শান্তি ফিরলেও আছে ভয়, আছে শঙ্কা

30

ইমরান আহমেদ জীবন
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে দেশজুড়ে সৃষ্ট সংঘাত-সংঘর্ষের ৭ দিন পার করেছেন সিলেটের সাধারণ মানুষজন। পরিস্থিতি নিয়ে এখনো জনমনে রয়েছে শঙ্কা। আন্দোলনের শুরুতে বিষয়টি স্বাভাবিক থাকলেও ধীরে ধীরে তা জটিলতা ধারণ করে। পুলিশের গুলিতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনেকে নিহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন সাংবাদিক, পুলিশ, ব্যবসায়ী, বাদাম বিক্রেতা, চা বিক্রেতা, রিকশা চালকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় ক্ষতি হয়েছে অসামান্য। যা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বেগ পেতে হবে সরকারকে।
চলতি মাসের শুরুতে কোটা নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। এরপর কর্মসূচি আসতে থাকে একের পর এক। বাংলা বøকেড, রাষ্ট্রপতি বরাবরে স্মারকলিপি, পদযাত্রা, মিছিল, সড়ক অবরোধ ইত্যাদি চলতে থাকে। একের পর এক কর্মসূচি গিয়ে দাঁড়ায় হামলা-ভাঙচুর-তাÐবে। ঢাকায় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলা, মারধর, পুলিশের গুলি, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপের জের ধরে কোটা আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে ধ্বংসজজ্ঞে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষের মনে সৃষ্টি হয় উদ্বেগ, আতঙ্ক। মোবাইল ইন্টারনেট, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ধাপে ধাপে। এতে মানুষজনের দুর্ভোগ বাড়তে থাকে আরো বেশি। ইন্টারনেট নির্ভর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইনে প্রিপেইড মিটারের গ্যাস-বিদ্যুৎ সেবা, অনলাইন ব্যবসা, ফ্রিল্যান্সসহ এ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রমে দেখা দেয় স্থবিরতা। বন্ধ থাকে দৈনিক ও অনলাইন গণমাধ্যম। এ অবস্থায় মানুষ হয়ে পড়ে দিশেহারা। ইলেকট্রিক সাপ্লাই রোডে অবস্থিত বিদ্যুৎ অফিস ও বিভিন্ন মোবাইল ফোন সেবা সংশ্লিষ্ট দোকানে বিদ্যুতের প্রিপ্রেইড মিটারের কার্ডের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ান মানুষ।
দেশজুড়ে তাÐবের হাওয়া লাগে সিলেটেও। বুধবার (১৭ জুলাই) বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) নগরী কিছুটা অস্বাভাবিক থাকলেও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) এলাকায় বৃহস্পতিবার পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারিদের হামলা-সংঘর্ষ ও দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গুলি, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। আন্দোলানকারী, পুলিশ সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক আহত হন। আটক হন ১৫ জন। এ দিন রাতে আবার পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। শাবির প্রধান ফটকে অগ্নিসংযোগ করা হয়। শুক্রবার নগরজুড়ে শুরু হয় ভাঙচুর, রাস্তা অবরোধ, রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। এ সময় অ্যাকশনে যায় পুলিশও। টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, গুলি ছুঁড়ে তা প্রতিহত করা হয়। শুক্রবার (১৯ জুলাই) জুমার নামাজের পর কোর্ট পয়েন্টে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারিদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ওই সময় পুলিশের গুলিতে ঝাজরা হয়ে যায় সাংবাদিক এটি এম তুরাব এর শরীর। এ সময় সহকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার অবস্থা গুরুতর দেখে ডাক্তাররা তাকে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার পরামর্শ দেন। পরে তাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণে (আইসিউ) রাখা হয়। ধীরে ধীরে তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শুক্রবার দিনের সংঘর্ষে আহত হন অর্ধশতাধিক। গ্রেফতার হন অনেকে। নগরীজুড়ে দেখা দেয় ভীতিকর অবস্থার। পুলিশ-বিজিবি টহল জোরদার করা হয়। এ দিন রাতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের জালালাবাদ থানায় হামলা চালানো হয়। দফায় দফায় হামলায় থানার ব্যাপক ক্ষতি হয়। অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয় পাঠানটুলা পুলিশ বক্সসহ নানা স্থানে।
এরপর থেকে ২০ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করা হলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। পরদিন থেকে ফের জনমনে উৎকণ্ঠা বিরাজ করে। ভয়ে-আতঙ্কে মানুষজন ঘর থেকে বের হননি। সেনাবাহিনীর টহলে নগরজুড়ে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হলেও জনমনে উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। কারফিউ জারি হলেও অনেকে রাস্তায় নেমে পড়েন পেটের দায়ে। অনেক স্থানে কারফিউ চলা অবস্থায় অটোরিকশা, হাতেগোনা কয়েকটি রিকশা, প্রাইভেট চালিত মোটরসাইকেল চলতে দেখা যায়।
থমথমে ৭ দিন অতিবাহিত করেছেন সিলেটের সাধারণ মানুষজন। বিশেষ করে সবার মুখে মুখে ইন্টারনেট সচলের আলোচনা শুনা যায়। একজন আরেকজনের কাছে ইন্টারনেট সচল-অচলের খরব নিতে থাকেন। অনেকে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অনেকে প্রবাসের থাকা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে পেরেশান হয়ে যান। বেশি সমস্যা দেখা দেয় প্রিপেইড, গ্যাস-বিদ্যুতের মিটার নিয়ে। বাজার-সদাই করতে বেগ পেতে হয় অনেকের। কারফিউ, হামলা-ভাঙচুরের অজুহাতে বাজারে পণ্যমূল্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। এ সময় কোনো ধরনের সরকারি পর্যবেক্ষণ না থাকায় ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি তেমন দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এতে খেটে খাওয়া মানুষজনের দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়। অনেক দিনমজুর কাজে যেতে না পেরে ঋণের পথ বেছে নেন। এছাড়াও বিকাশ-নগদে লেনদেনে ভোগান্তিতে পড়েন অনেকে। কেউ কাউকে কোনোভাবেই টাকা পাঠাতে বা পরিশোধ করতে পারেন নি টানা ৫-৬ দিন। এতে কেউ কাউকে সাহায্য বা কারো ঋণ পরিশোধের সামর্থ থাকলেও উপায় ছিল না। এছাড়াও অটোরিকশা ও প্রাইভেট গাড়িতে গ্যাস না পাওয়ায় অনেক স্থানে প্রয়োজনে যাতায়াতে ভোগান্তি পেতে হয়েছে সাধারণ মানুষ জনের।
এছাড়াও এ সময়ে বিদেশ ফেরত প্রবাসী ও ভারত থেকে ফিরে আসা ট্যুরিস্টরা পড়েছিলেন বিপাকে। বিশেষ করে ব্যাংক বন্ধ থাকায় অটোমেটেড টেলার মেশিন কার্ড (এটিএম কার্ড) থেকে টাকা তুলতে পারেন নি অনেকে। ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে ভারতে যাওয়া ট্যুারিস্ট দম্পতি রোমানা ইসলাম জুঁই জানান, ‘ভারতের গিয়ে বাংলাদেশের এটিএম কার্ড ব্যবহার করা যায়নি। দেশে এসেও সমস্যায় পড়তে হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের কোনো উপায়ও নেই।
মঙ্গলবার কারফিউ আংশিক শিথিল ঘোষণার পর থেকে প্রাণ ফেরে নগরীতে। অনেকে বের হন কারফিউ শেষ হওয়ার আগেই। গতকাল বুধবার দিনভর নগরজুড়ে ছিল জমজমাট অবস্থা। কর্মে ফিরেছেন সবাই। ব্যাংক পাড়ায় লেনদেন করতে ভীড় দেখা গেছে। তবে ইন্টারনেট সংযোগ অনেক জায়গায় বিচ্ছিন্ন থাকায় অনেক কাজকর্মে বিঘœ ঘটতে দেখা গেছে।
সর্বশেষ সিলেট নগরজুড়ে শান্তি বিরাজ করলেও সাধারণ মানুষের মনে এখনো ভয়-শঙ্কা রয়ে গেছে।