ভয়াবহ যানজটের কারণ ও উত্তরণের উপায়!

580

॥ মকসুদ হোসেন ॥

রাজধানীসহ সিলেট চট্টগ্রামে ভয়াবহ যানজট নিয়ে সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রিক মিডিয়ায় সচিত্র প্রতিবেদন প্রায়ই পরিবেশন করা হচ্ছে। যানজটের মূল সমস্যা হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে যানজটের বিভিন্ন কারণগুলো। যানজটের কারণে বছরে পঁচিশ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বলে বিগত ১৮ই সেপ্টেম্বর ’০৯ ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’ প্রকাশিত হয়েছিল। বছরে কত কর্ম ঘণ্টা নষ্ট এবং জ্বালানীর অপচয় হয় তা গবেষণা করে বুয়েটের এক অধ্যাপক ড. জুবায়ের দীন আলম এই তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। এই পাঁচ বছরে এ যানজটের কারণে জুবায়ের সাহেবের তথ্যের হিসাব অনুযায়ী ১২৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ১৭ই জানুয়ারী ২০১০ইং দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছিল ফ্লাইওভারেও ভয়াবহ যানজটে রূপ নিয়েছে। ৯ মে ২০১৪ বছরে শত শত কোটি টাকা চাঁদা ঢাকার ফুটপাত থেকে আসে। অন্যদিকে ১৮ নভেম্বর ২০১৪ দৈনিক নয়াদিগন্তে ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। যানজট অক্টোপাসের মতো ধরেছে ঢাকাকে। বছরে ক্ষতি ২০ হাজার কোটি টাকা। সংবাদে আরো বলা হয় ১০ মিনেটর পথ অতিক্রম করতে ১ ঘণ্টা সময় পার হয়ে যাচ্ছে। এতো গেল রাজধানীর ঢাকার চিত্র। ঢাকার বাইরেও যানজটের ভয়াবহতা রয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-আরিচা রোডে যানজট এখন নিত্য ঘটনা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে কোন কোন দিন যাত্রীকে অতিরিক্ত ৫ ঘণ্টার বেশী সময় গুণতে হয়। যানজটের কারণে বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। দিনে নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্ম ঘণ্টা। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টার মধ্যে রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহন গুলোকে গড়ে ৭ ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ ময়নুল হাসান ও পরিবহন বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ মারুফা ইসমাত রাজধানীর বিভিন্ন রুটে সমীক্ষা চালিয়ে ক্ষয়-ক্ষতির এই ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন। এমনকি গত ১২ই নভেম্বর ২০১৪ রাজধানীর সোনাগাঁও হোটেলে একটি অনুষ্ঠানে দেরীতে পৌঁছানোর জন্য সরাসরি যানজটকে দায়ী করেছেন মান্যবর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তিনি যানবাহন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে বলেন, আমাদের কি রাস্তাঘাট ছোট, নিশ্চয়ই না। তিনি ম্যানেজমেন্টকেই অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
ঢাকা শহরে যানজট নিরসনের জন্য সরকারের সেতু ও যোগাযোগ মন্ত্রী ফাটা কেষ্ট নায়কের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পুলিশ বিভাগ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে লোক দেখানো পদক্ষেপ নিচ্ছেন। যেমন গাড়ী উল্টো পথে ঘুরলেই চাকা পাঞ্চার। ফিটনেস বিহীন গাড়ীর বিরুদ্ধে অভিযান, রাজপথে লিফলেট বিতরণ এসব কার্যক্রম সহ অন্যান্য পদক্ষেপে যানজট আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। এমনকি গত এপ্রিল মাসে দৈনিক প্রথম আলোতে এসেছে ফ্লাইওভার গুলোতে লেগুনা টেম্পুর ষ্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে।  যানজটে নাকাল নগরবাসী। ঢাকার রাস্তাগুলো বেশ চওড়া। কেউ কেউ যানজট নিরসনের জন্য সরকারকে বিভিন্ন ধরনের ফর্মূলা ও পরামর্শ দিচ্ছেন। অনেকে রিক্সার কথা বলেন। রিক্সা যানজটের অন্যতম কারণ হতে পারে না। রিক্সা এমন একটি যানবাহন, যার মাধ্যমে অল্প টাকায় বাড়ি বা বাসার সামনে গিয়ে নামা যায়।
প্রশ্ন হলো বিগত ১/১১ তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজধানীতে যানজট নিরসন কেমন করে হলো? তা দেখিয়ে দেয়ার অবকাশ মনে করি না। তাদের আমলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরেও মালামাল হোন্ডিলিংয়ে কার্গোজট বহুলাংশেই কমে গিয়েছিল বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি দেশের সরকারি ও আধাসরকারি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বহুলাংশে শৃংখলা ফিরে এসেছিল। সেই সময় দুর্বৃত্তরাও তটস্থ ছিল। বর্তমানে দুর্বৃত্তরা ও দুর্নীতিবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সর্বত্রই আজ বিশৃংখলা বিরাজ করছে। আমি একজন সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তি। তার পাশাপাশি উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতি বন্ধের লক্ষ্যে সিলেট নগরীতে একটি সংগঠনের সাথে কাজ করে যাচ্ছি। ১/১১ সরকারের প্রশংসা বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকেই উল্লেখ করেছি। প্রায় গণমাধ্যমে দেখা যায়, যানজট নিরসনের জন্য কর্তৃপক্ষ নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন যা অন্তঃসার শূন্য। সংসদীয় কমিটির কাছে কয়েকটি সুপারিশমালা দিয়েছেন। তাতে উল্লেখ ছিল, লিংক রোড, ফ্লাইওভার সহ বিভিন্ন নতুন নতুন এবং ব্যয়বহুল পদক্ষেপ গ্রহণের। এই সমস্ত প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়নের ফলে শুধু লুটপাট হয়েছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সুপারিশমালা গুলোতে সচেতন মহল মনে করেন কৌশলে যানজটের মূল সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়। ভয়াবহ এই যানজটের কবলে পড়ে বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর দৈনন্দিন কর্মসূচি তছনছ হয়ে যাচ্ছে। যানজটের মূলসমস্যা হচ্ছে ফুটপাত অবৈধভাবে দখল, নগরীর প্রধান প্রধান সড়কের অর্ধেক জায়গা জুড়ে দোকানপাট, অবৈধ গাড়ি পার্কিংসহ রাজপথ দিয়ে সাধারণ পথচারিদের চলাফেরা অন্যতম কারণ। ঢাকার ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, নয়াপল্টন, বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, পল্টন, ফার্মগেইট মোড়, মৌচাক, মালিবাগ, নিউ এ্যালিফেন্ট রোড, সায়দাবাদ ও গাবতলী সহ প্রধান প্রধান রাস্তার উপর অবৈধ স্থাপনা ও পার্কিং এবং টং দোকানগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। যা গণমাধ্যমে ফলাওভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এর সাথে জড়িত একশ্রেণীর পুলিশ প্রশাসন ও দুর্বৃত্তরা। প্রায় দেখা যায়, রোগী বহনকারী এম্ব্যুালেন্সগুলো সাইরেন বাজানোর পরেও যানজট থেকে মুক্তি না পেয়ে সময়মত গন্তব্যে পৌঁছতে না পেরে কত বনী আদম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। তার হিসাব কিন্তু কেউ রাখেনি। নিম্নে প্রদত্ত কয়েকটি  পদক্ষেপ জরুরীভাবে গ্রহণ করলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর ভরসা করে বলতে পারি দেশের এই ভয়াবহ যানজট বহুলাংশে কমে আসবে ইনশাআল্লাহ!
১.    রাজধানীর প্রধান প্রধান ফুটপাত এবং রাজপথ সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত হকার ও অবৈধ স্থাপনা এবং যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
২.    বিভিন্ন বিতানী মার্কেটের দোকানগুলোর মালামাল তাদের দোকানের নিজ সীমানায় রাখতে হবে এবং ল্যান্ড সাইনবোর্ডগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।
৩.     প্রধান প্রধান সড়কের উপর পার্কিং লিজ বাতিল করতে হবে।
৪.    নির্দিষ্ট পার্কিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। নির্দিষ্ট পার্কিং ছাড়া যে কোন যানবাহন পার্কিং করলে পার্কিংকারি ব্যক্তি যতই ক্ষমতাধর হোন না কেন তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫.    প্রধান প্রধান রোড বা মোড়ের রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে গাড়িতে না ওঠা এবং সিগনাল অমান্য করে রাস্তা পারাপার না হওয়ার জন্য ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে প্রয়োজনে মাইকিং প্রচারণা ও খবরদারী ভূমিকা রাখতে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।
৬.    রাস্তার প্রধান প্রধান মোড়ের টিকিট কাউন্টারগুলো উঠিয়ে রাস্তা হতে কমপক্ষে ছয়শত গজ দূরে নিয়ে বসাতে হবে।
৭.    যাত্রীবাহী বাসগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় থেমে অর্থাৎ ফুটপাত ঘেঁষে যাত্রীদের নামাতে হবে।
৮.    টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার গাড়িগুলো বের হওয়ার সাথে সাথে যত্রতত্র পার্কিং বন্ধ করতে হবে। যদি পার্কিং এর প্রয়োজন হয় তবে নির্দিষ্ট জাযগায় নিয়ে পার্কিং করতে হবে।
৯.    যে সমস্ত বহুতল মার্কেট এবং বিপণী বিতানের নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা নেই তাদেরকে তড়িৎ গতিতে পার্কিং ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় তাদের ব্যবসার লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ বা প্রয়োজনে বাতিল করতে হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১০।    মহাসড়কগুলোতে যানজটের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে রাস্তার উপর হাট-বাজার গাড়ী মেরামত সহ সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক মোবাইল টিম চালু রাখতে হবে।
১১।    হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য শুক্র, শনি ও রবিবার এই তিনদিন তাদেরকে নিয়মমাফিক দিক নির্দেশনা দিয়ে রাস্তায় ব্যবসা করার সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। বাকী সপ্তাহের চার দিন কোন অবস্থায় হকার ও ক্ষদ্র ব্যবসায়ীরা যান চলাচল ও পথচারীদের চলাচলে যাতে কোন বিড়ম্বনা ও প্রতিবন্ধকতা না করেন সেদিকে নজরদারী ও প্রয়োজনীয় কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।