কাজিরবাজার ডেস্ক :
জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ও সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত ৩ সদস্যের এই ট্রাইব্যুনাল গতকাল এ রায় ঘোষণা করেন। টাইব্যুনালের অপর দু’সদস্য বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম। চলতি বছরের ২০শে আগস্ট মামলার সর্বশেষ ধাপ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন শেষে কায়সারের মামলার রায় যে কোন দিন ঘোষণা করা হবে মর্মে তা অপেক্ষমাণ রাখা হয়। গতকাল ঘোষিত রায়ে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় কায়সারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৩, ৫, ৬, ৮, ১০, ১২ ও ১৬ নম্বর এই সাতটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, ১, ৯, ১৩ ও ১৪ নম্বর এই চারটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও ২, ৭ এবং ১১ নম্বর এই তিনটি অভিযোগে যথাক্রমে ১০, ৭ ও ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। অন্যদিকে ৪ ও ১৫ নম্বর অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি বিধায় দু’টি অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন কায়সার। এর মধ্যে ৮ ও ১২ নম্বর অভিযোগে ধর্ষণ ও ধর্ষণে সহযোগিতার দায়ে তাকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। কায়সারের বিরুদ্ধে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী ও তার স্বজনরা বলছেন তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। গতকাল কায়সারের বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ে একাত্তরে নির্যাতিত নারী ও যুদ্ধশিশুদের সামাজিক স্বীকৃতি ও তাদের অধিকার নিশ্চিতের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এটি অষ্টম রায়। এনিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত দু’টি ট্রাইব্যুনালে ১৪টি রায় ঘোষিত হয়েছে। জাতীয় পার্টির কোন নেতার বিরুদ্ধে এই প্রথম ট্রাইব্যুনালে কোন রায় ঘোষিত হলো।
গতকাল কায়সারের রায় শোনার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এলাকায় সকাল থেকে গণমাধ্যমকর্মী, আইনজীবী, মুক্তিযোদ্ধাসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ এসে ভীর করেন। রায়কে ঘিরে ট্রাইব্যুনাল জুড়ে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। স্থান সংকুলানের কারণে ট্রাইব্যুনাল-২ এর এ রায়টি ট্রাইব্যুনাল-১ এ ঘোষণা করা হয়। সকাল সাড়ে দশটার আগেই ট্রাইব্যুনাল ১-এর এজলাস কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। ১০টা ৫৫ মিনিটে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে এজলাসের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। সাদা পাজামা পাঞ্জাবির ওপর খাকি রঙের কোট পরা কায়সার এ সময় ছিলেন কিছুটা বিমর্ষ ও অন্যমনস্ক। এর আগে রায় ঘোষণা উপলক্ষে সকাল ৮টা ১০ মিনিটে কায়সারকে কড়া নিরাপত্তায় পুলিশের প্রিজন ভ্যানে করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কয়েদখানায় রাখা হয়। ১১টা ৫ মিনিটে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে অন্য দুই বিচারপতি এজলাসে তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। এর কিছুক্ষণ পরেই ৪৮৪ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়ে শোনানো শুরু করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। দণ্ড দান সম্পর্কিতসহ পুরো রায়টি তিনি প্রায় এক ঘণ্টা পড়ে শোনান। পঠিত রায়ে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান প্রথমে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের জন্ম, পরিচয়, রাজনৈতিক পরিচয় ও একাত্তরে তার ভূমিকার বিষয়ে রায়ের উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ১৬টি অভিযোগও পর্যায়ক্রমে পড়ে শোনান তিনি। রায়ে উল্লেখ করা হয়, একাত্তরে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার প্রথমে হবিগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি কয়েক শ’ স্বাধীনতাবিরোধী লোক নিয়ে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ নামে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করার জন্য একটি সহযোগী বাহিনী গঠন করেন। তিনি নিজে ওই বাহিনীর প্রধান ছিলেন। কায়সার এ বাহিনীর মাধ্যমে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লায় হত্যা, গণহত্যাসহ স্বাধীনতাকামী মানুষদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করেন যা রাষ্ট্রপক্ষের দাখিলকৃত দলিল ও সাক্ষ্য-প্রমাণে ওঠে এসেছে। এজন্য এসব অপরাধের অপরাধজনক দায়বদ্ধতা তিনি এড়াতে পারেন না। এ কারণে সর্বোচ্চ শাস্তিই তার প্রাপ্য।
