আজ জকিগঞ্জ মুক্ত দিবস ॥ একাত্তরের ২১ নভেম্বর শ্বাসরুদ্ধকর ১২ ঘণ্টা

165

জেড, এম, শামসুল

২১ নভেম্বর ১৯৭১ সালে এই দিনে জকিগঞ্জ থানা হানাদার মুক্ত হয় । দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্য দিয়ে ভারতীয় মিত্র বাহির সহযোগীতায় অসংখ্য আহত নিহতের মধ্য দিয়ে জকিগঞ্জ থানা সদর সহ আশ-পাশ এলাকা শত্র“ মুক্ত হয়। এই দিনের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার কথা স্মরণ হলে এখন আঁতকে উঠতে হয়। ঈদের দিন সন্ধ্যার পূর্বেই জকিগঞ্জে সুরমা ও কুশিয়ার নদী পার হয়ে মুক্তিবাহিনী বাংলার গ্রামে গ্রামে প্রবেশ করে। দীর্ঘ ২২৩ দিনের মধ্যে নদীর তীর কি ? নিজের বসত বাড়ীতে শান্তিতে ছিলাম না কোন মুর্হর্তে বিপদ আসবে। তা নিয়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটাতে হয়েছে মাত্র কিছু দিন পূর্বে স্থানীয় লোহার মহল গ্রামের ১২ জনকে ধরে নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে ঘাতক বাহিনী। এর ২/৩ দিন পরেই এক জুম্মাবার আমার পিতাকে স্থানীয় রাজাকার ও পাঞ্জাবী সেনাবাহিনীর কুখ্যাত বশরাত ক্যাপন্টেন ও তার সহযোগিরা ভূঁইয়ার মোরা জামে মসজিদে প্রবেশ করে নামাজরত অবস্থায় আটক করে মুসল্লীদের সামনে চরম নির্যাতন চালায়। এ সময় স্থানীয় দালাল চক্রের কথা মত ১০ হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে ছাড়িয়ে আনলেও তবু শান্তি ছিল না। দালাল চক্র আমাকে বিচ্ছু নাম দিয়ে হত্যা করার চেষ্টা চালায়। তখন এলাকার  কয়েক জন রাজাকার আমাদের জীবন রক্ষায় এবং পাঞ্জাবী ও দালাল চক্রের হাত থেকে লুকিয়ে রাখতে  যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। এ সময় অন্যান্য দিনের মত ঈদের দিন বাড়ীতে কিছু সময় কাটিয়ে সন্ধ্যার পূর্বেই বাড়ী থেকে পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে হঠাৎ আমার বাবার এক বিশ্বস্ত বন্ধুর ভাই জফি মিয়া, বাড়ীর উত্তর পাশে পেলে তিনি আমাদেরকে পালিয়ে না যাওয়ার জন্য উপদেশ দিলেন। এবং বললেন আজ যে ভাবেই হউক মুক্তিযোদ্ধারা জকিগঞ্জে অপারেশন চালাবে।
এই অপারেশন সফল হবে। সত্যি কিছুক্ষণ পর আমাদের বাড়ীর আশ-পাশে পরিচিত অপরিচিত ভিক্ষুক বেশি মুক্তি যোদ্ধাদের আনাগুনা দেখে বুঝতে দেরি হল না। যে মুক্তিযোদ্ধারা  গ্রাম গঞ্জে প্রবেশ করে ফেলছে, তাই আমরা বাড়িতে ফিরে আসার পথে আমার পাশের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ (হামিন্দ আলী), সহ কয়েক জন পেয়ে গেলাম। মনে অনেক সাহস হল। সন্ধ্যার সাথে সাথে বাড়ীতেই প্রবেশ করতেই দেখা হল স্থানীয় লোহার মহল, খাপনা, লামার গ্রামের, কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের নারিকেল গাছের নিচে বসে আমাদের অপেক্ষা করছেন।
রাত্রি ঘনার সাথে সাথে জকিগঞ্জের তিন দিক ভারত থেকে গুলি ও মর্টারের শব্দ ভেসে আসতে শুরু করল। নদীর তীরবর্তী বাড়ীগুলো থেকে লোকজন স্থাবর অস্থাবর জিনিসপত্র ফেলে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজতে শুরু করল। নদীর তীরে অবস্থিত ব্যাংকারগুলো ছেড়ে রাজাকার ও পাঞ্জাবীরা জকিগঞ্জ মুখি হয়ে স্থান ত্যাগ করতে শুরু করল।  এ সময় জকিগঞ্জে ভিতর ও বাহির থেকে মরণ পণ যুদ্ধে ভোর ৫ টায় জকিগঞ্জ থানা সদর শত্র“ মুক্ত হয়। বিকাল ৫টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত এ ১২ ঘণ্টা হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের ডামাডোলে এবং জকিগঞ্জ এলাকা ভূমিকম্পের মত কম্পিত হয়ে উঠে ছিল। এ অবস্থায় জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধারা জকিগঞ্জ শত্র“ মুক্ত করে। এ সময় ভারতীয় মিত্রবাহিনী মেজর চমন লাল সহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। জকিগঞ্জ শত্র“ মুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশ প্রেমিক জনতা ঘর ছেড়ে নদী তীরবর্তী অসংখ্য ব্যাংকারে হানা দেয়। এবং পাঞ্জাবী রাজাকারদের আটক করে। স্বাধীনতা প্রেমিক জনতার ভিড় জমে উঠে থানা সদরে এদিন আটগ্রামে হানাদার বাহিনীর সাথে মুখোমুখি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে অনেক হানাদার ও মিত্র বাহিনী মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ হারান। ২২ নভেম্বর হানাদার বাহিনী কানাইঘাট এর দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। জকিগঞ্জ হানাদার মুক্ত হওয়ার পর ২২ নভেম্বর সকালে জকিগঞ্জ থানা সদরে প্রথম প্রবেশ করেন, তৎকালিন এম,পি, এম,এর লতিফ, ইছমত আহমদ চৌধুরী, আব্দুল মঈদ চৌধুরী, অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এদিন জকিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দাউদ হায়দারকে জকিগঞ্জের বেসামরিক প্রশাসক নিয়োগ করেন এবং শত্র“ মুক্ত এলাকায় শান্তি শৃংখলা বজায় রাখতে বীর মুক্তিযোদ্ধা স্পেশাল কমান্ডার এনাম চৌধুরী কে প্রধান করে মুক্তিযোদ্ধা স্পেশাল কমান্ডার মাসুক উদ্দিন আহমেদকে উপপাদান, ও খলিল উদ্দিনকে সহকারী কামান্ডার নিয়োগ করে প্রশাসনিক কর্মকান্ড শুরু করা হয়। এদিনে জকিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ঘোষণা করা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধে জকিগঞ্জই প্রথম মুক্ত অঞ্চল। এদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও প্রশাসক নিয়োগ এভাবে সম্পূর্ণ হয়েছিল। এদিনই জকিগঞ্জ হানাদার বাহিনীর সাথে লড়াইয়ের শেষ ঘণ্টা বাজল।
লেখক পরিচিতি : মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক মুক্তিদিবস উদযাপন পরিষদ সিলেটের আহবায়ক। বিশিষ্ট সাংবাদিক।