স্মরণ ॥ নন্দিত শিক্ষক নজরুল ইসলাম চৌধুরী, গর্বিত ছাত্র আমি

315

॥ কবির আহমদ ॥

জন্ম মৃত্যুর রহস্যের জট আজোও খুলেনি। ধূলাময়, মায়াময় এই পৃথিবীতে অগণিত আদম সন্তানের জন্ম মৃত্যুর এই ধারাবাহিকতা চিরন্তন। জীবননাট্যের মঞ্চে এই যে রঙ্গলীলা অব্যাহত ধারায় চলছে, তার গুঢ় খবর কেউ জানেনা। মৃত্যুই এর চিরন্তন সত্য। জন্মের  সঙ্গেই মৃত্যু চির সাথী হয়ে আছে। ইংরেজীতে বলা হয় গধহ রং সড়ৎঃধষ. আর বিশ্ব মানবতার মুক্তির মহাসনদ মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলা হয়েছে-কুল্লু নাফছিন যাহিকাতুল মউত। অর্থাৎ প্রত্যেক জীবকে মৃত্যুর শরাব পান করতেই হবে। আমরা জানি, মানুষ মরণশীল। আল্লাহ পাক কোরআনুল করীমের ২৯ পারার সূরা মূলকের ২য় আয়াতে বলেছেন, “আল্লাজি খালাক্বাল মাউতা ওয়ালহাইয়াতে লি ইয়াবলুহুকুম আইয়ুকুম আহছানু আমালা” অর্থাৎ তিনি জীবন ও মৃত্যু দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন কে বেশী উত্তম আমল করেছে। তবে কোন কোন মুত্যৃ আমাদের অন্তরে দাগ কাটে, আমাদের কাঁদায়, আমাদের চোখ অশ্র“সিক্ত হয়, আমরা কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যাই বা শোকে অধিক কাতর হয়ে যাই। এমনই একটি মৃত্যু ঘটলো ২০১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর। সিলেট মহানগরীর ঐতিহ্যবাহী মদন মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এই কলেজের উন্নয়নের রূপকার, দক্ষিণ সুরমা তথা সিলেটের কৃতিসন্তান, আমার পিতৃ সমতুল্য মহান শিক্ষক প্রফেসর নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি দুনিয়ার সমস্ত মায়া ত্যাগ করে তার দেশে-বিদেশে অসংখ্য অগণিত ছাত্রছাত্রী, আত্মীয়-স্বজন গুণগ্রাহী রেখে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মওলার সান্নিধ্যে চলে গেলেন (ইন্না….রাজিউন)।
২০১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর আমি পেশাগত কাজে সকাল বেলা ঢাকার উদ্দেশ্যে একটি ভলবো বাসযোগে সিলেট থেকে রওয়ানা দিলাম। বেলা প্রায় সাড়ে ১২টা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় পৌঁছামাত্র আমার প্রিয় শিক্ষক মদনমোহন কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আহমদ হোসেন আমাকে ফোন দিলেন। গাড়ী চলন্ত অবস্থায় কয়েকটি রিংটোন বাজার পর আমি ফোন রিসিভ করলাম। সালাম দেয়ার পর পরই স্যার আমার সালামের উত্তর দিয়ে তিনি আমাকে বললেন, কবির খবর পেয়েছো, নজরুল ইসলাম স্যার তো আজ প্রায় ১২টার দিকে ইন্তেকাল করেছেন। মনের অজান্তে মহান আল্লাহর শিখিয়ে দেয়া বাণী (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন) পড়লাম এবং স্যারকে বললাম, স্যার আমি ঢাকায় যাওয়ার পথে। তবে ঢাকায় যাচ্ছি না সিলেটে ফিরে আসছি। এর পরই সোহাগ বাসের ড্রাইভার সাহেবকে অনুরোধ করে আমি রূপগঞ্জেই নেমে যাই। নেমে চিন্তা করি এখনে তো কোন সিলেটগামী বাস নেই, হঠাৎ করে মাথায় আসলো কোন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন দিয়ে সহযোগিতা নিতে পারি। এর অংশ হিসেবে আমি সিআইডি’র এডিশনাল এসপি মিসেস নাবিলা জাফরিনকে ফোন করলাম এবং তার সহযোগিতা চাইলাম। তিনি ঢাকার মালিবাগে সিআইডি অফিসে বসেন। তার সহযোগিতা চাওয়ার ১৫ মিনিট পরেই জাবেদ সাহেব নামক একজন পুলিশ কর্মকর্তা আমার নাম্বারে ফোন করে আমার লকেশন জানতে চাইলেন। তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় পৌনে একটা। জাবেদ সাহেব  আমার সাথে দেখা করে বললেন, নাবিলা স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন এবং আপনাকে একটি  গাড়ী রিজার্ভ করে সিলেটে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ করেছেন। