মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বাইবেল অনুসারে নারী দুর্বল ও নরম স্বভাবের। ঈশ্বর তাদের এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য তাদের সাথে বুদ্ধিপূর্বক চলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর তাৎপর্য হল, তাদেরকে না ঠকানো ও প্রতারিত না করা। তাদেরকে ভোগ্য পন্য না বানানো বা তাদেরকে অধিকার বঞ্চিত না করা। কারণ বাইবেলে একের প্রতি অন্যের ভালোবাসা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। ভালোবাসা সবসময় ধৈর্য ধরে, দয়া করে, হিংসা করে না, গর্ব করে না, অহংকার করে না, খারাপ ব্যবহার করে না, নিজের সুবিধার চেষ্টা করে না, রাগ করে না, কারো মন্দ ব্যবহারের কথা মনে রাখে না, মন্দ কিছু নিয়ে আনন্দ করে ন। বরং যা সত্য তাতে আনন্দ করে। “করিন্থিয়, ১৩:৪-৬”।
নারী নির্যাতন রোধে বাইবেলের দশ আজ্ঞায় সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘ব্যভিচার করো না। অন্যের ঘর, স্ত্রী, দাসদাসী, গরু-গাধা কিংবা অন্য কিছুর উপর লোভ করো না।’ “যাত্রাপুস্তক, ২০:১৪ও১৭”। অন্যত্র আরো কড়াকাড়িভাবে বলা হয়েছে, ‘যে কেউ কোনো স্ত্রীলোকের দিকে কামনার চোকে তাকায় সে তখনই মনে মনে তার সঙ্গে ব্যভিচার করল। তোমার ডান চোখ যদি তোমাকে পাপের পথে টানে তবে তা উপড়ে দুরে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত দেহ নরকে পোড়ার চেয়ে বরং তার একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভাল। যদি তোমার ডান হাত তোমাকে পাপের পথে টানে তবে তা কেটে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত দেহ নরকে যাওয়ার চেয়ে বরং একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভাল। “মথি, ৫:২৭-৩০”। নারীদের ভুল-ত্র“টি শুধরে দেয়ার নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বয়স্কা স্ত্রীলোকদের মায়ের মত মনে করে সংশোধন করো এবং যুবতীদের বোনের মত মনে করে পবিত্রভাব বজায় রেখে সংশোধন করো। “তীমথিয়, ৫:২”। বিভিন্ন বয়সী নারীগণের সাথে পুরুষরা কেমন আচরণ করবে এ নির্দেশনা থেকে তা জানা যায়। এ নির্দেশনা মেনে চললে নারীদের প্রতি বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হতে পারে না।
সমাজে নারীঘটিত সকল সমস্যা সমাধানে খ্রিষ্টধর্মের মূলীভূত চেতনা ও শিক্ষা কার্যকর হতে পারে। খ্রিষ্টধর্মের চেতনা অনুসারে, মানবদেহ ঈশ্বরের এবং এ দেহ ঈশ্বরের থাকার মন্দির। মানবদেহকে ঈশ্বরের গৌরবের জন্য ব্যবহার করা যায়। যৌন সম্পর্ক ঈশ্বরের দেয়া একটি দান। এ সম্পর্কে বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘কিন্তু চারদিকে অনেক ব্যভিচার হচ্ছে, সেজন্য প্রত্যেক পুরুষের নিজের স্ত্রী থাকুক আর প্রত্যেক স্ত্রীর নিজের স্বামী থাকুক।’ “করিন্থিয়, ৭:২”। বাইবেলে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কেও সর্তক করা হয়েছে, ‘প্রত্যেকে যেন বিয়ের ব্যাপারটাকে সম্মানের চোখে দেখে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ের পবিত্র সম্পর্ক রাখা উচিত, কারণ যে কোনো রকম ব্যভিচার হোক না কেন, যারা সেই দোষে দোষী ঈশ্বর তাদের শাস্তি দেবেন।’ “ইবরীয়, ১৩:৪”। খ্রিস্টধর্মে অবশ্য সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে পরিবারের চাহিদা মিটাবার ভার পুরুষকে দেয়া হয়েছে। “আদিপুস্তক, ৩:১৯”।
