॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
চি
কিৎসার প্রয়োজনে, সামাজিক বিনোদন, ধর্মীয় উৎসবের মাধ্যমে এবং তান্ত্রিক ও আধ্যাত্মিক সাধনার অনুষঙ্গরূপে দীর্ঘদিন ধরে মাদকদ্রব্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আদিবাসীদের মধ্যে উদ্ভিদ থেকে তৈরি ড্রাগ দ্বারা চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। হেরোডোটাস, হিপোক্রাটিস, এরিস্টটল থেকে ভার্জিল, প্নিনি, এন্ডারসহ বহু প্রাচীন গ্রীক ও রোমান লেখকের লেখায় চিকিৎসার জন্য পপি ও আফিম ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। “এ.ই.হক, মাদকাসক্তি : জাতীয় ও বিশ্ব প্রেক্ষিত, ঢাকা : ছায়া প্রকাশনী, ১৯৯৩, পৃ. ২৮” মেসোপটেমিয়া, এশিয়া ও ইউরোপে ঔষধ হিসেবে আফিমের ব্যবহার শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ অব্দে। ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে মিসরের চিকিৎসকগণ আফিমের ব্যবহার করত এ্যনেসথেকিরূপে। সেখানকার আদিম অধিবাসীগণ তখন কোক পাতা চিবিয়ে খেত। মেক্সিকোর ইন্ডিয়ানগণ খ্রিষ্টপূর্ব ১০০ অব্দে ধর্মীয় উৎসব ও আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য ঐধষষঁপরহড়মবহরপ চংরঃড়পুনরহ সধংযৎড়ড়স’ং নামক উদ্ভিদের নির্যাস গ্রহণ করত; যাকে তারা বলত ‘ঈশ্বরের দেহমাংস’। ফনীমনসা জাতীয় (চুড়ঃব) গাছের নির্যাসও তারা ব্যবহার করত। আমেরিকার গির্জাগুলোতে চযড়ঃব ক্যাকটাস ব্যবহারের নিয়ম ছিল। “শাহীন আকতার, মাদকদ্রব্য ও বর্তমান বিশ্ব, ঢাকা: যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, ১৯৯০, পৃ. ১১”
খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ অব্দে প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার যুগে এশিয়ার মাইনরে আফিম ও পপিকে আনন্দ উদ্দীপক নেশা হিসেবে ব্যবহার করত বলে পন্ডিতগণ মনে করেন। তাইওয়ানে প্রস্তর যুগের ১০,০০০ বছর পূর্বেও গাঁজার ব্যবহার ছিল। চীনে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে ‘মাহুয়াং’ নামক ড্রাগ ‘ইনথেলেন্ট’ রূপে ব্যবহারের কথা জানা যায়। প্রায় একই সময়ে চীনের সম্রাট সেনমুঙ্গ-এর শাসনামলে নেশাকর ড্রাগ হিসেবে গাঁজার ব্যবহার ছিল। প্রাচীনকালে চীন ছাড়াও পারস্য, তুরস্ক, মিসর, ইতালী, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে গাঁজার ব্যবহার ছিল। “আব্দুল হাকীম সরকার প্রমুখ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৮”
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে ভারতীয় উপমহাদেশে ক্যানাবিসের প্রচলন শুরু হয়। সম্ভবত ভারতীয়রাই আফিম, ধুতুরা এবং ভাঙ ব্যবহারের সূচনা করে। বেশ কিছু সংখ্যক হিন্দু সাধক ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ক্যানাবিস ব্যবহার করতেন। এটি সম্ভবত ধ্যানে মগ্ন বা মনকে নিবিষ্ট করতে সাহায্য করত। ক্যানাবিস এক ধরনের পানীয় হিসেবে বহু মন্দিরে পরিবেশন করা হত। ক্যানাবিস বিভিন্ন উৎসবাদি যেমন হোলি, শ্রীভারতী এবং বিবাহ উৎসবে ব্যবহার করা হত। “প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৮”। সাধু-সন্ন্যাসী, বাউল, যোগী, তান্ত্রিক ইত্যাদি ধরনের লোক গাঁজা, ভাঙন সিদ্ধি সাধনায় ‘একাগ্রতা সৃষ্টি ও ধ্যানস্থ’ হওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকে। বিভিন্ন পুরাণ ও উপকথায় নানা প্রসঙ্গে গাঁজার কথা পাওয়া যায়। “এ.