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা দিয়ে ঐ পুলিশ কর্মকর্তা একটি নোয়া গাড়ী রিজার্ভ করে আমাকে সিলেট পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রায় সাড়ে ৫ টার দিকে আমি সিলেট মহানগরীর সাগরদীঘির পারে স্যারের বাসায় এসে পৌঁছালাম। এসে দেখি স্যারের বড় ছেলে হিরো ভাই ও মেজো ছেলে জয় ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। স্যারের পাশে বসে আছেন, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান স্যারের নিকটাত্মীয় সিলেটের আলোকিত সন্তান, প্রফেসর  আব্দুল আজিজ। আমাকে দেখেই জয় ভাই ও হিরো ভাই জড়িয়ে ধরলেন, জয় ভাই হাউ-মাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি তাদের সাথে জানাযার সময় জেনে স্যারের করালের কাছে গিয়ে নিজের হাতে কাফন সরিয়ে স্যারের কপালের মধ্যে কলেমা শাহাদাত পড়তে পড়তে চুমু খেলাম, এবং বললাম, আপনি দুনিয়াতে যেমন ছিলেন সুন্দর মনের অধিকারী মৃত্যুর পর আপনার এই সুন্দর চেহারাটি দেখতে পেলাম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন জান্নাতুল ফেরদৌস আপনাকে দান করেন। দেখতে পেলাম চিরনিদ্রায় শোয়ে আছেন, মদনমোহন কলেজের সবচেয়ে প্রভাবশালী অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম চৌধুরী। আমি স্যারের করালের পাশে বসে পবিত্র কালামে পাক থেকে সুরা ইয়াসিন, সুরা আর রহমান, সুরা মূলক, সুরা ওয়াকিয়াহ, সুরা নুহ, সুরা মোজাম্মিল, সুরা বুরুজ, সুরা ফাতেহা এখলাছ সহ বেশ কয়েকটি সূরা তেলাওয়াত করলাম এবং মোনাজাত করলাম। আমি কৃতজ্ঞ আমার স্যার আহমদ হোসেন এবং সিআইডি’র এডিশনাল এসপি নাবিলা আপা ও পুলিশ কর্মকর্তা জাবেদ সাহেবের কাছে তাদের ঐকান্তিক সহযোগিতায় আমি সিলেটের এই ক্ষণজন্মা পুরুষ নজরুল ইসলাম স্যারের জানাযায় অংশ নিতে পারার জন্য। আমি স্যারের বাসায় পৌঁছার পর দেখলাম, আমার স্যার অধ্যক্ষ ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, ভাইস প্রিন্সিপাল (প্রশাসন) অধ্যাপক সর্বানী অর্জুন ও ভাইস প্রিন্সিপাল (একাডেমিক) অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আকরাম আলী, ইসলামের ইতিহাসের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ফজলুল হক সহ অনেক শিক্ষকবৃন্দ।
আমরা জানি, সুশিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হলে আদর্শ শিক্ষকের কোন বিকল্প নেই। যিনি নিজেই ফুল ফুটান এবং সৌরভ বিতরণ করেন, তাদের মধ্য থেকে ক্ষণজন্মা পুরুষ প্রফেসর নজরুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ে আজ ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪ তাঁর ২য় মৃত্যু বার্ষিকীতে আমার এই নিবন্ধ।
নজরুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক, গল্পকার, দক্ষিণ সুরমা ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মদনমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের উন্নয়নের রূপকার এবং অধ্যক্ষ। তৎকালীন সাপ্তাহিক সিলেট সমাচারে “নইচৌ” নামক  নিয়মিত একটি কলাম থাকতো যা পাঠকমহলে খুবই প্রশংসিত ছিল। আমি তাঁর ২য় মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। মহান রাব্বুল আলামীন যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন। নজরুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন একজন উত্তম আমলদার মানুষ। আমি তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তিনি আমাকে নিজ পুত্রের মতো স্নেহ করতেন, খোঁজখবর নিতেন। স্মৃতিচারণস্বরূপ লিখছি-১৯৯৪-১৯৯৫ সেশনে আমি মদনমোহন কলেজের বিএ (পাস) ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। ১৯৯৫ সালের মে মাসে আমার পিতা চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেলেন অর্থাৎ ইন্তেকাল করলেন। স্যার কিভাবে খবর শুনে মদনমোহন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান আকরাম আলী স্যারকে সাথে নিয়ে দক্ষিণ সুরমার কায়স্থরাইল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাযায় অংশগ্রহণ করলেন এবং মুছারগাঁও শাহ মনজুর (রহ.) মাজার সংলগ্ন গোরস্থানে দাফন পর্যন্ত স্যার ছিলেন। দাফন শেষে স্যার আমার গলায় জড়িয়ে ধরলেন এবং মাথায় হাত বুলালেন। আমি তখন কেঁদে ফেলছিলাম। এরপর থেকে তিনি আমাকে পিতার স্নেহ দিয়ে আদর করতেন, এমন কোন আবদার নেই মদনমোহন কলেজ ক্যাম্পাসে যে তিনি আমার আবদার রাখেননি। বলামাত্র তিনি অপকটে মেনে নিতেন। বিএ পাস করার পর রাজা জিসি হাইস্কুলে তার বদান্যাতায় আমি শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়েছিলাম দীর্ঘদিন। এরপর সাংবাদিকতার কারণে এই শিক্ষকতা পেশার সাথে আর থাকতে পারিনি।
আমার প্রিয় শিক্ষক নজরুল ইসলাম চৌধুরী কাজ করতে ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন কাজের লোক। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন কলেজকে আজ উন্নয়নের চরমশিখরে যিনি পৌঁছে দিয়েছেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তিনি হলেন সাবেক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম চৌধুরী। বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন ও অর্থনীতি বিভাগে অনার্স কোর্স চালুর ব্যাপারে সিলেটের আরেক ক্ষণজন্মা পুরুষ সিলেট বিভাগের উন্নয়নের রূপকার মরহুম অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের কাছ থেকে অর্থ বরাদ্দের লিখিত আশ্বাসের পর মদনমোহন কলেজের টিচার্স কমনরুমে গভর্ণিং বডি নিয়ে যখন নজরুল ইসলাম চৌধুরী বসলেন, তখন অনেকেই বলেছিলেন স্যার হয়তো সাইফুর রহমান সাহেব আপনাকে ভবন করে দিবেন কিন্তু শিক্ষকদের বেতন কিভাবে দেয়া হবে। সাহসী পুরুষ অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন, ভবন হোক, শিক্ষকদের বেতন দিতে না পারলে দক্ষিণ সুরমার সদরখলায় আমার বাবার জমি বিক্রি করে শিক্ষকদের বেতন যোগাবো। এই সভায় বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর পাশাপাশি আমারও থাকার সুযোগ হয়েছিল। স্যার প্রায়ই বলতেন, এ কলেজের উন্নয়নে কার অবদান বেশি সেটা মূল্যায়ন কঠিন কাজ। তবে ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এই কলেজের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পে মদনমোহন কলেজকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন মরহুম অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।  