বছরের শুরুতেই বাড়ছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম ॥ যে দিন ঘোষণা আসবে সে দিন থেকেই লাগাতার কর্মসূচি-মির্জা ফখরুল

60

el_43758_0কাজিরবাজার ডেস্ক :
নতুন বছরের শুরুতেই বিদ্যুৎ ও আবাসিক-বাণিজ্যিকসহ সব খাতেই গ্যাসের দাম বাড়ছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধিতে রপ্তানিমুখী শিল্পে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করে শিল্প মালিকরা বলছেন দাম না বাড়িয়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ বন্ধ করে সিস্টেম লস কমানের কথা। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষের দুর্ভোগে পড়ার আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেনÑ অধিক মুনাফার ক্ষেত্র বানানোর নীতি অনুসরণ করতে সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চিন্তা করছে। তবে সরবরাহে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে প্রকৃত অর্থে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নয় বরং সমন্বয় করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। আর দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে লাগাতার কর্মসূচির হুমকিও দিয়েছে তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এবং তেল গ্যাস ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিও গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগের প্রতিবাদে কর্মসূচি পালন করেছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মোট ১৯টি ক্ষেত্রের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে। বর্তমানে গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ২২৫ কোটি ঘনফুট। দৈনিক চাহিদা প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ঘাটতি দৈনিক ৭৫ কোটি ঘনফুট। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার বিপ্লব ঘটিয়েছে। বর্তমানে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
ভর্তুকি কমাতে মহাজোট সরকার ২০০৯ সাল থেকে গ্রাহক পর্যায়ে সাত বার এবং পাইকারি পর্যায়ে ছয় বার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। অন্যদিকে বর্তমান সরকার গত মেয়াদে গ্যাসের (সিএনজি) মূল্য দুবার বৃদ্ধি করে এবং এর আগে ২০০৯ সালের পহেলা আগষ্ট বিইআরসি আবাসিক গ্রাহকদের জন্য ১১ শতাংশ হারে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে। চলতি মাসে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোবিষয়ক শুনানির কথা রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও জানুয়ারি থেকে বর্ধিত মূল্য কার্যকর হতে পারে। এ প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে না। সময়ের সঙ্গে আমরা কেবল মূল্যটাকে সমন্বয়ের চেষ্টা করছি। বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে হলে ব্যবহার কমাতে হবে। তিনি বলেন, আগামী চার বছরের মধ্যে সাশ্রয় মূল্যে হাউজহোল্ড গ্যাস সরবারাহ করা হবে।
গত ১৩ অক্টোবর বিইআরসির কাছে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১৮.১২ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সাত প্রতিষ্ঠান গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিইআরসিতে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানোর দলে রয়েছে পেট্রোবাংলা, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি। প্রস্তাবিত দামে আবাসিক গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম ১২২ শতাংশ বাড়িয়ে এক চুলার জন্য ৪০০ টাকার স্থলে ৮৫০ টাকা ও দুই চুলা ৪৫০ টাকার স্থলে এক হাজার টাকা করা হচ্ছে। শিল্পের জন্য প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ১৬৫.৯১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২২০ টাকা, বাণিজ্যিক ২৬৮.১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০৫ টাকা, চা-বাগানে ১৬৫.৯১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা, শিল্প-কারখানায় স্থাপিত নিজস্ব বিদ্যুৎ বা ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১১৮.২৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪০ টাকা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস ৭৯.৮২ টাকা থেকে ৮৪ টাকা, সিএনজিতে ৬৫১.২৯ থেকে ৯০৫.৯২ টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে দর প্রস্তাবে। সার কারখানায় গ্যাসের দাম প্রতি হাজার ঘনফুট ৭২.৯২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনুমোদন দিয়েছেন। সূত্র জানায়, পেট্রোবাংলা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত প্রস্তাব জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে জমা দিয়েছে। কমিশন এখন আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেবে।
আবাসিক খাতের গ্যাসের দামবৃদ্ধির প্রভাব ভোক্তাদের ওপর প্রত্যক্ষভাবে পড়ে। শিল্প-বাণিজ্য এবং বিদ্যুৎ-সারে ব্যবহার করা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব বেশি। এর প্রভাব পরোক্ষ বলে তা জনসাধারণ অনেক সময় বুঝতে পারে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেনÑ বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ প্রাকৃতিক গ্যাস বাপেক্সকে দিয়ে উত্তোলনকালে এর উৎপাদন খরচ ছিল নামমাত্র। পরে গ্যাস উৎপাদন অনুসন্ধানের কাজ তুলে দেয়া হয় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির হাতে। ইজারাদার এসব বিদেশি তেল কোম্পানির কাছ থেকে আন্তর্জাতিক দামে গ্যাস কিনতে গিয়ে গ্যাস প্রাপ্তির ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। এটি পুষিয়ে নিতে দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। তবে বর্তমান মূল্যে বিক্রিতে প্রকৃতপক্ষে গ্যাস খাতে কোনো ভর্তুকি না থাকার পরও নতুন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে জনজীবনে ভোগান্তি নেমে আসবে বলে ভোক্তা অধিকার ফোরামের বক্তব্য।
এদিকে গতকাল নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মহাসচিবদের বৈঠক শেষে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ালে লাগাতার কর্মসূচির হুমকি দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যেদিন দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসবে সেদিন থেকেই লাগাতার কর্মসূচি শুরু হবে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য অনেক কমেছে। অথচ বাংলাদেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। এর মধ্যে সরকার আবারো গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের দুর্নীতি ও লুটপাটের জন্যই মূল্য বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে।
সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই জনগণের স্বার্থে বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বাসদের খালেকুজ্জামান বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক। এর ফলে জনগণের কষ্ট বাড়বে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বাড়তি আয় দিয়ে যদি সরকার এ খাতের উন্নতি করতো, তাহলে হতো। কিন্তু তা হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রতি মাসে গ্যাস বিলের সঙ্গে বিলের ১১ দশমিক ২২ শতাংশ অর্থ দিয়ে ভোক্তারা গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করেছেন। এ অর্থ দিয়ে অনুসন্ধান ও উৎপাদনে নিয়োজিত দেশি কোম্পানির বিনিয়োগ সমতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এ অর্থ কোনো কাজে লাগাচ্ছে না সরকার।
অপরদিকে মূল্য বাড়ানোর চেয়ে চুরি ও অবৈধ সংযোগ বন্ধ করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন শিল্প মালিকরা। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এম সফিকুল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, নতুন করে জ্বালানির মূল্য বাড়ানো হলে উৎপাদন খাতে নেতিতবাচক প্রভাব পড়বে। উৎপাদন খরচ বাড়লে অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়তে পারে হাজার হাজার কর্মজীবী ও শ্রমিক।  বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদি বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এই খামখেয়ালি  সিদ্ধান্তের ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অনেক উপাদনমুখী শিল্পকারখানা বন্ধ হবে। তিনি বলেন, দাম না বাড়িয়ে সরকারের উচিত গ্যাস ও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ বন্ধ করে সিস্টেম লস কমিয়ে সুষ্ঠু বণ্টনের ব্যবস্থা করা।