ইসলামী আইনে অমুসলিমদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার অধিকার

128

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
এ মন এক সময় এসেছিলো যখন সীমান্তের ব্যাপক অংশ জুড়ে অবিরাম যুদ্ধ চলছিল। অথচ সে সময়ে সামরিক বিভাগে চাকরি করে কেউ জীবিকা অর্জন করার কথা চিন্তাও করত না। কারণ সে সময়ে যুদ্ধে ঝুঁকির পরিমাণ ছিল বেশি। যারা সৈনিক হিসাবে যুদ্ধ করত তাদের আর্থিক অবস্থাও অসচ্ছল। আরবের অসংখ্য অমুসলিম হিসাবে যুদ্ধ করত তাদের আর্থিক অবস্থাও ছিল অসচ্ছল। আরবের অসংখ্য অমুসলিম তখন মুসলিম শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। তাদের শাসনকে মেনে নিয়েছিল অকপটে। তাছাড়া অন্য কারো সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদের উৎখাত করার কোন চিন্তাও তাদের ছিল না। তবু এ সমস্ত অমুসলিমদের সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে তাদেরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হত। অমুসলিমরা এতে বরং খুশি হত। অথচ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুসলমানদের ছুটে যেতে হত যুদ্ধের ময়দানে। এই অবসরে অমুসলিমরা নিজেদের কাজকর্ম ও ব্যবসা বাণিজ্য চালাতে পারত পুরো মাত্রায়। ফলে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হতো। বিনিময়ে তারা জিযিয়া নামে অতিরিক্ত একটি ট্যাক্স দিত। অবশ্য মহিলা শিশু এবং দরিদ্রদের জিযিরা প্রদান করতে হত না।
জিযিয়ার পরিমাণও ছিল যৎসামান্য। নবী করীম (সা:)-এর আমলে একজন অমুসলিমের বাৎসরিক জিযিয়ার পরিমাণ ছিল মাত্র ১০ দিরহাম। এটা ছিল মোটামুটিভাবে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের দশ দিনের খরচের সমান। তাছাড়া একজন অমুসলিম যদি বছরের কোন সময়ে কোন যুদ্ধে অংশ নিত তাহলে সেও ঐ বছরের জিযিয়া প্রদান করা থেকে অব্যাহতি পেত। ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মদীনা অথবা অন্য কোথাও জিযিয়া প্রদানের প্রচলন ছিল না। নবম হিজরীতে জিযিয়া সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হয়। বলা রাখা আবশ্যক যে, জিযিয়া ইসলামের অবশ্য পালনীয় কোন বিধান নয় বরং বিশেষ ব্যবস্থা ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে জিযিয়ার বিধান কার্যকর করা হয়। নিম্নের দুটি ঘটনা থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
ক. নবী করীম (সা:) এর এক ছেলের নাম ইবরাহীম (রা:)। তাঁর মা ছিলেন একজন মিশরীয় কিবতী মহিলা। ইবরাহীম (রা:) তখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। সে সময়ে নবী করিম (সা:) বলেছিলেন যে, যদি ইবরাহীম আরোগ্য লাভ করে তাহলে ইবরাহীমের মায়ের সম্মানে কিবতীদের জিযিয়া থেকে অব্যাহতি দেবেন।
খ. ফুসতাত (কায়রো) থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত একটি খাল ছিল। হযরত উমর (রা:)-এর শাসনামলে একজন অমুসলিম মিশরবাসী চমৎকার একটি পরিকল্পনা নেয়। সে প্রস্তাব দেয় যে, এ খালটি পুন:খনন করা হলে নৌপরিবহনের উন্নতি ঘটবে এবং মিশর থেকে মদীনায় খাদ্য-খাবার পাঠান অনেকখানি সহজতর হবে। সেই খালটির নামই নহরে আমিরুল মু’মিনীন। খলীফা তাঁর পরামর্শে খুশি হয়ে তাকে গোটা জীবনের জন্য জিযিয়া প্রদান করা থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন।
তাছাড়া বর্তমানে অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বিশ্বের সর্বত্র ইসলামের দাওয়াত পৌছে গেছে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান অমুসলিম শাসনাধীন অঞ্চলে বসবাস করে। এমতাবস্থায় খৃষ্টান, ইয়াহুদী, হিন্দু অথবা অন্যদের উপর যদি জিযিয়া আরো করা হয় তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই খৃষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর শাসনাধীন অঞ্চলে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে মুসলিম আইনবিদগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, জিযিয়া আরোপ করার সময় এ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে।