কে.এম, সিরাজুল ইসলাম, ইসলামে নেশা, ঢাকা : মা প্রকাশনী, ১৯৯৩, পৃ. ৮৬” হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পুরাণ-এ ধর্মীয় মর্যাদা প্রদান করে বলা হয়, ইন্দ্র তাঁর সহস্র চক্ষু, রোগ নাশক শক্তি ও দৈত্যনাশক ক্ষমতা দিয়েছেন এই গাঁজাকে। সেই থেকে হিন্দুদের কাছে গাঁজা গাছ ‘পবিত্রতার’ প্রতীক হয়ে আছে। তাদের কাছে স্বপ্নে গাঁজা গাছ-এর পাতা দেখা সৌভাগ্যস্বরূপ। বেদ-এ গাঁজা ও অন্যান্য দ্রব্য মিশ্রিত পানীয় ভাঙকে দুশ্চিন্তানাশক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। “আবদুল হাকিম সরকার প্রমুখ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৮”। মাদকদ্রব্য সম্পর্কে বাইবেলে বলা হয়েছে, ”ঘড়ৎ ফড়বং ধহু ড়হব ঢ়ঁঃ হবি রিহব রহঃড় ড়ষফ ংশরহ, রভ যব ফড়বং, ঃযব হবি রিহব রিষষ নঁৎংঃ ঃযব ংশরহ, ঃযব রিহব রিষষ নব ধিংঃবফ ধহফ ঃযব ংশরহ ৎঁরহবফ ভৎবংয ংশরহং ভড়ৎ হবি রিহব! অহফ হড় ড়হব ধভঃবৎ ফৎরহশরহম ড়ষফ রিহব ধিহঃং হব,ি ভড়ৎ যব ংধুং, ঃযব ড়ষফ রিহব রং মড়ড়ফ” ”ঞযব ঘবি ঊহমষরংয ইরনষব, ১৯৬১, ঢ়.১০০”
অজ্ঞতার যুগে অন্যান্য অপরাধ ও অপকর্মের পাশাপাশি মদপানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। সুরা পান তখন আভিজাত্য বলে মনে করা হতো। প্রতিটি সামাজিক অনুষ্ঠানে সুরা পান ছিল অপরিহার্য উপাদান। ইসলামের বিকাশ লাভের পূর্বে আরব দেশে সুরা পান ছিল একটি গ্রহণযোগ্য রীতি। কিন্তু নেশাগ্রস্ততা মানুষের জীবনে অনেক ক্ষতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে বলে ইসলাম এর প্রতি পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, “হে মু’মিনগণ! মদ, জুয়া মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানী কার্যের অন্তর্ভুক্ত; সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার”। “আল-কুরআন, ৫ : ৯০”। যা হোক, প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পপি ফুলের শুকনা রস ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মনের সূক্ষ্ম অনুভূতির উপরে পপি ফুলের রসের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি গ্রীক ও রোমানগণ অবহিত ছিল। ইংরেজ ভেষজবিদ ১৭০০ সালে সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন যে, অনেক দিন ধরে মাদকদ্রব্য সেবনে এর উপরে প্রচন্ড আসক্তির জন্ম হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আবিষ্কার হয় মরফিনের। মরফিন হচ্ছে আফিমের বিশুদ্ধ প্রকরণ। ১৮৯৮ সাল হতে হিরোইন ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে ধমনীতে এর ইনজেকশন দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। হেরোইন এ সময়ে সর্বাপেক্ষা অধিক ব্যবহৃত এবং আলোচিত ক্ষতিকর মাদকদ্রব্য, সাদা বা বাদামী রঙের পাউডারের মতো। মাদকাসক্তদের কাছে ‘ব্রাউন সুগার’ নামে বেশি পরিচিত। এ মাদকদ্রব্যটির মূল উৎস হচ্ছে আফিম।
