এমরান আহমদ
ভালোবাসা কখনই শেষ হবার নয়, আর কখনো শেষ হয় না। জনম জনম রবে এই ভালবাসা। ভালোবাসটা স্বর্গ থেকে আসে আবার স্বর্গেই চলে যায়। প্রেম মানুষের জীবনে একবারই আসে। সত্যিকারের ভালবাসা একবারই আসে। আর মানুষ একবারই প্রেমে পড়ে। কেউ চাইলে কারো প্রেমে পড়তে পারে না। এটা সক্রিয়ভাবেই অনুভ’ত হয়। আর এই প্রেম-ভালোবাসা যদি থেকে যায় অপূর্ণ। তাকে বলা যেতেই পারে অপূর্ণ ভালোবাসা।
রাজ নি¤œবিত্ত নয়, আবার মধ্যবিত্তও নয়, এর ঠিক মাঝামাঝি পরিবারের সন্তান। ৫ ভাইবোনের মধ্যে সে সবার ছোট। ছোট হিসেবেই সবার কাছে আদরের বটে। বাবা অকালেই চলে যাওয়ার পর পরিবারের হাল ধরেন বড়ভাই। টেনে পরিবারটাকে একটি ভিত্তের মধ্যে নিয়ে যান। এক সময় বোনদের বিয়ে হয়। ভাইও বিয়ে করেন। সব পরিবারেই পারিবারিক কলহ রয়েছে। ঠিক সেই রকম এক কলহের কারণেই আলাদা হয়ে যায় তার ভাই। সংসারের হাল ধরতে হয় রাজকে। যে সময়টাতে তাকে খেলাধূলা আর লেখাপড়ার কথা ঠিক সেই সময়ই তাকে বেঁচে থাকার তাগিদে নেমে পড়তে হয় কাজের সন্ধানে। তার পরিবার বলতে সে এবং তার একমাত্র মা। তার মা’ই তার জীবন। অনেক সুখেই চলে তাদের এই ছোট্ট সংসার।
আর এই জীবন সংগ্রামের মধ্যেই নিজের অজান্তে প্রেমের সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দেয় রাজ। এটাই ছিল তার জীবনের প্রথম এবং শেষ প্রেম। তথ্য প্রযুক্তির এই বিশ্বে মোবাইল ব্যবহার যতদিন যাচ্ছে তথই বেড়েই চলেছে। মোবাইল ফোন যতটা উপকারী ঠিক তার বিপরীতে অপকারিতাও রয়েছে। আর সেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিচয়, পরিণয় এবং বিচ্ছেদ।
রাজধানী ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে চাঁদনী। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। অনেক আদরেরও বটে। খেলাপড়ার পাশাপাশি পারিবারিক অনেক কাজেই তার সহযোগিতার কমতি নেই। সেই তথ্য প্রযুক্তির জোরেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় রাজের।
তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকাল ৪ টা। হাঠৎ রাজের মোবাইল ফোনটা ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠল। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলল। ওপাশ থেকে প্রথম ১০ সেন্ডের মতো কোন শব্দ নেই। শুধু নিরবেই রাজের হ্যালো শুনে যাচ্ছিলো চাঁদনী। ঠিক ১০ সেকেন্ড পর ওপাশ থেকে রাজের কানে আসে হ্যালো। রাজ থমকে দাঁড়ায়। এতো সুমধুর কন্ঠ সে আগে কখনো শুনেনি। তখনই রাজ প্রশ্নের বানে জর্জরিত করল চাঁদনীকে। হ্যালো কে বলছেন?, কোথা থেকে বলছেন? কেন ফোন করেছেন? ইত্যাদি।
ফোনের অপাশ থেকে চাঁদনী রাজের এই নাম্বারটা একটা মেগাজিনের মধ্যে পেয়েছে এবং কৌতুহলবশত সে ফোন করেছে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হয়। এরকম দু’ একটা কথা বলেই তাদের বিদায়। কিন্তু এই দু একট কথায় রাজের হৃদয়ে ঢেউ তুলে গেছে।
রাজ বেশ কিছুদিন আগে একটি পত্রিকার মেগাজিনে কৌতুক পাঠায়। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সেই কৌতুকটি প্রকাশ করে। যা রাজ নিজেও জানে না। পরবর্তীতে রাজ ওই মেগাজিন দেখে বিষয়টি নিশ্চিত হয়। পরবর্তীতে সন্ধ্যায় আবার রাজ নিজে থেকেই চাঁদনীকে ফোন করে বিষয়টি খুলে বলে। এই নিয়ে তাদের মধ্যে কথা বিনিময় হয়। একদিন দুইদিন এরকম তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন কথা হয়। এক পর্যায়ে নিজেদের অজান্তেই ‘স্বর্গ থেকে আসা প্রেমে’ পড়ে যায় দু’জন। একে অপরের সুখ-দু:খের কথামালা বিনিময় করে। চাঁদনী সকালে কলেজে যায়, দুপুরে ফিরেই বাকি সময় চার দেওয়ালের মধ্যেই জীবনটাকে সাজানোর চেষ্টা করে। নিজের যতটুকু স্বপ্ন তার চেয়ে কম পেয়েছে।