একটি হাদীসে এরূপ উল্লেখ আছে যে, নবী করীম (সা:) মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় হিজাজের খৃষ্টান ও ইয়াহুদী অধিবাসীদের অন্যত্র স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছিলেন। হাদীস শরীফে এ ধরনের নির্দেশ প্রদানের কোন কারণ উল্লেখ করা হযনি। তবে এটা স্পষ্ট যে, এ বিধানটি সর্বসাধারণের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। বরং কিছুসংখ্যক লোকের বিরুদ্ধে তাদের রাজনৈতিক আচরণের কারণে এরূপ অবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
বলে রাখা আবশ্যক যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে অনেক মুসলমানের দাস-দাসী ছিল অমুসলিম। তাদের অনেকেই মনিবের সঙ্গে মক্কা ও মদীনায় বসবাস করত। এ প্রসঙ্গে একজন খৃষ্টান চিকিৎসকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। পবিত্র কা’বা ঘরের মিনারের নিচেই ছিল তার চিকিৎসা কেন্দ্র (ইব্ন সা’দ) ঐতিহাসিক ইবন সা’দ আরো উল্লেখ করেছেন যে, জুফাইনা নামক একজন খৃষ্টান মদীনার একটি স্কুলের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাতেন।
পরিশেষে নবী করীম (সা:) এর আরো দুটি হাদীসের উল্লেখ করা যেতে পারে। আল-মাওয়ারদী থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সা:) মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় বলেছেন, আমার তরফ থেকে অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে, নিষ্ঠার সঙ্গে তা প্রতিপালন কর। তিনি আরো বলেছেন যে, কোন অমুসলিমের উপর যে নির্যাতন চালাবে, শেষ বিচার দবিসে সে আমাকে নির্যাতিতের পক্ষে সুপারিশকারী হিসাবে দেখতে পাবে (আবু দাউদ)। নবী করীম (সা:) আমাদের জন্য যে নির্দেশ রেখে গেছেন, নিজের জীবনে পরবর্তীকালের মুসলমানগণ এগুলোকেই আইন হিসাবে বিন্যস্ত করেছেন এবং বাস্তব জীবনে অনুসরণ করেছেন নিষ্ঠার সাথে। এখানে তার কিছু উদাহরণ উপস্থাপন করা হলো :
একবার মহান খলীফা হযরত উমর  (রা:) সিরিয়ার গভর্ণরকে রাজস্বের হিসাব সংরক্ষণের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ একজন গ্রীক অধিবাসীকে মদীনায় পাঠানোর নির্দেশ প্রযোজ্য। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার-উপযোগী একটি বিখ্যাত আইন গ্রন্থের নাম হিদায়া। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যে কোন প্রকার নিন্দা বা অপবাদ সেটা মুসলমান অথবা জিম্মী (অমুসলিম) যারা বিরুদ্ধেই হোক না কেন, তা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। ‘বাহর আর রায়ক’ নামক আইন গ্রন্থে আরো উল্লেখ আছে যে, একজন মৃত মুসলমানের দেহাবশেষ যেভাবে সম্মান করতে হয় তেমনি সম্মান করতে হয় একজন অমুসলিম (জিম্মী)-এর মৃতের দেহাবশেষকে। তাকে কোনভাবেই অপবিত্র করা যাবে না। কারণ কোন অমুসলিমকে যদি জীবদ্দশায় নিরাপত্তা দেওয়া হয়, হিফাজত করা হয় অন্যায় অপবাদ থেকে তাহলে তার মৃত্যুর পর সকল প্রকার অপবাদ অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করাটাও বাধ্যতামূলক। ফকীহগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যেমন শাস্তি সে পেত একজন মুসলিম রমনীর অমর্যাদা করলে। এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদগণের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই।
খলীফা হযরত উমর (রা:)-এর আমলের ঘটনা। কিছুসংখ্যক মুসলমান একজন ইয়াহুদীর জমিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। খলীফা উমর (রা:)-এর কাছে এ সংবাদ পৌছে, তখন তিনি মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলার এবং উক্ত জমিখন্ড ইয়াহুদী মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে লেবাননের খৃষ্টান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কারদাহী লিখেছেন : বায়তুল ইয়াহুদীর সেই বাড়িটি এখনও বিদ্যমান রয়েছে (প্রাইভেট ইন্টারন্যাশনাল ল অফ ইসলাম, লেকচার সিরিজ, দি হেগ, ১৯৩৩)। দামেশকের প্রধান মসজিদ সম্পর্কেও অনুরূপ একটি মশহুর কাহিনী রয়েছে। ইবনে কাছীর এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকের বর্ণনায় বিষয়টি স্থান পেয়েছে ঘটনাটি এ রকম- একজন উমাইয়া খলীফা একটি মসজিদ সম্প্রসারণের সুবিধার্থে পার্শ্ববর্তী একটি চার্চ দখল করেন। পরবর্তীতে এ অভিযোগটি খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীযের নিকট উপস্থাপন করা হয়। তৎক্ষণাৎ তিনি এ মর্মে নির্দেশ জারি করেন যে, গীর্জার যে অংশে বলপূর্বক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে, তা ভেঙ্গে ফেলতে হবে এবং উক্ত স্থান গীর্জার জন্য নির্ধারিত থাকবে। যা হোক পরবর্তীতে খৃষ্টানরা অর্থের বিনিময়ে উক্ত ভূমিখন্ডের মালিকানা প্রত্যাহার করে নেয় এবং এভাবেই উভয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এখানে হযরত উমর ইব্ন আবদুল আযীয-এর আরেকটি নির্দেশনামার উল্লেখ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে ইব্ন সা’দের ইতিহাসে গ্রন্থে। গভর্ণর আদি বিন আরতাতকে এ মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, অমুসলিমদের প্রতি নজর দাও এবং তাদের সঙ্গে বিনয় নম্র ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ যদি বার্ধক্যে পৌছে এবং নিজের বিষয় সম্পদ না থাকে, তাহলে তার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা নেওয়া তোমার দায়িত্ব। যদি তার কোন আপনজন থাকে, তবে তার কাছ থেকে ভরণ-পোষণ বাবদ অর্থ আদায় কর। যদি কেউ তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করে তাহলে প্রতিশোধ নাও। আমি জানতে পেরেছি তুমি আমদানিকৃত মদের এক দশমাংশ আদায় কর এবং তা সরকারী কোষাগারে জমা দাও। স্মরণ রেখো যে, এই কোষাগার তোমারও নয়, আমারর নয়। এর মালিকানা আল্লাহর। আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি যে, এ জাতীয় সম্পদ-এর পরিমাণ যত সামান্যই হোক না কেন, আর কখনো তা সরকারী কোষাগারে জমা নেবে না। যদি তুমি সম্পদের পবিত্রতা সম্পর্কে নিশ্চিত হও তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এখানে উমর ইব্ন আবদুল আযীযের আরো একটি পত্রের উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। পত্রের বিষয়বস্তু এ রকম : পুরাতন নথি-পত্রগুলো পর্যালোচনা কর। অন্যায়ভাবে কর আরোপ সংক্রান্ত উত্থাপিত আপত্তি এবং অন্যায় অবিচার করলে তার সংশোধন কর এবং প্রত্যেককেই তার ন্যায্য পাওনা ভোগ করতে দাও। অত্যাচার জর্জরিত কোন লোক যদি মারা যায় তাহলে তার উত্তরাধিকারীর নিকট তার পাওনা হস্তান্তর কর। এটা সকলের জানা কথা যে, কোনকিছু ক্রয় বা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দূরের লোক অপেক্ষা প্রতিবেশীরা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। ফকীহগণও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। এটা অমুসলিমদের ক্ষেত্রেও একটি স্বীকৃত নীতি। অমুসলিমদের এমন কতকগুলো রীতিনীতি বা প্রথা আছে যেগুলো ইসলামী আক্বীদা বা আচার-আচরণের পরিপন্থী। তদসত্ত্বেও ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমরা এ সমস্ত রীতিনীতি বা প্রথা মেনে চলার অধিকার ভোগ করে থাকে। যেমন- মদ্যপান মুসলমানদের জন্য হারাম। অথচ অমুসলিম নাগরিকরা ইচ্ছামত মদ্যপান করতে পারে। এমনকি মদ আমদানি, উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ পেয়ে থাকে। অনুরূপভাবে তারা জুয়া খেলতে, নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করতে ও সুদী কারবারে লিপ্ত হতে পারে। অথচ অমুসলমানদের জন্য এসবকিছু নিষিদ্ধ বা হারাম।
ইসলামের প্রথম যামানায় অমুসলিমদের এ সমস্ত অনৈসলামিক কাজকর্ম মুসলমানদের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারত না। এমনকি এ সমস্ত বিষয়ের প্রতি মুসলমানরা বড় একটা আমলও দিত না। তবে আধুনিক আইন বিশারদগণের মতে সুখী সমাজ ও সুন্দর বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য মদের ব্যবসা বা মদ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকলে চলবে না, সমাজের গোটা জনগোষ্ঠীর উপর এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করা আবশ্যক। এ ব্যাপারে অমুসলিম চিন্তাবিদগণও অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। তদনুসারে একজন খৃষ্টানকে মদীনায় পাঠনো হল এবং তাকে নিয়োগ করা হলো রাজস্ব প্রশাসনের প্রধান হিসাবে (দ্র. আল-বালাযুরী, আনসা)