কলেজ সম্পর্কে স্যার বলতেন, এই কলেজের শিক্ষকরা সুযোগ্য এবং নোংরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে দক্ষতার সাথে ক্লাসে পাঠদান করে থাকেন। তিনি রাজনীতিবিদদের সম্মান করতেন, তবে ছাত্র রাজনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। তার মতে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা না হয়, তবে জাতি আগামীতে প্রচন্ড দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্ব লাভ করবে। তবে তিনি টেন্ডারবাজ ও চাঁদাবাজ ছাত্রনেতাদের ধিক্কার দিতেন এবং মেধাবী তথা নৈতিকতাপূর্ণ ছাত্রনেতাদের কাছে টেনে নিতেন। তাইতো তিনি তার সময়ে  মদনমোহন কলেজে সপ্তাহে ২ দিন মিছিল-মিটিং ১ ঘন্টার মধ্যে সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তা যথাযথভাবে ২০০০ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। আমার জানা মতে অনেককে তিনি হাতে ধরে নিয়ে এই কলেজে চাকুরী করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। প্রধান সহকারী অরিন্দম দত্ত চন্দন এবং প্রধান হিসাব কর্মকর্তা তপু বাবুকে ডেকে নিয়ে এইভাবে বলতেন, আমাদের অমুকের ছেলে বা মেয়ে মাষ্টার্স কমপ্লিট করেছে এখন বেকার থাকলে খারাপ হয়ে যাবে তাকে পারটাইম প্রভাষক হিসেবে আগামী অত তারিখ যোগদান করার জন্য একটি অস্থায়ী নিয়োগপত্র দিয়ে দেন। আজ দুঃখ লাগে অনেকেই স্যারের হাত ধরে মানুষ হয়েছেন, শিক্ষক হয়েছেন, নামের আগে অধ্যাপক লিখেন কিন্তু এই ভালো মানুষটিকে অনেক নোংরা ভাষায় গালি দিতে দ্বিধাবোধ করে না এই নরাধমরা। সিলেটী ভাষায় একটি প্রবাদ আছে-“কার হকদায় খাউগো বান্দি ঠাকুর চিন না”। এই বর্ণচোরাদের আহবান জানাবো তোমরা নজরুল ইসলামের জীবনকে পর্যালোচনা করে মানুষ হও। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো যে কলেজের জন্য আমার স্যার নজরুল ইসলাম চৌধুরী পরিবার-পরিজনের সাথে সময় না দিয়ে শুধু কলেজের জন্য দিনরাতকে উপেক্ষা করে সময় বের করতেন, সেই মদনমোহন কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০০০ সালে তিনি অধ্যক্ষের পদ থেকে বিদায় নেয়ার পর তাকে একটি বিদায় সংবর্ধনা দিতে পারেনি। মাঝে-মধ্যে দেখা হলে বা তার বাসায় তাকে দেখতে গেলে তার স্ত্রী জিনাত খালাম্মা যখন বলতেন এই দেখছো তোমার কবির এসেছে, তখন আলাপচারিতায় বলতেন, কবির, মদনমোহন কলেজ আমাকে একটা বিদায় সংবর্ধনা দিলো না। আমার জানা মতে স্যারের পরের অনেক অধ্যক্ষরা এই কলেজে অনেককে অনেক বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছেন কিন্তু স্যারের ক্ষেত্রে এই ছোট মনের পরিচয় দেয়ার জন্য একদিন কাঠগড়ায় তাদের দাঁড়াতে হবে। আমার মনে পড়ে ২০১২ সালে ২৪ ডিসেম্বর স্যারের ইন্তেকালের পর আমার মহান শিক্ষক বর্তমান অধ্যক্ষ এবং নজরুল ইসলাম চৌধুরীর প্রিয় ছাত্র ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ স্যারের লাশ কলেজ ক্যাম্পাসে নিয়ে আসার জন্য স্যারের পরিবারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন কিন্তু তার পরিবার স্যারের অনুরোধে সাড়া দেয়নি। স্যারের বড় ছেলে আবু মোঃ রুহুল ইসলাম হিরুর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল যে কলেজ আমার বাবা জীবিত থাকালীন সময়ে মূল্যায়ন করতে শিখেনি, আজ তার লাশ ক্যাম্পাসে নিলে আমার পিতার আত্মা কষ্ট পাবে, আমি সহ উপস্থিত অনেকেই তার এই বক্তব্যকে সমর্থন দিয়েছিলাম। অবশ্য ফাত্তাহ স্যার এ সময় উপস্থিত ছিলেন না। স্যারকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখার সময় শুধু বসন্তের কোকিলদের চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। কেউ তাদের ছেলেকে নিয়ে, কেউ তাদের মেয়েকে নিয়ে এবং কেউ স্ত্রীকে নিয়ে আসতো একটি চাকুরীর জন্য। কিন্তু এই বসন্তের কোকিলরা ২০০০ সালে স্যার অবসর গ্রহণের পর থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। স্যারের ইন্তেকালের পর একটি শোক সভাও করতে পারেনি, স্যারের জানাজা এবং দাফনের পর দক্ষিণ সুরমা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল আজিজ আমাকে অনুরোধ করে বলছিলেন-কবির তুমি দক্ষিণ সুরমা কলেজে আসো, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে আমরা স্যারের শোক সভা করবো। কিন্তু কয়েকদিন গিয়েছিলাম আজিজ সাহেবের তো আর দেখা পাইনি। কি অপরাধ করেছিলেন আমার স্যার। তিনি কি সিলেটের মানুষের জন্য এতো কাজ করে একটি শোক সভার মতো যোগ্যতা অর্জন করেন নাই? হ্যাঁ, সব করেছিলেন তবে তিনি বসন্তের কোকিলদের বুঝতে ভুল করেছিলেন। আজ এই কলেজে বর্তমান প্রিন্সিপাল ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, ভাইস প্রিন্সিপাল (প্রশাসন) সর্বানী অর্জুন ও রফিকুল ইসলাম (একাডেমিক), রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আসমাহুল হোসনা, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রধান আহমদ হোসেন এরা সরাসরি আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক। আমি আমার স্যার ম্যাডামদের বিনীতভাবে অনুরোধ করবো আজও কতিপয় বর্ণচোরারা সক্রিয় রয়েছে। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন।
সিলেটে শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারণে নজরুল ইসলাম চৌধুরীর হাতে আমি যে ল্যাম্প দেখেছি তা অত্যন্ত তীক্ষè ও ধারালো। অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম চৌধুরীর বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমায়। দক্ষিণ সুরমা উন্নয়নে তিনি ছিলেন এক অন্যতম চিন্তানায়ক। শিক্ষার আলোকবর্তিকা হাতে দক্ষিণ সুরমা এলাকায় তার বিচরণ ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তিনি দক্ষিণ সুরমার বিভিন্ন উন্নয়ন কমিটির সাথে ছিলেন সরাসরি সম্পৃক্ত। তার চিন্তা ও চেতনা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে সকল সময়ই উর্বরাশক্তি যুগিয়েছে।
দক্ষিণ সুরমায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দক্ষিণ সুরমাবাসীর সচেষ্ট উদ্যোগে বলদী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর আব্দুল হাফিজকে আহবায়ক করে দক্ষিণ সুরমাবাসী যখন ৪৫ জন সদস্য নিয়ে কলেজ বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করি তখন এই নজরুল ইসলাম চৌধুরীই ছিলেন উক্ত কমিটির অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য। উক্ত কলেজ বাস্তবায়ন কমিটির অধীনে তিনটি উপ-কমিটি ছিল।
