স্টাফ রিপোর্টার
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও সিলেটে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে আবারও বাড়ছে বিভিন্ন পয়েন্টে নদ-নদীর পানি। এরইমধ্যে নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করে অনেক এলাকা পুরোপুরি ডুবে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কুশিয়ারা নদীর পানি সামান্য কমলেও বিপৎসীমা ছাড়িয়েছে সুরমা। দুই দফা বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই ফের বন্যার কবলে পড়তে যাচ্ছেন সিলেট ও সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা।
ইতোমধ্যে সিলেট নগরীর শাহজালাল উপশহরের বেশ কিছু বাসা-বাড়িতে পানি উঠেছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে আরও কিছু এলাকায় পানি উঠতে পারে। এ নিয়ে শঙ্কায় আছে মানুষ।
সিলেটের তিন উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর আবারও অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ।
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলায় ১৩টি উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রে রবিবার পর্যন্ত ১০ হাজার ৯০৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন। জেলায় ৬৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে ২১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ উঠেছেন। তবে সিলেট সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন নেই।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, সোমবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। রবিবার সন্ধ্যায় বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার নিচে দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া রবিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শুধু কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপরে অবস্থান করলেও ১ জুলাই সোমবার সকালে সুরমার কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উজানে বৃষ্টির কারণে নদ-নদীর পানি দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে লোভা ও ডাউকি নদীর পানি ব্যাপক স্রোতে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন করে সিলেটে ও চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে সিলেটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। আবারও দুর্ভোগে পড়তে হবে বলে ধারণা করছেন তারা।
গোয়াইনঘাটের জাফলং ব্যবসায়ী জাকির আহমদ বলেন, জাফলংয়ের ডাউকি নদীর পানি অনেক কম ছিল। উপর থেকে প্রবল বেগে পানি আসছে দেশে। সোমবার সকালে অনেক পানি দেখা যাচ্ছে। আমরা আতংকে দিন-রাত কাটাচ্ছি।
এদিকে সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজীব হোসাইন জানান, সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল (সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা) ৩৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার। শুধু সোমবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৬৫ মিলিমিটার। এদিকে চেরাপুঞ্জিতেও রবিবার প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩১৩ মিলিমিটার।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জৈন্তাপুর ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় হাওর, লক্ষিপুর, বিরাইমারা, গরেরপাড়, কদমখাল, খাড়ুবিল, ডুলটিরপাড়, চাতলারপাড়, বাওন হাওর শেওলারটুক ও নিজপাট ইউনিয়নে লামাপাড়া, বন্দরহাটী, মেঘলি, ফুলবাড়ী, ঘিলাতৈল, বাইরাখেল, ডিবির হাওরসহ নদী ও তার নিকটবর্তী এলাকার নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি প্রবেশ করছে।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, চলতি মৌসুমে উপজেলায় দুই দফা বন্যা হয়েছে। পূর্ব প্রস্তুতি অনুযায়ী উপজেলায় মোট ৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধিরা বন্যার পরিস্থিতি মনিটরিং করছেন বলে তিনি জানান।
গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার সীমান্তবর্তী ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৮ জুন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সোমবার ১ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত তিন দিনে মোট ৬৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া ১ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টা থেকে আগামী ৩ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত তিন দিনে মোট ৯৬৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে সুনামগঞ্জে টানা বৃষ্টিপাত ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির কারণে আবারও বাড়ছে সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটাসহ সব নদ-নদীর পানি। সোমবার দুপুর ১২টায় সুনামগঞ্জ জেলা শহরে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সেই সঙ্গে ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলের বেশ কিছু গ্রামীণ সড়ক। সড়কে পানি ওঠায় জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তাহিরপুর উপজেলার। তলিয়ে গেছে পৌর শহরের উত্তর আরপিননগর, সাহেববাড়ি ঘাট, তেঘরিয়া, বড়পাড়া নদীর পাড়সহ বেশ কয়েকটি এলাকার রাস্তাঘাট। এছাড়াও ছাতক, দোয়ারাবাজার, মধ্যনগরসহ বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চলের গ্রামীণ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় আবারও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নিম্নাঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষকে।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, বিপৎসীমা ছাড়িয়ে সুরমা নদীর পানি ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারার পানি বাড়লেও তা বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। কুশিয়ারা নদীতে জুড়ী নদী ও শেরপুরের মনু নদের পানি এসে মিলিত হয়। একই নদীতে আরও দুটি নদীর পানি মিলিত হওয়ায় পানি বেড়ে যায়। ফলে কুশিয়ারার পানি বিপৎসীমার নিচে নামতে সময় লাগে। এ ছাড়া নিম্নাঞ্চল প্লাবিত থাকায় এবার পানি ধীরগতিতে নামছে।
কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা নাসরিন বলেন, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আবারো বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। এ নিয়ে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক থাকার পাশাপাশি বন্যা দেখা দিলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজনদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশনা দেন। সোমবার সকাল থেকে পানি বাড়া অব্যাহত রয়েছে। এভাবে দ্রæত বেগে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে কানাইঘাটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হতে পারেন মানুষজন।