পোপাভার সমনিফেরাম নামক এক ধরনের উদ্ভিদের ফুলের রস থেকে আফিম তৈরি হয়। ১৮০৫ সালে মাটারনাম নামে একজন বিজ্ঞানী আফিম থেকে আরো শক্তিশালী বেদনানাশক দ্রব্য প্রস্তুত করেন এবং গ্রীক নিদ্রাদেবী ‘মার্ফিউস’ এর নামানুসারে এর নাম দেয় ‘মরফিন’। পরবর্তীকালে ১৮৯৫ সালে একজন জার্মান ফার্মাসিস্ট মরফিন থেকে অধিক গুণ শক্তিশালী বেদনানাশক দ্রব্য হেরোইন প্রস্তুত করেন। হেরোইনের নেশা মরফিনের তুলনায় ৩ গুণ এবং আফিমের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি। “মুহাম্মদ সামাদ, মাদকাসক্তি এবং মাদকদ্রব্য চোরাচালানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, ৪২ সংখ্যা, ফেব্র“য়ারি, ১৯৯২, পৃ. ১৪৯” গাঁজা তৈরি হয় ক্যানবিস স্যাটাইভা নামের এক ধরনের উদ্ভিদের পাতা, ডাল, ফুল ও বীজ থেকে। গাঁজাতে সাধারণত তামাকের চেয়ে ১২ গুণ টার ও ১০ থেকে ২০ গুণ কার্বন মনোক্সাইড বেশি থাকে, যার ফলে এ মাদকদ্রব্য সেবনে ফুঁসফুঁসে ক্ষত বা ক্যান্সারের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। দক্ষিণ আমেরিকার কোকো পাতা হতে তৈরি হয় কোকেন। ১৫৩২ সালে পিজারো এটা আবিষ্কার করেন। ১৮৪৪ সালে কোকো পাতা থেকে কোকেন পৃথক করা হয় এ্যালকালোয়েড রূপে। ১৮৮৪ সালে সিগমন্ড ফ্রয়েড মনস্তাত্বিক চিকিৎসায় কোকেনের ব্যবহার শুরু করেন। পরবর্তীতে অস্ত্রোপচারের সময় এ্যানাসথেটিক রূপে কোকেনের ব্যবহার শুরু হয়। “এ.কে.এম. মনিরুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ.৯”
অ্যামফেটামিন এক জাতীয় কৃত্রিম ড্রাগ। ১৯৪০ সালে আমেরিকা, বৃটেন, জার্মানী ও জাপান সরকার সৈন্যদের মানসিক অবসাদ দূর করে কর্মোদ্দীপক করে তোলার জন্য এ্যামফেটামিন চালু করে। কোকেন পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বেশি জনপ্রিয় ড্রাগ। ১৮৬৪ সালে দু’জন জার্মান বৈজ্ঞানিক ফনমেরিং ও ফিশার বারবিচ্যুরেট আবিষ্কার করেন। ১৯০৩ সাল হতে এটা ঔষধ রূপে ব্যবহার হতে থাকে ‘ভারনাল ট্রেড’ নামে। ১৯৪০ সনে গবেষণায় ধরা পড়ে যে, এটা এক আসক্তিজনক দ্রব্য। ট্রাংকুলাইজারসের আবির্ভাব ঘটে ১৯৫০ সনে আমেরিকায়। উদ্ভিদের নির্যাস হতে তৈরি এই ঔষধ ভারতবর্ষে শত শত বর্ষ ধরে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৯৩৮-১৯৪৩ সনের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের স্যানডোজ ল্যাবরেটরীর দু’জন কেমিস্ট ড. আলবার্ট হকম্যান ও ডব্লিউ এ স্টোল এল.এস.ডি আবিষ্কার করেন। এটা বন্দীদের নিকট হতে তথ্য বের করতে এবং শত্র“দেরকে অসমর্থ করতে ব্যবহৃত হয়। এটা চিকিৎসার কাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘‘ ঊহপুষড়ঢ়বফরধ ইৎরঃধহহরপধ (১৯৭৮), ঠড়ষ-২০, ঢ়. ৮৩৯’’। বাংলাদেশে ধূমপানের সূত্রপাত হয় সম্ভবত চট্টগ্রাম বন্দরে পর্তুগীজদের আনাগোনার সাথে সাথে। এভাবে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার চুরুটের ব্যবহার ফ্রান্স, স্পেন, বৃটেনসহ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ‘‘ ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ইৎরঃধহহরপধ (১৯৭৮), ঠড়ষ-২০, ঢ়. ৮৩৯’’ তাই বলা যায়, অতীতকালে বিভিন্ন চিকিৎসার জন্য বেদনানাশক উপকরণ হিসেবে গাঁজা, মদ প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে এর সাথে সংযোজিত হয়েছে হেরোইন, প্যাথিড্রিন, ফেন্সিডিলের মতো মারাত্মক নেশাকর