কাজিরবাজার ডেস্ক :
ফরিদপুরের নগরকান্দা বিএনপির সহ-সভাপতি ও একই পৌরসভার মেয়র জাহিদ হোসেন খোকন উরফে খোকন রাজাকারকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত মানবতাবিরোধী ১১টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ৬টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ও ৪টি অভিযোগে সর্বমোট ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল জনাকীর্ণ আদালতে খোকনের বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষণা করেন। অভিযুক্ত খোকন মামলার শুরু থেকেই পলাতক। ফলে আইনানুযায়ী তার অনুপস্থিতিতেই এ রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে বিচারক উল্লেখ করেছেন, পলাতক খোকন যেদিন গ্রেফতার হবেন বা আত্মসমর্পণ করবেন সেদিন থেকেই রায় কার্যকর হবে। সাজাপ্রাপ্ত খোকন মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ও দণ্ডপ্রাপ্ত চতুর্থ আসামী যার অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করলেন। এর আগে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অভিযোগে আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে তাদের অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ নিয়ে দু’টি ট্রাইব্যুনালে ১২টি রায় ঘোষিত হলো। এর মধ্যে আবদুল কাদের মোল্লা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও কামারুজ্জামানের আপিল আবেদন আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। আর ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিল আবেদন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। গতকাল খোকনের বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। এই মামলা পরিচালনাকারী প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে পলাতক জাহিদ হোসেন খোকনের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত না হলেও তাকে দ্রুত ফেরত এনে সাজা কার্যকরের চেষ্টা করা হবে। পক্ষান্তরে জাহিদ হোসেন খোকন ন্যায়বিচার পাননি বলে মন্তব্য করেছেন তার পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান। তিনি বলেছেন, খোকন একাত্তরে আনসার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিলেন না। তিনি বলেন, মামলার শুরু থেকে তার পরিবারের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাইনি। তবে যদি তিনি (খোকন) আপিল করতে চান তাহলে তার সঙ্গে যোগাযোগ হলে আপিল করা হবে।
সকাল ১১টায় ট্রাইব্যুনাল ১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক এজলাসে তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। এর আগেই গণমাধ্যম কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা রায় শোনার জন্য এজলাসে অপেক্ষা করতে থাকেন। ১০৯ পৃষ্ঠা রায়ের প্রথম অংশ পড়ে শোনান বিচারপতি আনোয়ারুল হক। তিনি আসামী জাহিদ হোসেনের পরিচিতি, তার রাজনৈতিক পরিচয়, অভিযোগ অনুসারে একাত্তরে তার ভূমিকা ইত্যাদি পড়ে শোনান। এ সময় তিনি খোকনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ১১টি অভিযোগও পর্যায়ক্রমে পড়ে শোনান। আধঘণ্টা পর রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি একাত্তরে খোকনের ভূমিকা ও অভিযোগের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয় পড়ে শোনান। দুপুর পৌনে বারোটায় চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। তিনি উল্লেখ করেন, প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ১১টি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগ ছাড়া বাকি সব অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও তথ্যপ্রমাণের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই আসামি জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারকে ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া, অন্য চারটি অভিযোগের মধ্যে ২ নম্বর অভিযোগে ৫ বছর, ৩ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর, ৪ নম্বর অভিযোগে ২০ বছর ও ৫ নম্বর অভিযোগে তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড : ৫ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩০শে মে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আইনাল রাজাকারসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে নগরকান্দা কোদালিয়া গ্রামের শহীদনগরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাটের পরে আগুন দেয়। এ সময় আশপাশে লুকিয়ে থাকা ৫০-৬০ জনকে ধরে এনে তাদের মধ্যে নারী ও শিশুসহ ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে খোকন ও তার সহযোগীরা। দেড় বছর বয়সী এক শিশুসহ অন্তত ছয়জন সে সময় গুরুতর আহত হন। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যেতে অস্বীকৃতি জানানোয় আলাউদ্দিন নামে এক কিশোরের হাত ভেঙে দেন খোকন। এছাড়া, কোদালিয়া কওমি মাদরাসার কাছে পাকিস্তানি সেনারা আফজাল হোসেন এবং কাছেই এক পাটক্ষেতে শুকুর শেখ নামে একজনকে খোকন নিজে গুলি করে হত্যা করে।
৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩০শে মে দুপুর দেড়টার দিকে খোকনের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাসহ রাজাকাররা ঈশ্বরদী গ্রামে যায় এবং বহু বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন দেয়। এ সময় গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকা ভীত ও নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের গুলি করে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। এতে সালাম মাতবর, শ্রীমতি খাতুন, লাল মিয়া মাতব্বর ও মাজেদ মাতব্বর নিহত হন।
৭ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩১ মে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খোকনের নেতৃত্বে রাজাকার সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা কোদালিয়ার শহীদনগর গ্রামের দীঘলিয়া-ঘোড়ানাড়া বিলে যায় ২৯শে মে ওই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের লাশ খুঁজতে। এ সময় পিজিরউদ্দিন, তার ভাই আফাজ ও তাদের প্রতিবেশী শেখ সাদেকের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। তারা তিনজনই বাড়ির ভেতরে পুড়ে মারা যান। একই দিন সকাল ১০টার দিকে বনগ্রামে আব্দুল হাই মোল্লা, ইকরাম মোল্লাসহ পাঁচজনের বাড়ি লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। মেহেরদিয়া গ্রামের আসিরুদ্দিন মাতব্বরকে মেহেরদিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ থেকে বের করে খোকন তাকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে। পরে সফিজুদ্দিন মাতব্বরকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। গ্রামের বাড়িঘরে লুট চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।
৮ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩১শে মে খোকনের নেতৃত্বে তার অধীন সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন, আওয়ামী লীগের কর্মী ও হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করতে নগরকান্দার গোয়ালদি গ্রামে যায়। এ সময় প্রাণভয়ে পালাতে থাকা মানুষের দিকে তারা গুলি চালালে রাজেন্দ্রনাথ রায় নামে এক বৃদ্ধ নিহত হন। পরিবারের সঙ্গে পালাতে থাকা কিশোর হান্নান মুন্সীর দুই বছরের বোন বুলু খাতুনকে তার মায়ের কোলে গুলি করে হত্যা করেন খোকন ও তার সহযোগীরা। এসময় অনেক বাড়িঘরে লুটপাটও চালানো হয়।
৯ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩১শে মে খোকনের নেতৃত্বে রাজাকার সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা পুরাপাড়া গ্রামে ঢুকে ছটু খাতুন, সফিজুদ্দিন শেখ, মানিক সরদার, রতন শেখ, জয়নুদ্দিন শেখ ও আবদুল বারেক মোল্লাকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
১০ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে ১লা জুন ভোরে আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আয়নাল রাজাকারসহ অন্যরা এবং পাকিস্তানি সেনারা বাগত ও চুরিয়াচর গ্রামে গিয়ে বাড়ি বাড়ি লুটপাট চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগের সমর্থক মিনি বেগমের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা মালেক মাতব্বর, ভাই মোশাররফ মাতব্বর, দাদী, নানী ও আমজাদ মুন্সীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া রতন মাতব্বর, আইয়ুব আলী ও মঞ্জু রানীসহ ১০/১৫ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়।
যে সব অভিযোগে ৪০ বছরের কারাদণ্ড : ২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৮ এপ্রিল থেকে ৬ই মে’র মধ্যে কোন একদিন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে আসামি খোকন ও তার নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী জংগুরদি-বাগুটিয়া গ্রামের কানাই লাল মণ্ডলসহ আরও একজনের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা ওই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং গ্রামের অন্য হিন্দুরা মুসলমান না হলে বাড়িঘর ধ্বংস করে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়। এরপর কানাই লালের পরিবারের কাছ থেকে জোর করে ৫০০০ টাকা এবং জীবন দাসের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেয়া হয়। এই অভিযোগে খোকনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
৩ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৬ থেকে ২৮শে মে’র মধ্যে কোন একদিন আসামি খোকন ও তার ভাইয়ের নেতৃত্বে সশস্ত্র রাজাকাররা একজন মৌলভীসহ জংগুরদি-বাগুটিয়া গ্রামের জীবন দাসের বাড়ি যায়। ওই বাড়ির আঙিনায় জীবন দাসসহ তার চার ভাইকে জোর করে মুসলিম করে তাদের মুসলিম নাম দেয়া হয়। পরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে বাড়ির নারী সদস্যদেরও কলেমা পড়িয়ে মুসলিম করা হয়। এ ঘটনায় ভীত হয়ে নিজেদের কিশোরী মেয়েকে বাঁচাতে ১৮ থেকে ৩০শে জুলাইয়ের মধ্যে কোন একদিন তারা সপরিবারে ভারত চলে যায়। এই অভিযোগে আসামী খোকনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
