বাক স্বাধীনতা ও ইসলাম বিদ্বেষ

241

ওলীউর রহমান

বাকস্বাধীনতা একটি স্বাধীন দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু অধিকাংশ স্বাধীন দেশের মানুষ সে অধিকার থেকে এখন বঞ্চিত। তবে ‘বাকস্বাধীনতাকে’ ইসলামের বিপক্ষে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে ইঙ্গ মার্কিন এবং তাদের দোসর ইসলাম বিদ্ধেষী নাস্তিকরা। ‘মুসলমানদের স্বাধীনতা থাকতে নেই’ এই পুড়া মাটি নীতি যেসব দেশে ইঙ্গ মার্কিনীরা প্রয়োগ করতে পারছেনা অথবা যেসব দেশে সরাসরি কাস্টার বোমা ফেলা যাচ্ছেনা সেসব দেশে বাকস্বাধীনতাকে তারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের সেই কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে তাদের খরিদ করা কিছু সেবাদাস। এই সেবাদাসগুলোর অধিকাংশ আবার পিতৃ পরিচয়ে মুসলমান, পিতৃপ্রদত্ত্ব ইসলামী নাম ধারন করেই নাস্তিকতার পোশাক পরে ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় কটুক্তি করে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে কিছু লোক আছে যারা ইসলাম ধর্মের কোরআন হাদীস, নবী রাসূল, নামাজ, পর্দা, পরকাল, হজ্ব, তাবলীগ এমনকি মহান আল্ল¬াহ সম্পর্কেও আজে বাজে কথা বলে। এই শ্রেণীর লোকেরা নিজেদেরকে মুক্ত চিন্তার অধিকারী, অতি আধুনিক ও প্রগতিশীল হিসাবে জাহির করতে গিয়ে আঘাত করে ইসলামকে। আর আমাদের দেশের বাস্তব অবস্থাও হলো যে, ইসলাম সম্পর্কে কিছু উল্টা পাল্টা কথা বলতে পারলেই একে আধুনিক ও প্রগতিশীল মনে করা হয়। অথচ এদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ মুসলমান এবং ধর্মপ্রাণ। ইসলামকে মনে প্রাণে এরা ভালবাসেন। এদের বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ বা একত্ববাদ। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলের এ ভূখন্ডে প্রায় তিন লক্ষ মসজিদ রয়েছে। প্রতিটি মসজিদের মিনার থেকে রোজানা পাঁচ বার দরাজ কন্ঠে আযান দেয়া হয়। ফজরের মনমুগ্ধকর আযানের সুরেই এদেশের মুসলমানদের ঘুম ভাঙ্গে। মসজিদ, মাদরাসা, আযান, ইকামত ইত্যাদি হচ্ছে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অংশ। এদেশের মানুষের কাছে কোরআন, হাদীস, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় গ্রন্থাদি, ধর্মীয় পোশাক সম্মানের পাত্র। ধর্মীয় ব্যক্তি, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও কৃষ্টি কালচারের প্রতি রয়েছে সীমাহীন শ্রদ্ধা ও ভক্তি। ধর্মীয় অনুভূতির বিশেষ একটি প্রভাব রয়েছে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতেও। সঙ্গত কারণেই ইসলাম সম্পর্কে যখনই কোন কটুক্তি বা কটাক্ষ করা হয় এবং দেশের নব্বই ভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি এবং বিশ্বাসে আঘাত হানা হয় তখন গোটা দেশ আন্দোলিত হয়ে উঠে, হরতাল, অবরোধ, মিছিল, মিটিং ইত্যাদির আহবান করা হয়। জাতীয় সংকট সৃষ্টি হয়। অথচ বার বার গায়েপড়ে ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি করা হচ্ছে, ধৃষ্টতা দেখানো হচ্ছে এবং দেশে সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে? আর বহির্বিশ্বেও আমাদের ধর্মীয় ভাবমূর্তিকে কলুষিত করা হচ্ছে। এসব কেন করা হচ্ছে?