একজন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা তাদের দায়িত্ব কিভাবে পূর্ন করবেন বাইবেলে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘দেহের দিক থেকে স্ত্রীর যা পাওনা, তার স্বামী তাকে তা দিক। সেভাবে স্ত্রীও স্বামীকে দিক। স্ত্রীর দেহ তার নিজের নয়, তার স্বামীর। একইভাবে স্বামীর দেহ তার নিজের নয়, তার স্ত্রীর। একে অন্যের সঙ্গে দেহে মিলিত হতে অস্বীকার করো না; তবে কেবল প্রার্থনা করতে সুযোগ পাবার জন্য একমত হয়ে কিছুকাল আলাদা থাকতে পার। তারপরে আবার একসঙ্গে মিলিত হয়ো, যেন নিজেদের দমনের অভাবে শয়তান তোমাদের পাপের দিকে টানতে না পারে’। “করিন্থিয়, ৭:৩-৫”। খ্রিস্টসমাজে চারপাশে যৌন হয়রানির যে ঘটনা ঘটে খ্রিস্টধর্মীয় বিধান মেনে প্রত্যেক পুরুষ স্ত্রী আর প্রত্যেক স্ত্রী স্বামী গ্রহণ করলে যৌন হয়রানীমূলক কার্যকলাপ সংঘটিত হতে পারে না।
খ্রিস্টধর্ম সদাচার ও সুনীতির যে নির্দেশনা রয়েছে তা যথাযথভাবে পালন করলে এবং মানুষ ধর্ম বিশ্বাসে অটুট থাকলে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটার কথা নয়। কিন্তু মানুষ পাপের পথে গিয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে সমাজকে কুলষিত করছে। বাইবেলে বলা হয়েছে, এভাবে মানুষ ঈশ্বরকে মানতে চায়নি বলে ঈশ্বরও পাপপূর্ণ হতে তাদের ছেড়ে দিয়েছেন। আর সেজন্যই মানুষ অনুচিত কাজ করতে থাকে। সব রকম অন্যায়, মন্দকাজ, লোভ, নীচতা, হিংসা, খুন, মারামারি, ছলনা ও অন্যের ক্ষতি করার ইচ্ছায় তারা পরিপূর্ণ। তারা অন্যের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, অন্যের নিন্দা করে এবং ঈশ্বরকে ঘৃণা করে। তারা বদমেজাজি, অহংসারী ও গর্বিত। অন্যায় কাজ করার জন্য তারা নতুন নতুন উপায় বের করে। তারা মা-বাবার অবাধ্য, ভালমন্দের জ্ঞান তাদের নেই আর তারা অবিশ্বস্ত। পরিবারের প্রতি তাদের ভালবাসা নেই এবং তাদের অন্তরে দয়ামায়া নেই। ঈশ্বরের এই বিচারের কথা তারা ভাল করেই জানে যে, এ রকম কাজ যারা করে তারা মৃত্যুর শাস্তির উপযুক্ত। এ কথা জেনেও তারা যে কেবল এ সব কাজ করতে থাকে তা নয় কিন্তু অন্য যারা তা করে তাদের সায়ও দেয়। “রোমীয়, ১:২৮-৩২”।
বাইবেলের এ সকল নির্দেশনা মেনে চললে কোন খ্রিস্টধর্মালম্বীর পক্ষে কোনো নারীকে নির্যাতন করা সম্ভব নয়। বরং এ সকল নির্দেশনা মেনে চললে প্রত্যেক ধর্মভীরু খ্রিস্টানের নারীর প্রতি ভালো দৃষ্টিতে দেখায় অভ্যাস তৈরি হবে, অন্যের প্রতি মমত্ববোধ ও সহমর্মিতা বেড়ে যাবে।
বৌদ্ধধর্মে নারী: বৌদ্ধধর্মীয়গণ মৈত্রীপরায়ণ ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। তারা বুদ্ধের অহিংসা নীতি, সংযম ও ধৈর্য সংহতির মন্ত্রে উজ্জীবিত। তারা বিশ্বাস করে, বৈরিতা কখনো প্রশমিত হয় না, বৃদ্ধি পায়। অহিংসা ও মৈত্রী দিয়েই বৈরিতা প্রশমিত হয়। এটিই জাগতিক নিয়ম। বৌদ্ধ ধর্মমতে, জীবন সমৃদ্ধির জন্য করুণা ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন অপরিহার্য। এ দুটি গুণ ছাড়া জীবন কখনো পরিপূর্ণতা সাধন করে না। জীবনকে পূর্ণ মনুষ্যত্বে পর্যবসিত করতে হলে দয়া, সেবা, দান, মমতা, ভালবাসা, সহিষ্ণুতা, পরোপকারিতা, সমব্যাথি হওয়া প্রভৃতি ধর্মগুণের প্রয়োজন হয়। এগুলোই মানুষকে করুণাবান ও মৈত্রীবান হতে শেখায়। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, মৈত্রীর দ্বারা ক্রোধকে জয় করবে, অসাধুতাকে জয় করবে সাধুতার দ্বারা, কৃপণকে দান দ্বারা এবং মিথ্যাবাদীকে সত্য দ্বারা জয় করবে। “ধম্মপদ, শ্লোক ২২৩”। অন্যত্র বলা হয়েছে, পরস্পরকে বঞ্চনা করো না, হিংসা বা আক্রোমের বশবর্তী হয়ে পরস্পরের মধ্যে দুঃকোৎপাদনের চেষ্টা করো না। “ধম্মপদ, শ্লোক ৬”। মহামতি বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছেন, যারা পরকে দুঃখ দিয়ে কিংবা পরের অনিষ্ট সাধন করে নিজের সুখ কামনা করে সেই বৈর-সংসর্গ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ কোনদিন মুক্তি লাভ করতে পারবে না। শাস্ত্র তাই বলছে, ‘পরদুক খুপদানের সো অত্তনো সুখমিচ্ছতি রেবসংস¹ সংসটপাঠো বেরা সোন পরিমুচ্চতি’। “ধম্মপদ, শ্লোক ২৯১”।
বৌদ্ধধর্মের মহানির্বাণ সূত্রে জানা যায়, তথাগত বুদ্ধ সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মে বজ্জীদের উদ্দেশ্যে যে সাতটি অমূল্য উপদেশ প্রণয়ন করেছিলেন সেখানে পঞ্চমটিতে রয়েছে, মাতৃজাতিকে সম্মান করার কথা, কুল নারীদের শ্রদ্ধা করার কথা, তাদের মান-সম্মান রক্ষা করার কথা। সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম হল, খাবতীবঞ্চ আনন্দ বজ্জী যা তা কুরিখিযো, কুল কুমারিয়ো তা ন ওক্কসস বাসেসন্তি, বুদ্ধিযেব আনন্দ বজ্জীনং পাটিকঙ্খ নো পরিহানী। “ধম্মপদ, শ্লোক ২৪৯”। অর্থাৎ আনন্দ! যতদিন বজ্জীগন কুলকুমারী ও রমণীদেরকে সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে এবং বলপূর্বক অপহরণ করে নিজ গৃহে বসবাস করাবে না ততদিন বজ্জীদের শ্রীবৃদ্ধি হবে, কখনো তাদের পরিহানী হবে না।
বৌদ্ধগন যে কোনো মানবতার কাজে উৎসাহ যোগান। ত্রিপিটকে মহামতি বুদ্ধ বলেছেন,
অসুভানুপসিসং বিহরন্তং, ইন্দ্রিয়েসু সুসংতং
ভোজননাহি চ মত্তঞঞুং, সদ্ধং, আরদ্ধবীরিযং
তং বে নপ্পসহতি মারো বাতো সেলংব পব্বতং। “ধম্মপদ, শ্লোক ৮”।
অর্থাৎ যিনি বাহ্যিক শোভা বা সৌন্দর্য দর্শন হতে বিরত থাকেন, সকল ইন্দ্রিয়সমূহকে সংযত রাখেন, ভোজনে, মাত্রাজ্ঞান ও সেবাপরায়ণ হন, শ্রদ্ধাবান ও আরদ্ধবান, তারা কখনো পরাভূত হন না, যেমনি হয় না প্রবল বায়ুতে শিলাময় পর্বত।
ইসলামে নারী: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আবির্ভাব প্রাক্কালীন সময়ে আরবে নারী নির্যাতন চরম আকার ধারন করেছিলো। নারীর জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের কোনো নিরাপত্তা ছিলো না। প্রকাশ্য আসরে ব্যভিচারিতার নিলর্জ্জ প্রদর্শনে নারীকে বাধ্য করা হয়েছিল। খুন, রাহজানি, ধর্ষণ, অপহরণ, ব্যভিচারিতার মিথ্যা অভিযোগ, নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি নারী জীবনের প্রতিশব্দ হয়ে ওঠেছিলো। নারীদের চলাফেরা, খোলামেলা পোশাক আর উত্তেজক শারীরিক কসরত পুরুষকে এ কাজে আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করছিলো। ইসলাম নারীকে এমন নির্যাতিত জীবনের পরিবর্তে সম্মানের জীবন দেয়ার ব্যবস্থা করে। নারী নির্যাতনের সকল পথ ও পদ্ধতি নিষিদ্ধ করে নারীর মর্যাদাপূর্ণ ও শান্তিময় জীবনযাত্রা নিশ্চিত করে। “অধ্যাপক নাজির আহমেদ ও ড. মুহাম্মদ রুহুল আমিন, মুসলিম সংস্কৃতির ইতিহাস, ঢাকা: আরাফাত পাবলিকেশন্স, ১৯৮৯, পৃ: ২৬৭”।
