কাজিরবাজার ডেস্ক :
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিগুণের বেশি বেতনের সঙ্গে বাড়ছে নানা সুযোগ-সুবিধাও। অষ্টম পে-কমিশনের প্রস্তাবে সর্বোচ্চ মূল বেতন ধরা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। আর সর্বনিম্ন মূল বেতন ধরা হয়েছে ৮ হাজার ২০০ টাকা। কমিশনের প্রস্তাবে গ্রেডের সংখ্যা কমিয়ে ২০ থেকে ১৬ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পদোন্নতি হোক বা না হোক, সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরির বয়স ১৫ বছরে বেতন দ্বিগুণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকারি চাকুরেদের জন্য বাণিজ্যিক একটি ব্যাংক গঠনের সুপারিশ করেছে জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কল্যাণ ফান্ডের ২০ বা ২৫ কাঠা জমি বিক্রি করে ‘সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংক’ স্থাপন করা যেতে পারে। পাশাপাশি বীমা খাতের উদ্বৃত্ত থেকে ৫০০ শয্যার হৃদরোগ হাসপাতাল নির্মাণের কথাও বলা হয়েছে। তবে লোকসানি প্রতিষ্ঠান যেমনথ সরকারি ব্যাংক ও বীমার জন্য আলাদা বেতন কাঠামোর পক্ষপাতী নয় সরকার গঠিত এ কমিশন। এগুলোসহ সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ১৮টিরও বেশি সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন সচিবালয়ে রোববার সকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে তুলে দেন জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগে কমিশন চেয়ারম্যান ফরাসউদ্দিন বলেন, অষ্টম জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশনের সুপারিশের চারটি বিশেষ দিক হলো ২০০৯ সালের সপ্তম বেতন স্কেল ২০০৫ সালের ১ জুলাই থেকে ২০০৯ সালের ৩০ জুন অর্থাৎ চার বছরের জন্য প্রণীত হয়েছিল। আর বর্তমান কমিশনের সুপারিশের ভিত্তি ছয় বছর। ২০০৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ৩০ জুন হলে ছয় বছর হবে। বেতন ও চাকরি কমিশনের সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, বেতন ও চাকরি কমিশন বিভাজন সৃষ্টিকারী শ্রেণীকরণ রহিত করা হয়েছে। এখন থেকে গ্রেড বা ক্লাস দিয়ে পরিচয় করা যাবে। উপনিবেশ আমলের শেষ একটি শোষণ যন্ত্র ইবি বা এফিসিয়েন্সি বার তুলে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অনেক জটিলতা ও মামলা-মোকদ্দমার উৎস সিলেকশন বি ও টাইম স্কেলের বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। মূলত পদোন্নতির মাধ্যমে পরবর্তী উচ্চতর ধাপে ওঠার ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে। চতুর্থ থেকে ১৬তম গ্রেড বা স্কেলের বেতনে একই হারে অর্থাৎ শতকরা ৫ ভাগ প্রথমবারের মতো চক্রবৃদ্ধি হারে বার্ষিক বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফরাসউদ্দিন বলেন, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত ধার্য করা হয়েছে ১ দশমিক ৯০৭৬, যা গত কয়েকটি কমিশন একইভাবে রেখেছে। এছাড়া নতুন চাকরিতে যোগদানকালে একটি স্থিতি ভাতার সুপারিশ করা হয়েছে। ২০১২ সালে প্রদত্ত ২০ ভাগ মহার্ঘ্য ভাতা অষ্টম বেতন ও চাকরি কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার তারিখে বিলুপ্ত হয়েছে বলে গণ্য করা যেতে পারে। ২০১৫-১৬ সালের ১ জুলাইয়ে কমিশনের সুপারিশ যতটুকু কার্যকর করা হবে তাতে ব্যয় বৃদ্ধি হবে শতকরা ৬৩ দশমিক ৭ ভাগ। আর রাজস্ব আয়ের ভিত্তিতে খরচ বাড়বে অতিসামান্য। বাজেট অনুপাতে বেতন-ভাতা, অবসর ভাতা, সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান মিলে খরচ শতকরা ১৪ দশমিক ২ ভাগ বাড়বে, যেটা আগের কমিশন ১৫ শতাংশ করেছিল।
কমিশন চেয়ারম্যান ফরাসউদ্দিন বলেন, যারা এক পদে সারা জীবন কাটিয়ে দেন তাদের জন্য নতুন করে অর্গানোগ্রাম সৃষ্টি করা ঠিক হবে। সচিবালয় ও সচিবালয়ের বাইরের কর্মচারী যারা একই বেতনে, একই যোগ্যতায় চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ১৯৯৫ সালের যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
যেহেতু সরকারি চাকুরেদের বেতন বৃদ্ধি করা হচ্ছে তাই নতুন করে ভাতা সৃষ্টির প্রয়োজন হবে না বলে মনে করছে পে-কমিশন। পে-কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, বিদ্যমান ভাতা নির্দিষ্ট অঙ্কে অথবা হারের মধ্যে সর্বোচ্চ সীমারেখা বেঁধে দেয়া উচিত। প্রেষণসহ সব রকমের ভাতা বাতিল করা যেতে পারে। পাশাপাশি কমিশন ডেপুটেশন না রাখার সুপারিশ করছে। কমিশন বিশেষ ভাতা সমর্থন করেনি। বাড়ি ভাড়া ভাতা আরও যৌক্তিক করার তাগিদে তিন ধরনের ক্ষেত্রের পরিবর্তে চার ধরনের করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় জেলা শহর এবং অন্যান্য এলাকার ক্ষেত্রে এ প্রস্তাব করা হচ্ছে। এতে সর্বমোট চারটি ক্যাটাগরি রয়েছে।