দ্রব্য। আর এই মাদকদ্রব্য ইতিহাসের ক্রমধারায় এখন শহর, নগর, বন্দর, গ্রাম সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে এবং বর্তমান বিশ্ব সভ্যতার জন্য একটি মারাত্মক হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার ও ব্যবহার : মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব, প্রতিক্রিয়া জানা এবং ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বহুকাল পূর্ব থেকে মাদকাসক্তি সমস্যা বিদ্যমান। ৬০০১০০০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে রচিত চর্যাপদে বাংলাদেশের প্রাচীন গুঁড়িখানায় গাছের ছাল-বাকল দিয়ে চোলাই মদ তৈরির তথ্য পাওয়া যায়। ‘‘আবু তালেব, হেরোইন : আর এক মারণাস্ত্র, খুলনা: অমরাবতী প্রকাশনী, ১৯৮৮, পৃ. ১৩৬’’। বাংলাদেশে চোলাই মদ, তাড়ি, গাঁজা ইত্যাদির প্রচলন অনেক পুরানো হলেও এগুলোর ব্যবহার মূলত সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানাদির মধ্যে সীমিত ছিল। ব্যাপকহারে মাদকের বিস্তার এবং প্রযুক্তির ছত্রছায়ায় লালিত আধুনিক নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার এদেশে খুব পুরানো নয়। সবচেয়ে ভয়াবহ নেশাজাতীয় দ্রব্য মরফিন বা হেরোইনের মত স্বর্গানন্দ উদ্রেককারী মায়াবিস্তারকারী নেশা দ্রব্যের অনুপ্রবেশ এদেশে ১৯৮৩ সালের দিকে ঘটে বলে অনুমান করা হয়। ‘‘স্মরণিকা-মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ১৯৯৬, পৃ. ৫৭।’’ বর্তমানে আমাদের দেশে বহুল ব্যবহৃত হেরোইন, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল, বিয়ার, ব্রান্ডি, হুইস্কি, কোকেন, আফিম, ডায়াজেনাস, নাইট্রোজেনাম ইত্যাদি নেশাজাতীয় দ্রব্যের অনুপ্রবেশ বহিরাগত অপসংস্কৃতির হাত ধরে হয়েছে। বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তির ছত্রছায়ায় প্রস্তুত হয়ে সেগুলো আজ যুব সমাজকে সবচেয়ে বেশী আসক্ত করেছে; ধ্বংস করছে তাদের সত্ত্বাকে, দংশন করছে তাদের আত্মাকে। নেশাজাতীয় দ্রব্য মহামারী আকারে সবচেয়ে বেশী প্রবেশ করেছে তরুণ সমাজে। বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের সংখ্যা সম্পর্কে তেমন সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে মাসকাসক্তের সংখ্যা ১৫ লাখ থেকে ১৭ লাখ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে এই সংখ্যা ১৫ লক্ষ যার মধ্যে ৭০% যুব সম্প্রদায় এবং ১০% নারী। ‘‘যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রতিবেদন, ১৯৯৪, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, ঢাকা, পৃ. ১৯।’’
বাংলাদেশে মাদক ব্যবহারের ব্যাপক প্রসার ঘটে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে। ১৯৭১ সালের পরবর্তী সময়ে দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসে। বিভিন্ন কারণে সমাজ ভারসাম্য চ্যুত হতে থাকলে শিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত তরুণ সমাজ যে উৎসাহ উদ্দীপনায় যুদ্ধে নেমেছিল পরবর্তীকালে সেই উদ্দীপনা নানা কারণে গঠনমূলক দিকে না গিয়ে দিকভ্রষ্ট হয়। কলেজ ও জীবনাচরণের প্রভাবে অনেকেই পোষাক-পরিচ্ছদ ও চালচলনে নতুনত্ব আনার চেষ্টা চালায়। অনুষঙ্গ বিষয় হিসেবে দেখা যায় নেশার ভুবনে তরুণদের বিচরণ। হাল ফ্যাশনের যুগে উচ্চবিত্ত, উচ্চ শিক্ষিত, কিছুসংখ্যক শহুরে পরিবারে মাদক দ্রব্যের ব্যবহার অনেকটা কালচারে পরিণত হতে চলেছে।