বর্তমান সময়ে পরিবারে ও সমাজে নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়। কন্যা হয়ে জন্মানোর অপরাধে তাকে মা-বাবা ও অন্যান্যদের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হতে হয়। ছেলে সন্তানের চেয়ে সকল ক্ষেত্রে সে কম সুবিধা ও অধিকার পায়। বিবাহের ক্ষেত্রেও তার কোনো মতামত নেয়া হয় না। বিয়ের পর স্বামী ও তার আত্মীয়দের যৌতুক দাবি এবং সে কারণে নির্যাতন কিংবা এমনিতেই মৌখিক, শারীরিক ও মানসিক লঞ্ছনা নারীকে দুঃসহ জীবনে ঠেলে দেয়। আর্থিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা, মানুষ হিসেবে সমান অধিকার ও মর্যাদা না দেয়া, নারীর পাপের কারণ বলে অবহেলা ও উপেক্ষা করা, ব্যভিচারে বাধ্য করা, ধর্ষণ, হত্যা, অকারণে তালাক দেয়া, মিথ্যা অপবাদ দেয়া, অসম শ্রমে বাধ্য করা, ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা, ধর্ম ও শিক্ষা চর্চা থেকে দূরে রাখা, নাচ, গান, বিজ্ঞাপন, নাটক এবং চলচ্চিত্রে নারীদেহকে পন্য হিসেবে ব্যবহার, বিবাহ-পূর্ব প্রেম এবং শিক্ষা ও চাকুরি জীবনে অবাধ নারী সম্ভোগের ব্যবস্থা রাখা প্রভৃতি পদ্ধতিতে নারী নির্যাতনের শিকার হয়। “আল্লামা আব্দুস সামাদ রাহমানী, নারী মুক্তি কোন পথে? ভাষান্তর: মুফতী মুঈনদ্দীন তৈয়বপুরী, ঢাকা: ২০০০, পৃ: ৭৭”। ইসলামের বিধান অনুসারে নির্যাতনের এ সকল ক্ষেত্র থেকে নারীকে কিভাবে রক্ষা করা যায় কুরআন-হাদীসে তার বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে। কোনো নারীর প্রতি কোনো পর-পুরুষ ইচ্ছা করে তাকিয়ে থাকতে পারবে না। বরং দৃষ্টি সংযত রাখবে। নারীও কোনো পর-পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকবে না। অনিচ্ছায় হঠাৎ করে চোখ পড়ে গেলেও সাথে সাথে ফিরিয়ে নেবে। কেননা কামনা সৃষ্টি হওয়া বা লোভ জন্ম নেয়ার শুরু চোখের দেখা থেকেই হয়। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেনো তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেনো তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে। “আল-কুরআন, ২৪: ৩০-৩১”। সৃষ্টিগতভাবেই নারীদেহের প্রতি পুরুষের এবং পুরুষের প্রতি নারীর জৈবিক আগ্রহ থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় একে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও পুরুষ বা নারীদেহের উত্তেজক প্রদর্শনী এমনকি সাধারণ প্রকাশও বিপরীত লিঙ্গকে উত্তেজিত করে তুলতে পারে। ফলে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের শিকার হয় বেশি। এ কারণে সে অপর পুরুষকে নিজের রূপ সৌন্দর্য প্রদর্শন করবে না। অপর পুরুষের মন বা দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এমন পোশাক পরবে না। অলংকার বা প্রসাধনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে পরের সামনে উপস্থাপন করবে না। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন নারীরা সাধারণভাবে যা প্রকাশ পায় তা ছাড়া যেনো তাদের আবরণ প্রদর্শন না করে। তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেনো তারা মাথায় কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে। গোপন আবরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে তারা যেনো সজোরে পদক্ষেপ না করে। “আল-কুরআন, ২৪: ৩১”।
মুমিন পুরুষ এবং নারী তাদের লজ্জাস্থান হিফাযত করবে। একজন অপরজনকে তার লজ্জাস্থান দেখাবে না এবং যে কোনো হারাম কাজে লজ্জাস্থান ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে। উল্লেখ্য যে, সাধারণভাবে পুরুষের লজ্জাস্থান হলো নাভীমূল থেকে হাটু পর্যন্ত এবং নারীর লজ্জাস্থান হলো তার হাত, পা ও মুখমন্ডল ছাড়া পুরো শরীর। “আবদুল হামিদ আহমদ আবুসুলায়মান, বৈবাহিক সমস্যা ও কুরআন মজীদের সমাধান, ঢাকা: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট, ২০০০, পৃ: ৭৭”।
মুমিন নর-নারী কেউ কারো ঘরে অনুমতি না নিয়ে প্রবেশ করবে না। কেননা এতে লজ্জাস্থানের হিফাযত অসম্ভব হয়ে পড়বে। আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেরদের ঘর ব্যতীত অন্য কারো ঘরে ঘরবাসীদের অনুমতি না নিয়ে এবং তাদের সালাম না করে প্রবেশ করো না। যদি তোমরা ঘরে কাউকে না পাও তাহলেও তাতে প্রবেশ করবে না। যতক্ষণ না তোমাদের অনুমতি দেয়া হয়। যদি তোমাদের বলা হয়, ‘ফিরে যাও’, তাহলে তোমরা ফিরে যাবে”। “আল-কুরআন, ২৪: ২৭-২৮”।
মুমিন নর-নারী পরস্পরের পবিত্রতার ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করবে। কেউ কারো ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষন করে তাকে মানসিক নির্যাতনের শিকার বানাবে না। আল্লাহ বলেন, “যখন তারা অপবাদ সম্পর্কে শুনলে তখন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা আপন লোকদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষন করলো না কেনো? এবং বললো না, এটাতো সুস্পষ্ট অপবাদ। “আল-কুরআন, ২৪:১২”।
মুসলিম সমাজে অশ্লীল অশোভন কোনো বিষয়ের স্থান নেই। সমাজে অশ্লীলতা প্রসার পেলে নারীর মর্যাদা নষ্ট হয়। তার সম্মান বিনষ্টের সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। আল্লাহ তাই শুধু অশ্লীল আচরণ নয় বরং অশ্লীল বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলাও হারাম করেছেন। তিনি বলেছেন, “নিশ্চয়ই যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্যে দুনিয়া ও আখিরাতের মর্মন্তু শাস্তি রয়েছে।” “আল-কুরআন, ২৪:১৯”।
সৎ চরিত্রবান পবিত্র নারীর প্রতি ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ উত্থাপন কররে নারী নিদারুণ মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। নারীকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করার জন্যে মহান আল্লাহ একে কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা দিয়েছেন, “যারা সতি ও পবিত্র চরিত্রবতী নারীর প্রতি (ব্যভিচারের) অপবাদ আরোপ করে কিন্তু চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি কশাঘাত করবে এবং তাদের সাক্ষ্য কখনোই গ্রহণ করবে না এরাইতো সত্যত্যাগি।” “আল-কুরআন, ২৪:৪”।