এমনকি কখনো কখনো খলীফা হযরত উমর (রা:) অমুসলিমদের সঙ্গে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনেতিক, প্রশাসনিক বিষয়ে আলোচনা করতেন। ইসলামে ইমামের (মসজিদের ইমাম) পদটি মুসলমানদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। ইসলাম আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব জীবনের মধ্যে সমন্বয়ের বিধান দিয়েছে। সে কারণেই নামাযে ইমামতি করা রাষ্ট্রপ্রধানের যেমন দায়িত্ব তেমনি এটা তার একটি অধিকার। এভাবে যদি বিষয়টি বিবেচনা করা হয় তাহলে কোন অমুসলিম মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হতে পারেন না। বস্তুতপক্ষে এটা একটা ব্যতিক্রম। এর অর্থ এই নয় যে, দেশের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্মকান্ড থেকে অমুসলিম নাগরিককে বাদ দিতে হবে।
খলীফাগণের আমল থেকেই মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমরা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে, এমনকি মন্ত্রীর পদ-মর্যাদার নিয়োগ পেয়েছেন। শাফি’ঈ মযহাবের আল-মাওয়ারদী এবং হাম্বলী মযহাবের আবু ইয়া’লা আল-র্ফারা খলীফা কর্তৃক অমুসলিম নাগরিককে মন্ত্রী হিসেবে এবং নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ সমর্থন করেছেন। প্রিয়নবী (সা:) নিজেই একজন অমুসলিমকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। বিশ্বের দরবারে যে সমস্ত দেশ ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ধারক বলে পরিচিত সে সমস্ত দেশেও এরূপ নজীর পাওয়া যাবে না।
ইসলামের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে অমুসলিমদেরকে সামাজিক এবং বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কুরআনুল করীমে উল্লেখ আছে যে, তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি এর পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সমর্থক ও সংস্কারকরূপে। সুতরাং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে তুমি তাদের বিচার নিষ্পত্তি করবে এবং যে সত্য তোমার নিকট এসেছে তা ত্যাগ করে তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করবে না (৫ ঃ ৪২-৪৮)।
কুরআনুল করীমের এই নির্দেশের প্রেক্ষিতেই নবী করীম (সা:) এবং খলীফাগণ ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদের বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাধিকার প্রদান করেছিলেন। তারা স্বাধিকার ভোগ করেছিল দেওয়ানী, ফৌজদারী, ব্যক্তি আইন প্রভৃতি সকল বিষয়ে। খলীফাগণের সমসাময়িক কালে খৃষ্টানদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, মুসলিম শাসনামলে খৃষ্টান যাজকদের বিচারের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার-উপযোগী একটি বিখ্যাত আইন গ্রন্থের নাম হিদায়া। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যে কোন প্রকার নিন্দা বা অপবাদ সেটা মুসলমান অথবা জিম্মী (অমুসলিম) যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন, তা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। ‘বাহর আর রায়ক’ নামক আইন গ্রন্থে আরো উল্লেখ আছে যে, একজন মৃত মুসলমানের দেহাবশেষ যেভাবে সম্মান করতে হয় তেমনি সম্মান করতে হয় একজন অমুসলিম (জিম্মী)-এর মৃতের দেহাবশেষকে। তাকে কোনভাবেই অপবিত্র করা যাবে না। কারণ কোন অমুসলিমকে যদি জীবদ্দশায় নিরাপত্তা দেওয়া হয়, হিফাজত করা হয় অন্যায় অপবাদ থেকে তাহলে তার মৃত্যুর পর সকল প্রকার অপবাদ অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করাটাও বাধ্যতামূলক। ফকীহগণ ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন যে, একজন মুসলিম কোন অমুসলিম রমনীর অমর্যাদা করলে সে তেমন শাস্তি পাবে যেমন শাস্তি সে পেতো একজন মুসলিম রমনীর অমর্যাদা করলে। এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদগণের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই। (চলবে)