনক কান্তি বড়ুয়া উপস্থিত সকলের উদ্দেশে বলেন, আমাদের কার্ডিয়াক ইউনিটে ভর্তি প্রত্যেক রোগীর অবস্থা খুবই সেনসিটিভ। তাদের প্রত্যেকেরই ইনফেকশনের ঝুঁকি রয়েছে। তাই নেতাকর্মীরা কেউই হাসপাতালে এসে ভিড় করবেন না। তার জন্য সবাই নিজ বাসায় থেকে দোয়া করুন। দলীয় নেতাকর্মীদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানান উপাচার্য।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালরে উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেন, সেতুমন্ত্রীর তিনটি রক্তনালীতে ব্লক ধরা পড়েছে, যার একটি স্টেন্টিংয়ের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়েছে। রবিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে হঠাৎ অসুস্থবোধ করলে ওবায়দুল কাদেরকে বিএসএমএমইউর ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) নেয়া হয়। সেখান থেকে জরুরী ভিত্তিতে তাকে সিসিইউতে (করোনারি কেয়ার ইউনিট) নিয়ে ভর্তি করা হয়। পরে এনজিওগ্রাম করলে হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ার কথা জানান সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।