নারী-পুরুষ উভয়ে পারস্পরিক সম্মতিতে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তুললে এবং তা চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ হলে তাদেরকে একশত কশাঘাত করা হবে। “আল-কুরআন, ২৪:২”। এ শাস্তি অবিবাহিত নারী-পুরুষের জন্য। যদি তারা বিবাহিত হয় তাহরে তাদেরকে পাথর দ্বারা আঘাত করে হত্যা করা হবে। “ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায়: আল-হুদূদ, অনুচ্ছেদ: রজমুল মুহসিন, বৈরুত: দারু ইবনু কাছীর, ১৪০৭ হি./ ১৯৮৭ খ্রি: খ.৬, হাদীস নং- ৬৪২৯”। কিন্তু অপরাধটি যদি নারীর অমতে হয়, তাকে যদি এ কাজে বাধ্য করা হয় এবং সাক্ষী প্রমাণের ভিত্তিতে নারীর অসহায়ত্ব ও অমত সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে তাহরে এ জন্যে নারী কোনো শাস্তি পাবে না। রবং এজন্যে ধর্ষক পুরুষই শাস্তি পাবে। সে অবিবাহিত হলে তাকে একশত কশাঘাত করা হবে। সে বিবাহিত হলে তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হবে। এক্ষেত্রে নারীর অব্যাহতি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “আর যে তাদেরকে (ব্যভিচারে) বাধ্য করে তাহলে তাদের জবরদস্তির পর আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” “আল-কুরআন, ২৪:৩৩”।
স্বামী যেনো ব্যভিচারিতার মিথ্যা অভিযোগ তুলে স্ত্রীকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করতে না পারে সে জন্যে আল্লাহ লিআনের বিধান দিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় ব্যভিচারের অভিযোগ তুলতে স্বামীকে চারবার আল্লাহর নামে কসম করে বলতে হয়- তার স্ত্রীর ব্যাপারে ব্যভিচারের অভিযোগ উত্থাপনের ব্যাপারে সে সত্যবাদী। পঞ্চমবারে শপথ করে বলতে হয়- ‘যদি সে এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী হয় তাহলে তার উপর আল্লাহর লানত।’ “আল-কুরআন, ২৪:৬-৯”। অভিযোগ উত্থাপনের পর স্বামী যদি কসম করতে অস্বীকার করে তাহলে তাকে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। “ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ, দিল্লী: ১৪০৬, পৃ:৭৫”।
ব্যভিচারের শাস্তির বিধান বর্ণনা করে মহান আল্লাহ বলেছেন, “তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচার করে তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য হতে চারজন সাক্ষী আনো। যদি তারা সাক্ষ্য দেয় তবে তাদেরকে (নারীদের) ঘরে আবদ্ধ করে রাখো, যে পর্যন্ত না তাদের মুত্যু হয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থা করেন। তোমাদের মধ্যে যে দুজন এতে লিপ্ত হবে তাদেরকে শাস্তি দিবে। যদি তারা তওবা করে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয় তাহলে তা হতে বিরত থাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু।” “আল-কুরআন, ৪:১৫-১৬”। এ আয়াতদ্বয়ে প্রথমত ব্যভিচার প্রমাণের বিশেষ পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে যে, চারজন পুরুষের সাক্ষ্য দরকার হবে। দ্বিতীয়ত ব্যভিচারের শাস্তি নারীর জন্যে ঘরে