প্রস্তাবিত কলেজের এফিলিয়েশন, ছাত্রছাত্রী ভর্তি এবং শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপারে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একাডেমিক উপ-কমিটির আহবায়ক ছিলেন তিনি। আমি দেখেছি তার আচরণের ইতিবাচক পরিধি কত ধার ও মজবুত। যাই হোক সম্মিলিত সকলের শ্রম ও ঘামে দক্ষিণ সুরমায় ১৯৮৯ ইং সালে ‘দক্ষিণ সুরমা কলেজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলো। নজরুল ইসলাম চৌধুরী স্থানীয় মদনমোহন কলেজের ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক থাকা অবস্থায় দক্ষিণ সুরমা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন (অবৈতনিকভাবে)।
অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৪০ সালের ২ ফেব্র“য়ারী সিলেটের ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সদরখলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঠিক ১৯৪০ সালেও মদনমোহন কলেজও যাত্রা শুরু করে। শিশু নজরুল কি জানতেন তিনি এই কলেজের উন্নয়নের রূপকার হবেন। সদরখলা গ্রামের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা: মোবাশ্বির আলী চৌধুরী ও সদরখলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক  নুরুনেছা চৌধুরীর পুত্র নজরুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৫৫ সালে নগরীর রাজা জিসি হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন (এসএসসি),  ১৯৫৯ সালে মদনমোহন কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি, ১৯৬১ সালে মুরারীচাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ) থেকে বিএ এবং ১৯৬৩ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২য় বিভাগে এমএ পাস করেন। ডা: মোবাশ্বির আলী চৌধুরীর বড় পুত্র বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ব্যারিষ্টার নুরুল হক চৌধুরী এবং নজরুল ইসলাম চৌধুরী সহ তার ৫ মেয়ে ছিলেন।
অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৬৭ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইলের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা জিনাত মহলের সাথে। সিলেট মহানগরীর ব্লুবার্ড স্কুল এন্ড কলেজের সাবেক শিক্ষিকা ছিলেন জিনাত মহল। জনাব চৌধুরীর কোন মেয়ে না থাকায় তিনি মেয়েদের খুবই স্নেহ করতেন। তার পুত্ররা স্ব স্ব অবস্থান থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তার প্রথম পুত্র প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, দানবীর ড. রাগীব আলীর নিজ হাতে গড়া সাউথ  ইষ্ট ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা আবু মো: রুহুল ইসলাম চৌধুরী হিরু বর্তমানে আমেরিকার একটি কোম্পানীতে কর্মরত। ২য় পুত্র আবু মো: আমিরুল ইসলাম চৌধুরী জয় বর্তমানে দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত। সব ছোট পুত্র জিয়াউল ইসলাম চৌধুরী থাইল্যান্ডে অবস্থিত এশিয়ান ইনষ্টিটিউট অব টেকনোলজি সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।