বাংলাদেশের ২৫৩০ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েরাই সবচেয়ে বেশী মাদকাসক্ত। এ বয়সীরাই মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগ। আবার এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক ছেলে-মেয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। এদের মধ্যেই প্রায় ৭০ শতাংশ মাদকাসক্ত বলে মনে করা হয়। এদেশের শহুরে যুব শ্রেণী আজ নানাবিধ আর্থ-মনো-সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত। এদেশের শহুরে যুবশ্রেণীর মধ্যে এর প্রকোপ বেশী। তবে গ্রামে-গঞ্জেও নেশা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। শহরাঞ্চলের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা, রংপুর, যশোর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া ও খুলনা শহরের তরুণদের মাঝে নেশা গ্রহণের প্রবণতা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু ঢাকা শহরেই ১ লক্ষ মাদকাসক্ত রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ‘‘সৈয়দ শওকতুজ্জামান, বাংলাদেশ সামাজিক সমস্যা: স্বরূপ ও সমাধান, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৩, পৃ. ২৬৬।’’ শুধু ঢাকার মোহাম্মদপুরেই ২২ হাজার মাদকাসক্ত রয়েছে বলে ‘‘মুক্তি’’ নামের একটি বে-সরকারী ক্লিনিক উল্লেখ করে। ‘‘এম ইমদাদুল হক, মাদকাসক্তি: জাতীয় ও বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিত, স্মরণিকা-১৯৯৬, পৃ. ১৫।’’ অন্য এক তথ্য অনুযায়ী কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ১২,০০০ জন হেরোইন আসক্ত। কয়েক বছর আগের তথ্যে দেশে ৬০,০০০ লাইসেন্স প্রাপ্ত মদ্যপায়ীর মধ্যে ৪০,০০০ তরুণ বয়সী বলে জানা যায়, আবার ১,০০০ জন মদ্যপায়ীর মধ্যে ১০ জনের বেশীর লাইসেন্স নেই। ‘‘দৈনিক জনকণ্ঠ, ২২ এপ্রিল, ১৯৯৮, পৃ. ৪।’’ অন্য এক তথ্যে জানা যায় প্রতি ২,৪৪৩ মদ্যপায়ীর মধ্যে প্রায় ২৮৫ জন অর্থাৎ ১১.৬৭% ছাত্র। ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা সংখ্যা- ৬৮, ২০০০, পৃ. ১৭৮।’’ পেশা অনুযায়ী মাদকাসক্তের হার ‘‘স্মরণিকা-২০০০, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পৃ. ২২।’’ বিভিন্ন কর্মচারী ৪৫%, ব্যবসায়ী-১৯%, চোরাচালানী-৫%, ছাত্রী-৬%, ছাত্র-৬%, বেকার- ১৫%, অন্যান্য ৫%। প্রথম পর্যায়েই ছাত্রদের সংখ্যা প্রায় ৬ শতাংশ। বিশ্বে মাদকাসক্তি বৃদ্ধির হার ২% ভাগ; বাংলাদেশে এই বৃদ্ধির হার ৩.৮% অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। ‘‘স্মরণিকা-২০০০, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পৃ. ৩০।’’ ঠিক এই হারটির সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে এদেশের ছাত্রসমাজে মাদকাসক্তির প্রবণতাও। উপর্যুক্ত তথ্যাবলীর বেশিরভাগই আজ থেকে ১৫২০ বছর পূর্বের। বর্তমানে এই সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অনুমিত হয়। তবে বাংলাদেশে এ ব্যাপারে কোন ধারাবাহিকতা পরিসংখ্যান নেই বলে সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর।