১৯৭৪ সালে দাউদ হায়দার ইসলামকে কটাক্ষ করে কবিতা লিখলে গোটা দেশ জুড়ে তাওহিদী জনতাা ফুঁসে উঠে। অবশেষে দাউদ হায়দার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় এবং এখনো তিনি নির্বাসিত অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছেন। বিগত দুই দশক ধরে এদেশে ইসলাম বিদ্বেষ প্রবণতা আশংকা জনক ভাবে বেড়ে চলেছে। এর একটা কারণও আছে। ১৯৯৩ সালে আমেরিকান প্রফেসর স্যামুয়েল হান্টিংটন “তার সভ্যতার সংঘাত” (ঈষধংয ড়ভ ঈরারষরুধঃরড়হং) তত্ত্বে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, “পৃথিবীকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে ইসলামী সভ্যতার জগৎ এবং অপরটি হচ্ছে অন্য সব সভ্যতার জগৎ। আর সভ্যতার সংঘাত এড়াতে হলে কোন সভ্যতাকেই প্রধান্য দেয়া যাবে না।” অর্থাৎ তিনি তার এই থিওরীতে ইঙ্গ-মার্কিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইসলাম বিদ্বেষী অক্ষ শক্তিকে একথা বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে, এই মুহূর্তে যদি ইসলামী সভ্যতাকে কোনভাবে দমন ও প্রতিহত করা না যায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে গোটা দুনিয়া ইসলামী সভ্যতার ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে যাবে। এর পর থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলাম বিদ্বেষ প্রবণতা নতুন মাত্রা লাভ করে। আফগানিস্তান ও ইরাকে অন্যায় অভিযান চালিয়ে ইঙ্গ-মার্কিনীরা দেশ দুটির লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে সভ্যতার লীলাভূমিকে তারা বধ্যভূমিতে পরিণত করে। এভাবে আরো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। এ সময়ে ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, সুইডেন ইত্যাদি দেশে ইসলাম বিদ্বেষীরা রীতিমত উন্মাদের মত আচরণ শুরু করে। সেই সাথে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশেও তসলিমা নাসরিন ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি করে। যার ফলে  সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠে। তখন বিএনপি সরকার ছিল। বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে কিশোর গঞ্জের স্কুলছাত্র আরমান আহমদ শাহাদত বরণ করে। অবশেষে দাউদ হায়দারের মত তসলিমাও দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ২০০৫ সালে ডেনমার্কের একটি পত্রিকা মহানবী (সা.) সম্বন্ধে আপত্তিকর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে। ২০০৭ সালে সুইডেনের একটি পত্রিকা হযরত মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে অনুরূপ একটি আপত্তিজনক ব্যাঙ্গচিত্র প্রকাশ করে। এর প্রতিবাদে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে বিক্ষোভ শুরু হয়। এ ঘটনার মাত্র একমাস পরেই বাংলাদেশের ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা এবং সাপ্তাহিক ২০০০ হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে আপত্তিকর ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশ করে। আর এভাবেই বাংলাদেশে স্যামুয়েল হান্টিংটনের “সভ্যতার সংঘাত” ফর্মূলার চর্চা শুরু হয়।
চলমান শতাব্দির দ্বিতীয় দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে ইসলাম বিদ্বেষ প্রবণতা বিপদজনক আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময় ইসলাম সম্পর্কে যেসব লাগামহীন কথাবার্তা ও মন্তব্য করেছেন তা বার বার ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়ে আঘাত করেছে এবং ইসলাম বিদ্বেষ প্রবণতাকে উস্কে দিয়েছে। ২০০৯ সালে ২৮ মার্চ দেশের সর্ববৃহৎ সরকারী ইসলামী প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি শামীম আফজাল ইসলাম সম্পর্কে জঘন্যতম কটুক্তি করেন। তিনি একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, পৃথিবীতে যত সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ রয়েছে, তার সবই ইসলাম ও মুসলমানদের মধ্যে (!)। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের মধ্যে কোন জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস নেই। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নয়। এই শামীম আফজাল ২০১০ সালে আরেকটি ঘৃণিত কাজ করেন। এ বছরের নভেম্বর মাসে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একটি ইমাম সম্মেলনে আমেরিকান তরুণ তরুণীদের দিয়ে অশ্লীল ব্যালে নৃত্য পরিবেশন করেন। দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এমন সব বক্তব্য শুধু দুঃখজনক নয় বরং জাতি হিসেবে আমাদের জন্য কলঙ্কজনকও বটে। শুধু বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং ২০১০ সালের আগষ্ট মাসে পবিত্র কোরআনের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। আর সেই মামলা দায়ের করেছিল বিশ্ব শান্তি পরিষদের সভাপতি দেবনারায়ণ মহেশ্বর। সে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত পরিবর্তন করে দেয়ার জন্য আদালতের কাছে প্রার্থনা করেছিল। অবশ্য আদালত তার রিট খারিজ করে দিলে তার এ ধৃষ্টতার জন্য উপস্থিত আইনজীবীরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন। অতঃপর পুলিশ প্রহরায় তাকে নিারাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে আর কোন প্রকার বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। শুধু এ ঘটনা নয় বরং এরূপ আর যতগুলো ইসলাম বিদ্বেষের ঘটনা ঘটছে কোন ঘটনারই সুষ্ঠু ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের ব্যবস্থা না করায় একের পর এক নাস্তিক মুরতাদদের আবির্ভাব ঘটছে এবং এরা তাদের প্রভুদের খুশি করার জন্য ইসলামকে নিয়ে রীতিমত খেল তামাশা শুরু করেছে।