১৯৬৪ সনে ইসলামের ইতিহাসের প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন মৌলভীবাজার কলেজে। এরপর চলে যান চট্টগ্রাম কলেজ এবং অন্য জেলার সর্বশেষ অধ্যাপনা হল বি-বাড়ীয়া ডিগ্রী কলেজে। ১৯৭৬ সনে বি-বাড়িয়া কলেজ থেকে চাকুরি ছেড়ে চলে আসলেন জনাব চৌধুরী গ্রামের বাড়ীতে। আমি পূর্বে বলেছি মানুষ গড়ার কারিগর আমার প্রিয় স্যার কাজের লোক। তিনি যে জায়গায় যান না কেন কাজ করতে পারেন। সিলেট আসার পর ১৯৭৬ সনের অক্টোবর মাসে বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনার ১০/১২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা সত্বেও নতুন স্কেলে ইসলামের ইতিহাসের প্রভাষক হিসাবে মদন মোহন কলেজে যোগদান করেন। দীর্ঘ ১৪ বছর  অধ্যাপনা করেন এ কলেজে। আকাশ-আর জমিনের মালিক মহান রাব্বুল আল-আমীন আমার প্রিয় স্যারের কার্যক্রমকে পছন্দ করেন। এরপর তিনি ১৯৯০ সনের  অক্টোবর মাসে এ বিদ্যাপীঠের সুযোগ্য অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কেননা আল্লাহ যাকে সম্মানিত করেন কারো শক্তি নেই তাকে দমন করার। দক্ষতার সাথে নজরুল ইসলাম চৌধুরী দায়িত্ব পালন করেন।
স্যার সম্পর্কে কিছু বলে বা লিখে শেষ করার আমার মত ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও সাহস করে কলম ধরছি। তিনি ছাত্র/ছাত্রীদের পরম বন্ধু। কল্যাণ ও সুশিক্ষার জন্য নিবেদিত প্রাণ বক্তিত্ব। গরীব ও মেধানী ছাত্র/ছাত্রীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে গেছেন। ধর্মীয় ও নৈতিকতা বোধ সৃষ্টিতে তিনি সদা তৎপর ছিলেন। এ বিদ্যাপীঠে নিয়ম শৃঙ্খলার   অনুসরণ ও আদর্শ জীবন প্রণালী গঠনে তার জুড়ি নেই। অভিভাবকদের মধ্যেও তিনি সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। এত ব্যস্ততম কলেজের দায়িত্ব পালন করেও জনাব চৌধুরী ছাত্র/ছাত্রীদের পাঠোন্নতি নিয়ে কথাবার্তা বলে থাকেন অভিভাবকদের সহিত। তিনি চরিত্রবান, ন্যায়পরায়ন, ধর্মভীরু ও আদর্শ ব্যক্তি। আদর্শ শিক্ষক বলতে যা বুঝায় তিনি হলেন তাই।
বর্ণঢ্য জীবনের অধিকারী নন্দিত শিক্ষক নজরুল ইসলাম চৌধুরীর ছাত্র হতে পেরে আমি নিজেকে নিজে গর্বিত মনে করি। ২০১২ সালের ২৪ আগষ্ট ওলিকুল শিরোমনি সুলতানুল বাঙাল হযরত শাহজালাল (রহ.) জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে সালাতুল এশার নামাজের পর নজরুল ইসলাম স্যারের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। দাফনের আগে নির্বিবাদী সজ্জন ব্যক্তিত্ব আমার প্রিয় শিক্ষকের জানাযায় অংশ নিয়েছিলেন সিলেটের হাজারো জনতা। দলমত নির্বিশেষে জানাযায় উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল তিনি আল্লাহর প্রিয় বান্দা ছিলেন। দাফনের পূর্বে আমি নিজে এবং স্যারের বড় ছেলে আবু মো: রুহুল ইসলাম চৌধুরী হিরু বক্তব্য রাখেন। স্যারকে যখন কবরে রাখা হয় আমি সহ অনেকেই জোরে জোরে পড়ছি বিসমিল্লাহি ওয়াআলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ। এর পর কবরের উপর বাঁশ দিয়ে মাটি দিচ্ছি আর পড়ছিলাম কোরআনুল করীমের সেই আয়াতগুলো মিনহা খালাক্ব্নাকুম, ওয়াফিহা নুয়ীদুকুম ওয়ামিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা অর্থাৎ এ মাটি থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদের প্রত্যাবর্তিত করবো। অতঃপর এ মাটি থেকে তোমাদের আবার জীবিত করবো। আমার প্রিয় শিক্ষককে যখন কবরে রেখে চির বিদায় দিয়ে বিশাল আকাশ আর জমিনের মালিক রাব্বুল আলামীনের দরবারে এই মোনাজাত করছিলাম আল্লাহ পাক যেন তাঁর সকল নেক আমল কবুল করেন এবং তাকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে পরিগণিত করেন। আমীন।
লেখক : সিলেট ব্যুরো প্রধান, দৈনিক সংগ্রাম ও প্রাক্তন ছাত্র মদন মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সিলেট।