৪ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ই মে সকাল ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে আসামী জাহিদ হোসেন খোকন, তার ভাই জাফর ও রাজাকার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা চাঁদের হাট গ্রামের বণিকপাড়ায় গিয়ে ১৬/১৭ জন হিন্দুকে হত্যার হুমকি দেয় এবং তাদের কাছ থেকে জোর করে সোনার গয়না ও নগদ অর্থ লুট করে। এরপর তাদের বাড়ি ও মন্দিরে আগুন দেয়া হয়। ওই গ্রামে আশ্রয় নেয়া টগর দাস দত্তের স্ত্রী রাধা রানী দাসকে ধর্ষণ করেন খোকন। অন্য রাজাকার সদস্যরা এ সময় খুকু রানী দত্ত নামের আরেক কিশোরীকে ধর্ষণ করে। পরে সম্মান বাঁচাতে ধর্ষিতাদের পরিবার ভারতে চলে যায় এবং সেখানেই থেকে যায়। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আসামি খোকনকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
১১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১লা জুলাই থেকে ১৭ই জুলাইয়ের মধ্যে কোন একদিন আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আয়নাল রাজাকারসহ অন্যরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে জংগুরদিয়া-বাগুটিয়া গ্রামে কানাইলাল মণ্ডলের বাড়িতে যায়। কানাইলাল তাদের আসতে দেখে পাশের পাটক্ষেতে আত্মগোপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু খোকন রাজাকার সেখান থেকে তাকে ধরে এনে বাড়ির দক্ষিণ পাশের রাস্তায় নিয়ে গুলি করে। কানাইলালের ডান হাতে গুলি লাগলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান এবং ১৮ থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে কোন একদিন ভারতে পালিয়ে যান। এই অভিযোগে খোকনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম : জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল শুরু হয়ে গত বছরের ২৮ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শেষ হয়। তদন্তকালে এ মামলায় ৭৮ জনের বেশি লোকের সাক্ষ্য নেয়া হয়। একই বছরের ২৩শে জুন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার বরাবর খোকনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলেন। ১৮ জুলাই প্রসিকিউশনের দেয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নিয়ে বিএনপির এ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ৩০ জুলাই পলাতক খোকনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে মামলা মোকাবিলার জন্য দু’টি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার পরও পলাতক খোকন নির্ধারিত সময়ে হাজির না হওয়ায় ১৪ আগষ্ট তার অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরুর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে খোকনের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পান আব্দুস শুকুর খান। ২০১৩ সালের ৫ ও ১৭ সেপ্টেম্বর খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল। অন্যদিকে ১৭ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন খোকনের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান। একই বছরের ৯ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধে খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ১৯ নভেম্বর খোকনের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। একই বছরের ২১ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ২ এপ্রিল পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন দাশসহ ট্রাইব্যুনাল-১ এ খোকনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৪ জন সাক্ষী। তবে তার পক্ষে কোন সাফাই সাক্ষী ছিল না। অভিযোগ অনুসারে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে জাহিদ হোসেন খোকন জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত এলাকায় অবস্থান করে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায় তিনি বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন। দণ্ডপ্রাপ্ত খোকন ফরিদপুরে আরেক মানবতাবিরোধী অপরাধী ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত (ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়) আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। স্বাধীনতার পরে তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সর্বশেষ নগরকান্দা বিএনপির সহ-সভাপতির পদে থেকে নগরকান্দা পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। তবে মেয়র হিসেবে শপথ নেয়ার পর থেকে তিনি পলাতক।
কাজিরবাজার ডেস্ক
ফরিদপুরের নগরকান্দা বিএনপির সহ-সভাপতি ও একই পৌরসভার মেয়র জাহিদ হোসেন খোকন উরফে খোকন রাজাকারকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত মানবতাবিরোধী ১১টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ৬টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ও ৪টি অভিযোগে সর্বমোট ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল জনাকীর্ণ আদালতে খোকনের বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষণা করেন। অভিযুক্ত খোকন মামলার শুরু থেকেই পলাতক। ফলে আইনানুযায়ী তার অনুপস্থিতিতেই এ রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে বিচারক উল্লেখ করেছেন, পলাতক খোকন যেদিন গ্রেফতার হবেন বা আত্মসমর্পণ করবেন সেদিন থেকেই রায় কার্যকর হবে। সাজাপ্রাপ্ত খোকন মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ও দণ্ডপ্রাপ্ত চতুর্থ আসামী যার অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করলেন। এর আগে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অভিযোগে আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে তাদের অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ নিয়ে দু’টি ট্রাইব্যুনালে ১২টি রায় ঘোষিত হলো। এর মধ্যে আবদুল কাদের মোল্লা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও কামারুজ্জামানের আপিল আবেদন আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। আর ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিল আবেদন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। গতকাল খোকনের বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। এই মামলা পরিচালনাকারী প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে পলাতক জাহিদ হোসেন খোকনের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত না হলেও তাকে দ্রুত ফেরত এনে সাজা কার্যকরের চেষ্টা করা হবে। পক্ষান্তরে জাহিদ হোসেন খোকন ন্যায়বিচার পাননি বলে মন্তব্য করেছেন তার পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান। তিনি বলেছেন, খোকন একাত্তরে আনসার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিলেন না। তিনি বলেন, মামলার শুরু থেকে তার পরিবারের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাইনি। তবে যদি তিনি (খোকন) আপিল করতে চান তাহলে তার সঙ্গে যোগাযোগ হলে আপিল করা হবে।
সকাল ১১টায় ট্রাইব্যুনাল ১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক এজলাসে তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। এর আগেই গণমাধ্যম কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা রায় শোনার জন্য এজলাসে অপেক্ষা করতে থাকেন। ১০৯ পৃষ্ঠা রায়ের প্রথম অংশ পড়ে শোনান বিচারপতি আনোয়ারুল হক। তিনি আসামী জাহিদ হোসেনের পরিচিতি, তার রাজনৈতিক পরিচয়, অভিযোগ অনুসারে একাত্তরে তার ভূমিকা ইত্যাদি পড়ে শোনান। এ সময় তিনি খোকনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ১১টি অভিযোগও পর্যায়ক্রমে পড়ে শোনান। আধঘণ্টা পর রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি একাত্তরে খোকনের ভূমিকা ও অভিযোগের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয় পড়ে শোনান। দুপুর পৌনে বারোটায় চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। তিনি উল্লেখ করেন, প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ১১টি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগ ছাড়া বাকি সব অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও তথ্যপ্রমাণের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই আসামি জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারকে ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া, অন্য চারটি অভিযোগের মধ্যে ২ নম্বর অভিযোগে ৫ বছর, ৩ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর, ৪ নম্বর অভিযোগে ২০ বছর ও ৫ নম্বর অভিযোগে তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড : ৫ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩০শে মে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আইনাল রাজাকারসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে নগরকান্দা কোদালিয়া গ্রামের শহীদনগরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাটের পরে আগুন দেয়। এ সময় আশপাশে লুকিয়ে থাকা ৫০-৬০ জনকে ধরে এনে তাদের মধ্যে নারী ও শিশুসহ ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে খোকন ও তার সহযোগীরা। দেড় বছর বয়সী এক শিশুসহ অন্তত ছয়জন সে সময় গুরুতর আহত হন। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যেতে অস্বীকৃতি জানানোয় আলাউদ্দিন নামে এক কিশোরের হাত ভেঙে দেন খোকন। এছাড়া, কোদালিয়া কওমি মাদরাসার কাছে পাকিস্তানি সেনারা আফজাল হোসেন এবং কাছেই এক পাটক্ষেতে শুকুর শেখ নামে একজনকে খোকন নিজে গুলি করে হত্যা করে।
৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩০শে মে দুপুর দেড়টার দিকে খোকনের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাসহ রাজাকাররা ঈশ্বরদী গ্রামে যায় এবং বহু বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন দেয়। এ সময় গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকা ভীত ও নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের গুলি করে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। এতে সালাম মাতবর, শ্রীমতি খাতুন, লাল মিয়া মাতব্বর ও মাজেদ মাতব্বর নিহত হন।
৭ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩১ মে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খোকনের নেতৃত্বে রাজাকার সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা কোদালিয়ার শহীদনগর গ্রামের দীঘলিয়া-ঘোড়ানাড়া বিলে যায় ২৯শে মে ওই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের লাশ খুঁজতে। এ সময় পিজিরউদ্দিন, তার ভাই আফাজ ও তাদের প্রতিবেশী শেখ সাদেকের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। তারা তিনজনই বাড়ির ভেতরে পুড়ে মারা যান। একই দিন সকাল ১০টার দিকে বনগ্রামে আব্দুল হাই মোল্লা, ইকরাম মোল্লাসহ পাঁচজনের বাড়ি লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। মেহেরদিয়া গ্রামের আসিরুদ্দিন মাতব্বরকে মেহেরদিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ থেকে বের করে খোকন তাকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে। পরে সফিজুদ্দিন মাতব্বরকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। গ্রামের বাড়িঘরে লুট চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।
৮ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩১শে মে খোকনের নেতৃত্বে তার অধীন সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন, আওয়ামী লীগের কর্মী ও হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করতে নগরকান্দার গোয়ালদি গ্রামে যায়। এ সময় প্রাণভয়ে পালাতে থাকা মানুষের দিকে তারা গুলি চালালে রাজেন্দ্রনাথ রায় নামে এক বৃদ্ধ নিহত হন। পরিবারের সঙ্গে পালাতে থাকা কিশোর হান্নান মুন্সীর দুই বছরের বোন বুলু খাতুনকে তার মায়ের কোলে গুলি করে হত্যা করেন খোকন ও তার সহযোগীরা। এসময় অনেক বাড়িঘরে লুটপাটও চালানো হয়।
৯ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩১শে মে খোকনের নেতৃত্বে রাজাকার সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা পুরাপাড়া গ্রামে ঢুকে ছটু খাতুন, সফিজুদ্দিন শেখ, মানিক সরদার, রতন শেখ, জয়নুদ্দিন শেখ ও আবদুল বারেক মোল্লাকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
১০ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে ১লা জুন ভোরে আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আয়নাল রাজাকারসহ অন্যরা এবং পাকিস্তানি সেনারা বাগত ও চুরিয়াচর গ্রামে গিয়ে বাড়ি বাড়ি লুটপাট চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগের সমর্থক মিনি বেগমের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা মালেক মাতব্বর, ভাই মোশাররফ মাতব্বর, দাদী, নানী ও আমজাদ মুন্সীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া রতন মাতব্বর, আইয়ুব আলী ও মঞ্জু রানীসহ ১০/১৫ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়।
যে সব অভিযোগে ৪০ বছরের কারাদণ্ড : ২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৮ এপ্রিল থেকে ৬ই মে’র মধ্যে কোন একদিন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে আসামি খোকন ও তার নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী জংগুরদি-বাগুটিয়া গ্রামের কানাই লাল মণ্ডলসহ আরও একজনের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা ওই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং গ্রামের অন্য হিন্দুরা মুসলমান না হলে বাড়িঘর ধ্বংস করে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়। এরপর কানাই লালের পরিবারের কাছ থেকে জোর করে ৫০০০ টাকা এবং জীবন দাসের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেয়া হয়। এই অভিযোগে খোকনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
৩ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৬ থেকে ২৮শে মে’র মধ্যে কোন একদিন আসামি খোকন ও তার ভাইয়ের নেতৃত্বে সশস্ত্র রাজাকাররা একজন মৌলভীসহ জংগুরদি-বাগুটিয়া গ্রামের জীবন দাসের বাড়ি যায়। ওই বাড়ির আঙিনায় জীবন দাসসহ তার চার ভাইকে জোর করে মুসলিম করে তাদের মুসলিম নাম দেয়া হয়। পরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে বাড়ির নারী সদস্যদেরও কলেমা পড়িয়ে মুসলিম করা হয়। এ ঘটনায় ভীত হয়ে নিজেদের কিশোরী মেয়েকে বাঁচাতে ১৮ থেকে ৩০শে জুলাইয়ের মধ্যে কোন একদিন তারা সপরিবারে ভারত চলে যায়। এই অভিযোগে আসামী খোকনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
৪ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ই মে সকাল ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে আসামী জাহিদ হোসেন খোকন, তার ভাই জাফর ও রাজাকার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা চাঁদের হাট গ্রামের বণিকপাড়ায় গিয়ে ১৬/১৭ জন হিন্দুকে হত্যার হুমকি দেয় এবং তাদের কাছ থেকে জোর করে সোনার গয়না ও নগদ অর্থ লুট করে। এরপর তাদের বাড়ি ও মন্দিরে আগুন দেয়া হয়। ওই গ্রামে আশ্রয় নেয়া টগর দাস দত্তের স্ত্রী রাধা রানী দাসকে ধর্ষণ করেন খোকন। অন্য রাজাকার সদস্যরা এ সময় খুকু রানী দত্ত নামের আরেক কিশোরীকে ধর্ষণ করে। পরে সম্মান বাঁচাতে ধর্ষিতাদের পরিবার ভারতে চলে যায় এবং সেখানেই থেকে যায়। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আসামি খোকনকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
১১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১লা জুলাই থেকে ১৭ই জুলাইয়ের মধ্যে কোন একদিন আসামি খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আয়নাল রাজাকারসহ অন্যরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে জংগুরদিয়া-বাগুটিয়া গ্রামে কানাইলাল মণ্ডলের বাড়িতে যায়। কানাইলাল তাদের আসতে দেখে পাশের পাটক্ষেতে আত্মগোপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু খোকন রাজাকার সেখান থেকে তাকে ধরে এনে বাড়ির দক্ষিণ পাশের রাস্তায় নিয়ে গুলি করে। কানাইলালের ডান হাতে গুলি লাগলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান এবং ১৮ থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে কোন একদিন ভারতে পালিয়ে যান। এই অভিযোগে খোকনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম : জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল শুরু হয়ে গত বছরের ২৮ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শেষ হয়। তদন্তকালে এ মামলায় ৭৮ জনের বেশি লোকের সাক্ষ্য নেয়া হয়। একই বছরের ২৩শে জুন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার বরাবর খোকনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলেন। ১৮ জুলাই প্রসিকিউশনের দেয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নিয়ে বিএনপির এ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ৩০ জুলাই পলাতক খোকনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে মামলা মোকাবিলার জন্য দু’টি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার পরও পলাতক খোকন নির্ধারিত সময়ে হাজির না হওয়ায় ১৪ আগষ্ট তার অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরুর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে খোকনের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পান আব্দুস শুকুর খান। ২০১৩ সালের ৫ ও ১৭ সেপ্টেম্বর খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল। অন্যদিকে ১৭ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন খোকনের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান। একই বছরের ৯ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধে খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ১৯ নভেম্বর খোকনের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। একই বছরের ২১ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ২ এপ্রিল পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন দাশসহ ট্রাইব্যুনাল-১ এ খোকনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৪ জন সাক্ষী। তবে তার পক্ষে কোন সাফাই সাক্ষী ছিল না। অভিযোগ অনুসারে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে জাহিদ হোসেন খোকন জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত এলাকায় অবস্থান করে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায় তিনি বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন। দণ্ডপ্রাপ্ত খোকন ফরিদপুরে আরেক মানবতাবিরোধী অপরাধী ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত (ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়) আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। স্বাধীনতার পরে তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সর্বশেষ নগরকান্দা বিএনপির সহ-সভাপতির পদে থেকে নগরকান্দা পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। তবে মেয়র হিসেবে শপথ নেয়ার পর থেকে তিনি পলাতক।