মাদকাসক্তির কারণ : মাদকদ্রব্যে আসক্ত হওয়ার পেছনে একক কোন কারণ দায়ী নয়। কিন্তু তারপরেও বলতে হয় এর মূলে রয়েছে এর সহজ প্রাপ্তি। পেছনে রয়েছে এক সংঘবদ্ধ মাফিয়া চক্র যারা সুকৌশলে এবং কেবল নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য এটিকে বাজারে ছাড়ছে। একজন সমাজবিজ্ঞানীর মতে, মাদকাসক্তি হল বাজার অর্থনীতির কুফল যেখানে একদল স্বার্থান্বেষী কালো টাকা লাভের আশায় সে কাজ করছে; পিছনে রয়েছে আরো নানা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্বিক কারণ। ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮২।’’ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে শহরায়ন ও নগরায়নের ফলে সৃষ্ট জটিলতা, ছাত্র-রাজনীতিতে ঢুকে পড়া কু-প্রভাব, রাজনীতিবিদদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া, আধুনিকতার নামে উচ্ছৃঙ্খল হওয়া, সন্ত্রাস, হতাশা, দ্বন্দ্ব ইত্যাদি মানুষকে মাদকাসক্ত হতে সাহায্য করেছে। এছাড়া বন্ধু-বান্ধবের কুসংসর্গ, পারিবারিক, সামাজিক ও মানসিক অস্থিরতা, মাদক পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হওয়া এবং মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা এগুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, সচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই মাদকদ্রব্য সেবনের প্রবণতা বেশী। ধনীর দুলাল-দুলালীদের কাছে এটি আভিজাত্যের প্রতীক। সুখের হতাশায় মাদকদ্রব্যের সম্মোহনে হারিয়ে যেতে এরা ভালবাসে। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে এরা আনাবিল আনন্দ উপভোগ করে। রক্ত প্রবাহে মাদকদ্রব্যের জৈব রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া এদেরকে প্রদান করে এক উষ্ণ অনুভূতি। এই পুলক অনুভূতি, স্বপ্নিল তন্দ্রাচ্ছন্নতা ও নষ্ট আনন্দ এক সময় তাকে আসক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। ‘‘স্মরণিকা-১৯৯৩, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা, পৃ. ৭০।’’
এছাড়াও আমাদের দেশে শিক্ষিত সচেতন মাদকাসক্তদের এমন অনেককেই পাওয়া যায় যারা মনে করেন যে মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে মস্তক স্বচ্ছ থাকে, কাজে আনন্দ পাওয়া যায়, সাফল্য আসে। মাদকদ্রব্যের গুণাগুণ সম্পর্কে যুক্তিগুলোর অধিকাংশই দুর্বল মানসিকতার পরিচায়ক। সুতরাং দেখতে পাচ্ছি যে, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি কারণে আমাদের ছাত্র সমাজ মাদকাসক্ত। উল্লেখ্য, মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে একজন ছাত্রের যেমন একটি কারণ থাকতে পারে, তেমনি একাধিক কারণও থাকতে পারে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মাদকাসক্ত হওয়ার পিছনে একাধিক কারণ দায়ী। তবে তার জন্য পরিবারকে সবচেয়ে বেশী দায়ী করা যায়। পারিবারিক স্নেহ, আদর, ভালোবাসা, পারিবারিক অশান্তি এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক অবস্থাকে এর জন্য দায়ী করা যায়।