আজ কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলোতে কোন ছাত্র বা ছাত্রী নিয়মিত নামাজ পড়লে, টুপি বা বোরকা পরলে, দাড়ি রাখলে, ইসলামী বই সাথে রাখলে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রƒপ করা হয়, সন্দেহ করা হয় এবং জঙ্গী মৌলবাদী ইত্যাদি তকমা দিয়ে গ্রেফতার বা হয়রানী করা হয়। ্এসব ইসলাম বিরোধী তৎপরতা এবং বক্তব্যের নগদ ফলাফল হিসেবে আমরা ২০১৩ সালে শাহবাগে চরম ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকতার নগ্ন উন্মাদনা দেখেছি। ২০১৩ সালে আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করে রাজধানীর শাহবাগ কে কেন্দ্র করে যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল জানিনা ইতিহাস এই জাগরণকে কোন দৃষ্টিতে দেখবে কিন্তু এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্লগাররা ইসলাম সম্পর্কে যেসব কটুক্তি করেছে ইসলামপূর্ব জাহিলিয়াতের বর্বর সমাজেও এরূপ ইসলাম বিদ্বেষের নজীর পাওয়া যায়না। আরবের জাহিলী বর্বর সমাজের লোকেরা ইসলামের প্রচন্ড বিরোধীতা করা এবং মুসলমানদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পরও তারা হজ্ব, কাবাশরীফ, মহান আল্ল¬াহ এবং মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর চরিত্র নিয়ে কটুক্তি করে নাই। অথচ বাংলাদেশের মত একটি দেশে এই ঘৃণিত কাজগুলো অহরহ সংঘটিত হচ্ছে। সর্বশেষ লতিফ সিদ্দিকী টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী থাকা অবস্থায় একটু বেশি নগ্নভাবে ইসলামের উপর আক্রমণ করেছেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়ের্কে একটি অনুষ্ঠানে তিনি হজ্ব, তাবলীগ জামাত এবং মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কটুক্তি করে বক্তব্য দিয়েছেন। অবশ্য তিনি এর আগে ২০০৯ সালে তৎকালীন পাটমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বলেছিলেন, ধর্ম মদ ও তামাকের মত একটি নেশা। তার আপত্তিকর বক্তব্যে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়েছেন। যার দরুণ তাকে মন্ত্রীত্ব সহ দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি এখন আমেরিকা থেকে দেশে না এসে শুনা যাচ্ছে তসলিমা নাসরিনের মত ভারতে অবস্থান করছেন।
তসলিমা নাসরিন ও লতিফ সিদ্দিকী সহ যারা ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি করেছেন তাদের অধিকাংশ পিতৃ পরিচয়ে মুসলিম এবং পিতৃপ্রদত্ত ইসলামী নাম ধারণ করেই ইসলাম সম্পর্কে কটাক্ষ করে চলেছেন। তাদের সকলের মধ্যে মতাদর্শগত একটা মিল থাকা সত্ত্বেও তারা কেবল বাক স্বাধীনতার খাতিরেই ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি করছেন তা নয় বরং তারা সবাই একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করে চলেছেন। আর তা হচ্ছে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে দুর্বল করে ধর্মহীনতার ব্যাপক প্রসার ঘটানো। একাজে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মিডিয়া তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও চেতনাকে ইসলামের বিপক্ষে দাঁড় করানো এবং ইসলামের বিভিন্ন প্রতীক যেমন টুপি, দাঁড়ি, পাঞ্জাবী, বোরকা ইত্যাদিকে কলুষিত করে যুব সমাজের কাছে উপস্থাপন করার জন্য এদেশের কিছু কিছু মিডিয়া আদাজল খেয়ে লেগেছে। ইসলামপন্থীদের ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, জঙ্গি ইত্যাদি বলে নানা অপপ্রচার চালিয়ে ইসলামকে কলুষিত করার কাজে নিয়েজিত আছে এই মিডিয়াগুলো। আর এরূপ নানা রকমের অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে এদেশের জনগণের বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশের ধর্ম বিশ্বাসকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। ফলশ্র“তিতে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর এভাবে স্যামুয়েল হান্টিংটনের “সভ্যতার সংঘাত” তত্ত্বের কোন পরিকল্পনা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি না এটাই হলো আশংকার বিষয়। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নাস্তিকতা এবং ইসলাম বিদ্বেষ প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন এবং এ সংক্রান্ত যে আইন রয়েছে এই আইনকে যুগোপযোগী এবং আর কঠোর করা প্রয়োজন।