দু’জনের মধ্যে ভালোবাসার কমতি ছিল না। একে অপরে না দেখেই গভীর প্রেমে জড়িয়ে পড়ে দুজন। একদিন চাঁদনী রাজকে প্রশ্ন করে আমরা সারা জীবন একসাথে থাকতে পারবো। সুখের একটি সংসার হবে আমাদের। আমারতো অনেক স্বপ্ন। তোমাকে নিয়ে আমার ভুবনের স্বপ্নগুলো মনের ক্যানভাসে সাজিয়ে রেখেছি। ‘আমি সকালে ঘুম থেকে ফ্রেশ হয়ে তোমার জন্য নাস্তা তৈরি করব। তোমাকে বার বার ঘুম থেকৈ উঠার জন্য ধাক্কা দেব। কিছু দুষ্টুমি করে তোমার ঘুম ভাঙাবো। তুমি ঘুম থেকে ফ্রেশ হবে। তারপর দুজন একসাথে নাস্তা করব। তুমি রেডি হয়ে অফিসে যাবে, তার পর আমি পুরোদস্তুর গৃহিনী হবো। দুপুরে তুমি বাসায় আসবে না। ফোন করে তোমাকে দুপুরের খাবার খেয়েছো কিনা প্রশ্ন করব। তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার তাগিদ দেব। রাতে বাসায় ফিরে আসলে এক সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাবো। তুমি আমার কোলে মাথা রাখবে, আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব ইত্যাদি।
তখন রাজ চাঁদনীকে প্রশ্ন করে তুমি যে স্বপ্ন দেখছো আমিও সে রকম স্বপ্ন দেখি। আমাদের সন্তানকে নিয়ে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছে। আমার পিঠে করে সন্তান চড়ে বেড়াচ্ছে। তুমি মাঝে দুষ্ঠুমি করছ ইত্যাদি। রাজ বলে হ্যাঁ আমরা স্বপ্ন দেখতেই পারি। স্বপ্ন দেখাতো অন্যায় কিছু নয়। সেই স্বপ্নকে বাস্তব করতে হবে। চাঁদনী বলে উঠে কিভাবে? রাজ বলে সময় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন চাঁদনী বলে, সময় মনে হয় কখনো হবে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমার পরিবার। আমার পরিবার চাইবে না, আমি দূরে কোথাও যাই। তখন রাজ চাঁদনীকে প্রশ্ন করে, পরিবারের মধ্যে তুমি কাকে বেশি ভয় পাও? তখন চাদনী বলে আমার আম্মুকে। কেন? তখন রাজ বলে তোমার আম্মুর সঙ্গে আমি কথা বলব। চাঁদনী বলে কিভাবে। রাজ বলে তোমার আম্মুর মোবাইল নাম্বারটা আমাকে দেবে। পরে যা করার আমি করব।
রাজ চাঁদনীর মাকে ফোন দিয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে এবং একটি আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে। আর সেই আতœীয়তার বন্ধনেই রাজ এবং চাঁদনীর প্রথম দেখা হয়। সময়টা ঈদের কয়েকদিন পরই রাজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ঢাকায় এ নিয়ে রাজ দ্বিতীয়বার যাবে। ঠিক মতো রাস্তাঘাটই চিনে না। অথচ প্রেমের টানে ভালোবাসার মানুষের টানে অজানা শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছে।
ঢাকায় পৌছেই চাঁদনীর বাড়ির পাশেই একটি হোটেলে উঠে রাজ। চাঁদনীর সঙ্গে চলছে ফোনে কথা। রাজ তখন চাঁদনীর আম্মুকে ফোন দিয়ে বলে, আমি একটা কাজে ঢাকায় এসেছি। তো আসলাম যেহেতু তাই আপনার সাথে দেখা করতে চাই। তখন বললেন তোমাকে কিছুক্ষণ পর তোমার আঙ্কেল গিয়ে নিয়ে আসবেন। রাজ তার অবস্থানের কথা চাঁদনীর আম্মুকে জানায়। তখন চাঁদনীর বাবা রাজকে নিয়ে তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হন। রাজ চাঁদনীর বাবার পেছন পেছন অন্ধকার গলির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে আর ভাবছে, আমি যেন তার দেখা পাই। এক সময় বাসায় পৌছে রাজ। চাঁদনীর আম্মু ও আব্বু ও ছোট ভাইয়ের সাথে তার কথা হয়। কিন্তু যাকে দেখার জন্য এতোদূর আসা তাকে চিনবে কি করে। কারণ তারা দুই বোন দেড় বছরের ছোট বড়। তাদেরকে দেখে বুঝার উপায় নেই কোনটা বড় কোনটা ছোট। কিছুক্ষণ পর আসে সেই কাক্সিক্ষতক্ষণ। চাঁদনী ও তার বোন শ্রাবনী চা নিয়ে এসেছে। চাঁদনীর আম্মু পরিচয় করিয়ে দেবার আগে নিজের ভালোবাসার মানুষকে চিনতে ভুল করেনি রাজ। চোখের চাওয়ায় একে অপরের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খিত মুহূর্তের কাছাকাছি তারা। পরে চাঁদনীর আম্মু তাদের সাথে রাজের পরিচয় করিয়ে দেন। রাতে খাবার দাবার পর বাসা থেকে চলে আসে রাজ। এভাবেই কয়েকবার তাদের দেখা হয়। কিন্তু কখনো চাঁদনীকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া হয়নি রাজের। চাঁদনীকে নিয়ে আইসক্রিম, বাদাম খাওয়া হয়নি রাজের। এভাবেই চলে যায় কয়েকটি বছর। বয়স বাড়তে থাকে, স্বপ্ন বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে তাদের ভালোবাসার পরিধি। হঠাৎ করেই চাঁদনীর জীবনে কিছুটা পরিবর্তন দেখতে পায় রাজ। সেই পরিবর্তনই যে রাজের জীবনকে নি:স্ব করে দেয়।
ঈদের ছুটিতে রাজ চাঁদনীর বাসায় যায়। আর সেখানেই একটি ছেলেকে দেখে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে রাজের মাথায়। চাঁদনী রাজকে তাদের বাসার জানালা দিয়ে একটি ছেলেকে দেখায়। রাজ তখন বুঝে উঠতে পারছিল না। কে সে? রাজ তখন প্রশ্ন করে কে ও। কেনই বা আমাকে দেখাচ্ছো। তখন চাঁদনী তাকে জানায় ওই ছেলেটির সাথেই তার বিয়ে হবে। রাজকে ভালোবাসতে পারবে, কিন্তু কখনো তাকে পাওয়া হবে না। কারণ তার পরিবার সেটা মেনে নেবে না। এমন কথা শুনে রাজ আর সহ্য করতে পারেনি। ঠিক ওই মুহূর্তেই চলে আসে তাদের বাসা থেকে।
এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। চাঁদনীর মায়ের সঙ্গে রাজের মাঝে মধ্যে যোগাযোগ হয়। ঠিক আগের মতো না। সে দিনের পর থেকে চাঁদনীকে আর একটি বারের জন্য দেখতে পারেনি রাজ। কিন্তু চাঁদনীকে ছেড়ে থাকতে রাজের খুব কষ্ট হয়। কষ্ট বুকে লালন করেই নিজের নতুন জীবন শুরু করে রাজ। পরিবারের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করে। এক পর্যায়ে রাজের একটি মেয়ে হয়। নিজের প্রথম ভালোবাসাকে কখনো যাতে ভুলতে না পারে সেজন্য নিজের প্রিয় সন্তানের নামটিই ভালোবাসার মানুষের নামে রাখে।
এসব ঘটনার প্রায় ৪ বছর পর হঠাৎ রাজের মোবাইলে একটি ফোন আসে। হ্যালো শব্দ শোনার পর থেকেই রাজের শরীর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। আর কোন কথা বলতে পারছিল না। এক পর্যায়ে রাজ শুধু একটি কথায় বলে, তুমি কেমন আছো। তখন চাঁদনী বলে ভালো আছি, তোমাকে ছেড়ে ভালো আছি, কিন্তু একটি বারের জন্য ভুলতে পারিনি। পারলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার অনুরোধ জানায়। চাঁদনীও রাজের মতো বিয়ে করেছে, একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে তারও। পরিবার নিয়ে অনেক সুখেই আছে। তবু প্রথম ভালো লাগা, ভালোবাসা জীবনের শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত ভুলা যায় না। রাজ ও চাঁদনীর মধ্যে পারিবারিক অনেক বিষয়ে কথা হয়। রাজ ও চাঁদনীর ভালোবাসা অসমাপ্তই থেকে যায়। এ ভালোবাসর কোন শেষ নেই, আজীবন তাদের এই ভালোবাসা বেঁচে থাকবে।