একাত্তরে নির্যাতিত নারী ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনের পরামর্শ : রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরে যে সব নারী নির্যাতিত হয়েছেন তাদের জীবনভর সংগ্রাম করতে হয়। ধর্ষণের যন্ত্রণা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। সামাজিকভাবেও যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরে যেসব নারী নির্যাতিত হয়েছিলেন তারা আমাদের মা এবং বোন। তাদেরকে আমাদের স্যালুট করা উচিত। কায়সারের মামলায় যুক্তিতর্কের সময় প্রথমবারের মতো একজন যুদ্ধশিশু ও দুই বীরাঙ্গনাকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি করেছিল প্রসিকিউশন। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’ ১৯৭৩-এ ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান না থাকায় ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দিতে পারছে না। তাই রাষ্ট্রকেই নির্যাতিত নারী ও যুদ্ধশিশুদের ক্ষতিপূরণ স্কিম চালু এবং তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং এনজিওগুলোকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যেসব নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তারা আমাদের দেশের জাতীয় বীর। আজ আমাদের সময় এসেছে এসব নারীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়ার। এসময় ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দেয়ায় যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহারকে সাহসিকতার জন্য স্যালুট জানান ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া একাত্তরে সকল নির্যাতিত নারীদের স্যালুট জানানো উচিত।
রায়ে সন্তুষ্ট রাষ্ট্রপক্ষ, আসামি পক্ষ আপিল করবে : রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক বলেন, আমরা পুরো বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সন্তুষ্ট। বিচারকাজ সঠিকভাবেই এগোচ্ছে। কায়সারের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনকারী প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট। প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এ রায় একাত্তরে যেসব মা-বোন নির্যাতিত হয়েছিলেন তাদের উৎসর্গ করা হলো। সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও আবদুস সোবহান তরফদার বলেন, আদালত যা ভাল মনে করেছেন তাই রায় দিয়েছেন। তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো। তখন আশা করি ন্যায়বিচার পাবো। কায়সারের ছেলে সৈয়দ গালিব আহমেদ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমরা ব্যথিত হয়েছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই। আমাদের আইনজীবী আছেন। ওনারাই ভাল বলতে পারবেন।
যে অভিযোগে মৃতুদণ্ড : প্রমাণিত তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৭শে এপ্রিল সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) মাধবপুর থানার কৃষ্ণনগর গ্রামের অহিদ হোসেন পাঠান, চেরাগ আলী, জনাব আলী ও মধু সুইপারকে হত্যা করে কায়সার ও তার লোকজন। পরে তাদের বাড়িঘরে লুটপাট করার পর আগুন দেয়া হয়।
প্রমাণিত পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৯শে এপ্রিল দুপুর থেকে বিকালের মধ্যে হবিগঞ্জ সদরের শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্যগুদাম এবং শায়েস্তাগঞ্জ পুরান বাজারের রেলব্রিজ এলাকায় আব্দুল আজিজ, আব্দুল খালেক, রেজাউল করিম, আবদুর রহমান এবং বড়বহুলা এলাকার আবদুল আলী ওরফে গ্যাদা উলাহ, লেঞ্জাপাড়া এলাকার মাজত আলী ও তারা মিয়া চৌধুরীকে আটক করে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী।
প্রমাণিত ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৯শে এপ্রিল সন্ধ্যার পর হবিগঞ্জ সদরের পুরানবাজার পয়েন্টে সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি এম মহিউদ্দিনের বাড়িতে হামলা হয়। এছাড়া লস্করপুর রেললাইনের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং হীরেন্দ্র চন্দ্র রায়কে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী।
প্রমাণিত অষ্টম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১ই মে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার চাঁদপুর চা বাগানে সাঁওতাল নারী হীরামণিকে ধর্ষণ করে সৈয়দ কায়সারের বাহিনী।
প্রমাণিত দশম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৩ই জুন হবিগঞ্জ সদর, মোকাম বাড়ি, শায়েস্তাগঞ্জ থানার আর অ্যান্ড এইচ ডাকবাংলো এবং মাধবপুর থানার শাহাজীবাজার এলাকার হামলা চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এ সময় শাহ ফিরোজ আলী নামের একজনকে অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সাবু মিয়া নামের আরেকজনকে অপহরণের পর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন।
প্রমাণিত দ্বাদশ অভিযোগে বলা হয়েছে, সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালে আগষ্টের মাসের মাঝামাঝি কোন একদিন হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার বেলাঘর ও জগদীশপুর হাইস্কুল থেকে আতাব মিয়া, আইয়ুব মিয়া, মাজেদা বেগমকে অপহরণ করে। এক পর্যায়ে মাজেদাকে ধর্ষণ করা হয়।
প্রমাণিত ষোড়শ অভিযোগে বলা হয়েছে, সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৫ই নভেম্বর ব্রাহ্মণবড়িয়ার ভাটপাড়া থানার দাউরা, নিশ্চিন্তপুর, গুটমা, বুরুঙ্গা, চিতনা, নূরপুর, ফুলপুর, জেঠাগ্রাম, পাঠানিশা, কুলিতুণ্ডা, আন্দ্রাবহ, তিলপাড়া, কমলপুর, গঙ্গানগর, বাঘি, শ্যামপুর, কুয়ারপুর, নোয়াগাঁও, কুণ্ডা, লক্ষ্মীপুর, করগ্রাম গ্রামের ১০৮ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে।