খেজুরের বাজারে উপচেপড়া ভিড় আমদানি বেশি, দাম কিছুটা কম

10

সিন্টু রঞ্জন চন্দ

আজ থেকে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। রমজানে রোজাদারদের খেজুর দিয়ে ইফতার করা সুন্নত। রমজান উপলক্ষে সিলেটের খেজুরের পাইকারী ও খুচরা বাজারগুলোতে লক্ষ্য করা গেছে উপচেপড়া ভিড়। গত বছরের তুলনায় এ বছর আমদানি বেশী হওয়াতে খেজুরের দাম কিছুটা কম। আমদানিতে শুল্ক-কর কমানোয় খেজুর ভেদে কেজিতে দাম কমেছে ৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। তবে পাইকারী দোকানে দাম কম থাকলেও খুচরা দোকানে খেজুরের দাম প্রতি কেজিতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ও কোন কোন খুচরা ফল দোকানে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে।
গতকাল শনিবার (১ মার্চ) সিলেটের দক্ষিণ সুরমা কদমতলীস্থ পাইকারী ফল মার্কেট ও নগরীর বন্দরবাজার-কদমতলী খুচরা ফল বিক্রেতাদের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মতে, ১ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত খেজুর আমদানি হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৯ হাজার ৬৮৮ টন। অবশ্য ট্যারিফ কমিশনের হিসেবে, রোজায় খেজুরের চাহিদা ৬০ হাজার টন। বন্দর দিয়ে এখন প্রতিদিন খেজুর খালাস হচ্ছে। তাতে রোজা শুরুর আগে খেজুরের আমদানি চাহিদার চেয়ে বেশি হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাজারে ১৫ থেকে ২০ রকমের খেজুর পাওয়া যাচ্ছে। আবার একই খেজুরের ভিন্ন ভিন্ন দাম রয়েছে। গত বছরের দামের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, সাধারণ মান থেকে উন্নত মানের খেজুরের দাম কেজিতে কমেছে সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা।
গতকাল শনিবার সিলেটের দক্ষিণ সুরমা কদমতলীস্থ ইয়াছিন প্লাজা ফল মার্কেটের খেজুরের পাইকার মেসার্স কৈলাস ফ্রুটস এজেন্সিতে গিয়ে দেখা যায়, ইরাকের ‘জাহিদি’ খেজুর গত বছর রোজায় বিক্রি হয়েছিল ২৩০ টাকা কেজি। এবার একই খেজুর বিক্রি হচ্ছে সিলেটে ১৮০ টাকা কেজি। মাঝারি আকারের মিশরের ‘মেডজুল’ গত বছর বিক্রি হয়েছিল ১৫০০ টাকা কেজি। এবার বিক্রি হচ্ছে ১৪৬০, ১৩৬০ ও ১১৫০ টাকা কেজি। এ ছাড়া প্রতি কেজি দুবাইর দাব্বাস খেজুর ৪৫০ থেকে ৩৮০ টাকা, খেজুরের মধ্যে মান অনুযায়ী সৌদি আরবের আজোয়া ১১০০ থেকে ৯০০ টাকা, সৌদি আরবের কলমি ৮৬০ থেকে ৬৬০-টাকা, দুবাইর নাকাল ৩৫০ থেকে ৩০০ টাকা, সায়ের ৩৫০ টাকা থেকে ২৫০-টাকা, সাফারি ৬০০ টাকা, মাশরুখ ৪০০ টাকা, সৌদি আরবের ৮০০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা, দুবাইর হুমায়রা ৫০০ টাকা থেকে ৪৪০ টাকা, তিনোশিয়ার ছড়া খেজুর ৬০০ থেকে ৫৫০ টাকা, দুবাইর ভিজা জাহিদি (৩০/৩৫ কেজির বস্তা) প্রতি কেজি ২৫০ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা, মিসরের আম্বর ১৩০০ থেকে ৯০০ টাকা, ইরানী মরিয়ম ১২০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা, দুবাইর লুলু খেজুর ১০ কেজির কার্টুন ৪০০০ থেকে ৩৯০০ টাকা, দুবাইর কাউন্টডাবাস এক কেজির প্যাকেট ৫০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা ও আলজেরিয়া খেজুর ৫০০ থেকে ৪০০ টাকায় প্রতি কেজি পাইকারী বিক্রি হচ্ছে।
কদমতলী ফল মার্কেটের মেসার্স কৈলাস ফ্রুটস এজেন্সির সত্ত¡াধিকারী দৈনিক কাজির বাজার পত্রিকাকে বলেন- ঢকা ও চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন ধরনের খেজুর আমরা আমদানী করে থাকি। রমজানে এ বছর বাজারে খেজুরের ঘাটতি নেই। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে ঘাটতি ছিল। তিনি বলেন- আগে শুল্ক-কর বেশী থাকায় খেজুরের দাম ছিল বেশী। এ বছর খেজুরের শুল্ক-কর কমে আসায় দামও কেজি প্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা কমেছে। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে ৫০ থেকে ৬০ গাড়ী খেজুর আমদানী করেছি। কিন্তু রাস্তায় এখন পর্যন্ত কোন চাঁদাবাজি হয়নি। তিনি বর্তমান সরকারে প্রতি অনুরোধ করে আরো বলেন- যদি খেজুরের দামের উপর শুল্ক-কর আরো কমানো যায় তাহলে সবধরনের ফলের তুলনায় খেজুর মানুষের উপকারে আসে। তিনি বলেন- মধ্য সারির জাহিদি খেজুরের বস্তা বা কার্টুন বেশী বিক্রি হয়। কারণ এ খেজুর অন্যান্য খেজুর থেকে দাম কম ও স্বাস্থ্যসম্মত।
জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরের খুচরা ফল ব্যবসায়ী ফখরুল ইসলাম আজ প্রথম রমজান উপলক্ষে জাহিদি (বস্তা), নাগাল সায়েরা খেজুর কদমতলী মেসার্স কৈলাস ফ্রুটস এজেন্সির খেজুর কিনতে এসেছেন খুচরা বিক্রির জন্য। তিনি এ প্রতিবেদককে জানালেন- গত বছরের তুলনায় কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা দামে পাইকারী বাজারে খেজুর কিনতে পারছি।
কদমতলী খুচরা ফল বিক্রেতা নুর উদ্দিন জানান, ইরানি খেজুর প্রতি কেজি ২০০ টাকা, বরই ডাবাস ৪৫০ টাকা, শুকারী (নরম) ৭৫০ টাকা, ইরানী কলমি মরিয়ম ৮০০ টাকা, দুবাইর সুকারী ৭৫০ টাকা, পাকিস্তানি মেডজুল ১৫৫০ টাকা, আলজেরিয়া ৫৫০ টাকা, সৌদি আরবের মরিয়ম ৫০০ টাকা, সৌদি আরবের ডালিয়া ছড়া ৬০০ টাকা, দুবাইর সারি ৩০০ টাকা, সৌদি আরবের মরিয়ম ১২০০ টাকা, সৌদি আরবের আজোয়া ১০৫০ টাকা দরে কেজি প্রতি বিক্রি করছি। তিনি বলেন- এসব খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ইরানি জাহিদি ও নাগাল খেজুর বিক্রি হয়। কারণ এ ধরনের খেজুরের দাম অন্যান্য খেজুরের দামের চেয়ে সস্তা ও মান ভালো তাই এ দু’ধরনের খেজুর সব শ্রেণীর মানুষ ক্রয় করে থাকেন।
কমদতলী খুচরা আরেক ফল ব্যবসায়ী শামিম আহমদ বলেন- ইরানী (পুরাতন খেজুর) সারি, ডাবাস, জাহিদি ও নাগাল খেজুর এর দাম মানুষের নাগালে ভেতরে তাই অন্যান্য খেজুরের দাম বাড়তি।
কদমতলী ফুটপাতের খুচরা ফল বিক্রেতা আব্দুল আহাদ বলেন- ইরানী (পুরাতন খেজুর) সারি, ডাবাস, জাহিদি ও নাগাল খেজুর ধনি-গরিব সকলে নিয়ে যায় তাই এ খেজুর বেশী বিক্রি হয় লাভও বেশী।
নগরীর বন্দরবাজারের খুচরা ফল ব্যবসায়ী মাদানিয়া ফ্রুট সেন্টার এর প্রোপ্রাইটর কবির আহমদ জানান, মিশরের মেডজুল প্রতি কেজি ১৩০০ টাকা, কলমী ৮৫০ টাকা, নাগাল ৩৬০ টাকা, সায়ের ৩০০ টাকা, দুবাই জাহিদি ২০০ টাকা, আলজেরিয়া ৪০০ টাকা, দুবাইর জাহিদি (বস্তা) ২০০ টাকা, তিনোশিয়া ৬০০ টাকা, দুবাইর দাব্বাস খেজুর ৪৬০ টাকা, সৌদি আরবের সুখকারী ৮০০ টাকা, দুবাইর লুলু খেজুর ৪৫০ টাকা, দুবাইর কাউন্টিডাবাস ৪৮০ টাকা, নাগাল ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা, মরিয়ম ১১০০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। তিনি বলেন- নাগাল ও ইরানি খেজুর বেশী তার দোকানে বিক্রি হয়। এসব খেজুর তিনি ঢাকা ফল আমদানীকারক থেকে সরাসরি সিলেটে নিয়ে এসে খুচরা বিক্রি করে। ফলে লাখ একটু বেশী পাওয়া যায়।
এ দোকানে খেজুর কিনতে আসেন হবিগঞ্জের মাদ্রাসা শিক্ষক বর্তমানে পাঠানটুলা এলাকার বাসিন্দা আলী আক্কাস। তিনি জানালেন- রমজানে আব্বার জন্য এক কেজি ইরানি খেজুর কিনেছেন ১৮০ টাকায়। দোকানে এত খেজুর থাকতে এ খেজুর ক্রয় করলেন কেন এমন প্রশ্ন করলে এ ক্রেতা বলেন- এ খেজুর নরম খেতেও স্বাদ দাম কম।
সিলেট জজ কোর্ট জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব আব্দুল জলিল এ প্রতিবেদককে বলেন- রমজানে রোজাদারের জন্য খেজুর দিয়ে ইফতারি করা সুন্নত। নবী করিম (সা:) ইফতারের সময় খেজুর দিয়ে ইফতার সূচনা করতেন এবং উম্মতদেরকেও এটার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। হাদিসে বর্ণিত আছে নবী করিম (সা:) বলেছেন- ‘তোমরা যখন ইফতার করবে তখন খেজুর দ্বারা ইফতার সূচনা করবে। কারণ এর মধ্যে বরকত রয়েছে। আর যদি খেজুর না পাওয়া যায়, তাহলে পানি দ্বারা ইফতার করবে’। আব্দুল জলিল জানান, ইফতারের প্রথমে খেজুর খেলে স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। খেজুরের মধ্যে বিভিন্ন শক্তির উপাদান রয়েছে বিধায় অন্যান্য মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য খেলে বিভিন্ন রোগ হওয়ার আশংকা থাকলেও খেজুর খেলে কোন ধরণের রোগ বা শরীরে ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে না। এ জন্য আমরা রমজান আসলে মুসলমানদের মধ্যে খেজুর খাওয়ার প্রচলন বেশী। এই প্রচলনটি ইসলামের সূচনা থেকে চলে আসছে।