ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল পাস

32

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। তবে মন্ত্রিসভায় যে খড়সা আইনটি অনুমোদন করা হয়েছিল, তার বেশ কিছু সংশোধন করে বিলটি সংসদে আনা হয়েছে বলে জানান তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জাব্বার।
বিশেষ করে গণমাধ্যম কর্মীরা যে ৩২ ধারা নিয়ে উৎকণ্ঠিত ছিলেন, সেটি এই বিলে নেই। তবে এর বদলে অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের কথা বলা আছে।
বুধবার সংসদে বিলটি পাসের জন্য সংসদে তোলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ইরমান আহমেদ। পরে নানা প্রক্রিয়া শেষে বিলটি পাসের জন্য ভোটে দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
গত ২৯ জানুয়ারি এই আইনটির খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর থেকেই তুমুল বিতর্ক হয়। বিশেষ করে অনুমতি ছাড়া নথি বা তথ্য কমি করলে গুপ্তচর হিসেবে বিচার করা হবে-এমন একটি বিধান থাকায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হবে বলে সমালোচনা উঠে। আর এই ধারাসহ বেশ কিছু ধারা বাদ দিতে গণমাধ্যমকর্মীরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দেন দরবার করে। আর সরকারও তাদের মতামতের আলোকে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়।
গণমাধ্যমকর্মীদের পাশাপাশি বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররাও বিভিন্ন সংশোধনীর প্রস্তাব করে সরকারের কাছে। আর গত গত ৯ এপ্রিল তা সংসদে উত্থাপন করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার।
খসড়া আইনটি সংসদে তোলার পর তা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটিকে প্রথমে চার সপ্তাহ দেওয়া হলেও পরে দুই দফায় তিন মাস সময় বাড়িয়ে নেয় তারা। তবে শেষ দফায় এক মাস সময় নিলেও একদিনের মধ্যে দিন পরেই বৈঠক করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে সংসদীয় কমিটি।
প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে দুই দফায় সম্পাদক পরিষদ, টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সঙ্গে বৈঠক করে সংসদীয় কমিটি; তবে তাতেও উদ্বেগ প্রশমিত হয়নি।
সংসদীয় কমিটিতে সম্পাদক পরিষদ খসড়া আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ধারার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপত্তি জানায়।
বিলটিকে মত প্রকাশ, মুক্ত চিন্তা, বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী উল্লেখ করে বিলটি পাস না করে জনমত যাচাই এবং বাছাই কমিটিতে পাঠানোর দাবি জানান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম, নুরুল ইসলাম মিলন, নুরে হাসনা লিলি চৌধুরী, মাহজাবিন মোর্শেদ, রওশন আরা মান্নান, শামীম হায়দার পাটোয়ারি, মোহাম্মদ নোমান ও সেলিম উদ্দিন।
ফখরুল ইমাম বলেন, ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটি অ্যাক্ট এই বিলের মাধ্যমে আবার পাস করা হচ্ছে। এটি ঔপনিবেশিক আমলের নির্যাতনমূলক আইন।
রওশন আরা মান্নান বলেন, ‘এই আইনটি নিয়ে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী, আইন বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিকদেরকে নিয়ে আপত্তি এবং উদ্বেগ আছে। এটি পাস হলে মুক্ত চিন্তা, বাক স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। এসব আপত্তি দেখা দরকার ছিল।’
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, এই বিলটি পাস হলে ৫৭ ধারার ভীতি এখানে আরও কঠিনভাবে দেখা দেবে। এখানে তদন্ত কর্মকর্তাকে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
এই বিলটি মিডিয়াকে ক্ষুব্ধ করবে বলেও সতর্ক করেন জাতীয় পার্টির এই নেতা। বলেন, ‘সামনে ভোট। এই সময় একটি বিশাল প্রগতিশীল কমিউনিটিকে ক্ষুব্ধ করা উচিত হবে না। ’
মো নোমান বলেন, ‘একদিকে মত প্রকাশের অধিকার দেবেন, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণ করবেন- এটা তো হতে পারে না। এখানে বলা আছে, কতিপয় মতামত ব্লক করার ক্ষমতা দেয়া হবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কোনো বিষয় প্রতীয়মান হতেই পারে।’
পরে মন্ত্রী মোস্তফা জাব্বার বলেন, ‘নাসিরনগর, রামু, বগুড়ায় কী ঘটনা ঘটেছে? সাম্প্রতিককালে ছাত্র আন্দোলনের নামে কী ঘটনা ঘটেছে, সেটা যদি বিবেচনায় আনা হয়, তাহলে এই বিলটির যৌক্তিকতা প্রমাণ হয়।’
এই বিল নিয়ে উদ্বেগের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। আর সরকার তাদের মতামতগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে।
‘যেসব সংশোধনী করা দরকার বলে তারা যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, তার সবই এখানে আনা হয়েছে। সাংবাদিক নেতারা আমাদের সঙ্গে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে, সংসদীয় কমিটির সঙ্গে আলোচনায় যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন, সম্ভবত সেসব কথা ভুলে গেছেন। নইলে এখন এই বিলের সমালোচনা করতেন না তারা।’
মন্ত্রী বলেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য এখানে ৫৭ ধারা বাতিল হয়েছে। সাংবাদিকরা আপত্তি করেছেন ৩২ ধারা নিয়ে। তারা গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলেছিলেন, সংসদীয় কমিটি সেটা বাদ দিয়ে অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট সংযোজন করা হয়েছে।’
‘অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের কোনো অপব্যবহারের নজির নেই। কোনো মামলাও হয়নি।’
জাব্বার বলেন, ‘আমরা লাইন বাই লাইন সাংবাদিকদের কাছে উপস্থাপন করেছি এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেই বিলে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
সংবাদপত্র দমন এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য এই আইন নয় জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, কাগজ ও সম্প্রচার মিডিয়ার জন্য অন্য আইন আছে। এই আইন ডিজিটাল অপরাধ দমনের জন্য। মতামত প্রকাশের জন্য যাতে কোনো সমস্যা না হয় সে জন্য তথ্য অধিকার আইন এখানে সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এরপর জনমত যাচাই এবং বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়।
এরপর শামীম হায়দার পাটোয়ারি, রওশন আরা মান্নান ও ফখরুল ইমাম বিলে কিছু সংশোধনী আনেন।
পাটোয়ারী বলেন, বিল অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কিছু লিখলে শাস্তি হবে। আমি যদি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে অ্যাকাডেমিক কোনো কিছু লেখি, তাহলে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’
ফখরুল ইমাম বলেন, ‘২০১৮ সালে ওনি নিয়ে এসেছেন ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট। …৩২ দফা পুরোটাই বর্জন করতে হবে। এটা পুরোটাই নির্যাতনমূলক।…৫৭ ধারায় বলা আছে, সরল বিশ্বাসে যদি কেউ কাজ করে, তাহলে তার কিছু হবে না। এই ধারাটি সঠিক নয়।’
পরে মন্ত্রী মোস্তফা জাব্বার বলেন, এসব সংশোধনীর একটাও গ্রহণযোগ্য নয়।
পরে কণ্ঠভোটে বেশিরভাগ সংশোধনীই বাতিল হয়। আর পরে বিলটি পাসের জন্য তোলা হলে সর্বসম্মতিতে বিলটি পাস হয়।