মাদকাসক্তির প্রভাব : মাদকাসক্তি ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি করে। মাদকাসক্তির ফলে কিশোরের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পথ প্রথমেই রুদ্ধ হয়ে যায়। ছাত্র হলে সে আর লেখাপড়া করতে সক্ষম হয় না। সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় ও নৈতিক আদর্শ ইত্যাদি থেকে বিচ্যুত হয়ে যখন কেউ মাদক অপসংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয় তখন সে প্রকৃতপক্ষে আত্মহননের পথই বেছে নেয়। এভাবে সমাজের সম্ভাবনাময় একটি অংশ যখন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন উন্নত-অনুন্নত যে কোন দেশের জন্যই তা অত্যন্ত ক্ষতিকর। মাদকাসক্তির কিছু প্রভাব নিম্নে বর্ণনা করা হলো: (১) মাদকদ্রব্যের ব্যবহার শারীরিক ও মানসিক দিককে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করে তেমনি নৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে ব্যবহারকারীকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। কিছু মাদকদ্রব্য রয়েছে যা গ্রহণ করলে উঠতি বয়সের ছেলে নিজেকে অত্যধিক শক্তিশালী অনুভব করে। আর এই ‘শক্তির’ সাথে বিভ্রান্তির যোগ হলে তখন ঐ তরুণ যে কোন মারাত্মক অপরাধ ও অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে পারে। এদের কেউ কেউ এক পর্যায়ে ছিনতাই, অবৈধ চাঁদা আদায়, চুরি-খুন, মারামারি, কালোবাজারি, দেহ ব্যবসা ইত্যাদি মারাত্মক ও জঘন্য অপরাধমূলক কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। (২) মাদকাসক্তি ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক দিককে ক্রমাবনতির দিকে নিয়ে যায় এবং তাকে অর্থনৈতিক দিক দিয়েও পঙ্গু করে দেয়। সেই সাথে ব্যক্তিকে নি:সঙ্গ ও মর্যাদাহীনের স্তরে নিয়ে আসে। মাদক নির্ভরতা ব্যক্তির স্বাস্থ্যহানি ঘটায়, রোগ ব্যাধি সৃষ্টি করে; ওজনহীনতা, শক্তিহীনতা ও ক্ষুধামন্দায় ভোগায়। এদের কর্মোদ্দীপনা হ্রাস পায়, মতিভ্রম দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যহীন ও কংকালসার হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। (৩) মদ মানুষের শরীরে বহুমুখী ক্ষতিসাধন করে থাকে। মদের প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মানুষের হজম শক্তি বিনষ্ট হয়ে যায়, খাদ্য স্পৃহা কমে যায়, চেহারা বিকৃত হয়ে পড়ে, স্নায়ু দুর্বল হয়ে আসে, সামগ্রিকভাবে শারীরিক অক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য লোপ পায়, মানুষ অকর্মণ্য হয়ে পড়ে, মদ যকৃৎ কিডনী সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করে ফেলে, যক্ষ্মা রোগ মদ পানেরই একটি বিশেষ পরিণতি। বর্তমানে এইডস এর প্রাদুর্ভাবেও মদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ‘‘মাসিক অগ্রপথিক, ২২ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, মার্চ-২০০৭, পৃ. ৮৭-৮৮।’’ মাদকসেবীদের মধ্যে ৯০% বহুগামিতায় অভ্যস্ত। তবে অওউঝ (অপয়ঁরৎবফ ওসসঁহব উবভরপরবহপু ঝুহফৎড়সব) থেকে নিজেকে সংরক্ষণ করতে সমকামিতা, যৌনাচার পরিহার করা অন্যতম উপায়। ‘‘প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৮।’’ তবে ঐওঠ (ঐঁসধহ ওসসঁহব ঠরৎঁং) শরীরে প্রবেশ করলে তার প্রতিষেধক ঔষধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। (চলবে)