কমিশন লোকসানি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে আলাদা বেতন কাঠামো সমর্থন করে না বলে জানিয়েছেন এর চেয়ারম্যান ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাত, আর্থিক ও বীমা প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক বেতন কাঠামোর প্রয়োজন নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকে আলাদা বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে সরকার সিদ্ধান্ত নিলে তা কমিশন সমর্থন করে। বর্তমান কল্যাণ ফান্ডকে পুনর্গঠিত করার সুপারিশ করেছে বেতন ও চাকরি কমিশন। কল্যাণ ফান্ডকে বীমা ব্যবস্থাপনা, পেনশন ফান্ড ব্যবস্থাপনা এবং কল্যাণ ফান্ড ব্যবস্থাপনা এ তিনটি ভাগে ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত করার কথা বলা হয়। কল্যাণ ফান্ডের দৈনিক বাংলার মোড়ের জমি থেকে ২০ বা ২৫ কাঠা জমি বিক্রি করে ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন যোগাড় করে ‘সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংক’ স্থাপনের কথা বলেছে কমিশন। ব্যাংকটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মালিকানায় হবে। প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে ৪ হাজার টাকার শেয়ার থাকবে। এ ব্যাংকটি একটি উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক ধর্মী ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে। কমিশন মনে করে, ব্যাংকটিতে নজর দিলে এক অঙ্কের সুদে ঋণ দেয়া সম্ভব।
বীমা খাতের উদ্বৃত্ত থেকে ৫০০ শয্যার একটি আধুনিক হৃদরোগ হাসপাতাল সরকারি চাকুরেদের জন্য নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কমপ্রিহেনসিভ বীমার ক্ষেত্রে সরকার প্রতিজন চাকুরের জন্য মাসে ৪০০ টাকা হারে সাধারণ হসপিটাইলাইজেশন, এঙি্ডন্টে এবং ১০০ টাকা লাইফ প্রিমিয়াম দিয়ে পাঁচ বছরের মেয়াদে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ, হাসপাতালের খরচসহ বীমা দাবি সরাসরি হাসপাতালে পরিশোধিত হতে পারে। কোনো ক্যাশপেমেন্টের ব্যবস্থা থাকবে না।
রিয়েল এস্টেটদের মাধ্যমে সরকারের পুরনো বাড়িঘর ভেঙে অথবা খাস জমি দিয়ে ৬০ থেকে ৪০ ভিত্তিতে সরকারি চাকুরেদের আবাসনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। অন্য একটি বিকল্প হলো, ৩০ বা ১০ জনের গ্র“পকে ৫ বা ১০ কাঠা জমি গৃহ নির্মাণের জন্য দেয়া। এক্ষেত্রে ৫০ মাসের বেতন ব্যাংক রেটে দেয়া যেতে পারে। অন্যথায় সাধারণভাবে জমি কেনার প্রমাণসাপেক্ষে ব্যাংক রেটে ৫০ মাসের মূল বেতন ঋণ হিসেবে দেয়া যেতে পারে।
প্রাধিকারপ্রাপ্তদের বাইরে তৃতীয় গ্রেড ও তার উচ্চতর কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার জন্য ঋণ নিরীক্ষামূলকভাবে এক বছর ঋণ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। ফরাসউদ্দিন জানান, ঋণের পরিমাণ হবে ২৫ লাখ টাকা। এ ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
অষ্টম বেতন ও চাকরি কমিশনের সুপারিশ এমপিওভুক্তদের ক্ষেত্রে ছয় মাস পর কার্যকর করার সুপারিশ করা হয়েছে।
পেনশন সম্পর্কে ফরাসউদ্দিন বলেন, পেনশনের হার শতকরা ৯০ ভাগে উন্নীত করা যায়; এটা আগে ৮০ ভাগ ছিল। এছাড়া ছুটি পাওনাসাপেক্ষে পেনশনে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১২ মাসের বদলে ১৮ মাসের বেতন নগদায়নের কথা বলেছে কমিশন। স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার সময় ২০ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে। এলপিআর ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার বিষয় বিবেচনার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া যে হারে বেতন বাড়বে সে হারেই পেনশন বাড়ানোর কথাও বলেছে জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন। তবে যারা সম্পূর্ণ বেতনের টাকা পেনশনকালে নিয়ে গেছেন তাদের চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনো সুপারিশ করা হয়নি। পে-কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আমাদের ইচ্ছাটা হলো, এটা কার্যকর করব ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে আর আগামী অর্থবছর থেকে বাস্তবায়ন শুরু হবে। এটুকুই এখন বলতে পারি। এর চেয়ে বেশি কমেন্ট করা কঠিন। মন্ত্রী বলেন, আমরা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য এরই মধ্যে বাজেটে কিছু রেখেছি। তাই এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। তবে এটা বলতে পারি, সরকারের কাছে অর্থ আছে।