আবদ্ধ রাখা এবং উভয়কে কষ্ট প্রদান করার কথা উল্লেখিত হয়েছে, এ প্রসঙ্গে একথাও বলা হয়েছে যে, ব্যভিচারের শাস্তি সংক্রান্ত এই বিধানই সর্বশেষ নয়, বরং ভবিষ্যতে অন্য বিধান আসবে। সূরা নূরে আল্লাহ সেই অন্য বিধান বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “ব্যভিচারী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ তাদের প্রত্যেককে একশত করে কশাঘাত করো। আল্লাহর বিধান কার্যকর করায় তাদের প্রতি দয়া যেনো তোমাদের প্রভাবিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও। মুমিনদের একটি দল যেনো তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।” “আল-কুরআন, ২৪:২”। অর্থাৎ শাস্তিটি গোপনে দেয়া যাবে না, দিতে হবে প্রকাশ্যে। সূরা নূরের আলোচ্য আয়াতে কোনোরূপ বিবরণ ও বিশেষায়ন ছাড়াই ব্যভিচারের শাস্তি একশত কশাঘাত বর্ণিত হয়েছে। এ শাস্তি কোনো ধরনের পুরুষ ও নারীর জন্যে আল্লাহ তার সুনির্ধারিত ব্যাখ্যা দেননি। কিন্তু তার পরোক্ষ নির্দেশ ও নির্দেশনায় রাসূলুল্লাহ সা. এ শাস্তির প্রয়োগগত দিক বিশ্লেষণ করে বলেছেন, “আমার নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করো। আল্লাহ ব্যভিচারী পুরুষ ও নারীর জন্যে বিধান বিবৃত করেছেন। তা হচ্ছে, অবিবাহিত নারী ও পুরুষের জন্যে একশত কশাঘাত এবং এক বছরের নির্বাসন আর বিবাহিত নারী ও পুরুষের জন্যে একশত কশাঘাত ও পাথরের আঘাতে হত্যা”। “ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, অধ্যায়: আল-হুদূদ, অনুচ্ছেদ: হাদ্দুয যিনা, বৈরূত: দারু ইহায়াহতি তুরাছিল আরাবিয়্যি, তা.বি., খ.৩, হাদীস নং-১৬৯০”।
আবু হুরায়রা ও যায়দ ইবনে খালিদ আল-জুহানী রা. এর বর্ণনা থেকে বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়। তাঁরা বর্ণনা করেন, জনৈক বিবাহিতা মহিলা তার অবিবাহিত চাকরের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। ব্যভিচারীর পিতা তাকে নিয়ে রাসূলূল্লাহ সা. এর নিকট উপস্থিত হন। স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ঘটনা প্রমাণিত হয়ে গেলে রাসূলূল্লাহ সা. বলেন “আমি তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা করবো”। তারপর তিনি আদেশ দিলেন ব্যভিচারী অবিবাহিত ছেলেকে একশত কশাঘাত করো”। তিনি বিবাহিত মহিলাকে পাথরের আঘাতে হত্যা করার জন্য উনায়স রা. কে আদেশ দিলেন। উনায়স রা. নিজে মহিলার স্বীকারোক্তি নিলেন। তারপর তার উপর প্রস্তারঘাতে হত্যার বিধান প্রয়োগ করলেন”। “ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, অধ্যায়: আল-হুদূদ, অনুচ্ছেদ: মান ইতারাফা আলা নাফসিহি বিয-যিনা, প্রাগুক্ত, খ.৩, হাদীস নং-১৬৯৭”।
এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বিবাহিত ও অবিবাহিতকে ভিন্ন ধরনের শাস্তি দিয়েছেন এবং দুটো শাস্তিকেই আল্লাহর ফয়সালা বলে উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ হলো, যদিও কুরআনে প্রস্তারাঘাতে হত্যার বিধান বিধান দেয়া হয়নি কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা. এ ফয়সালা ওহীর মাধ্যমে আল্লাহর নিকট থেকেই পেয়েছেন। “আবদুল হালীম আবু শুককাহ, রসূলের স. যুগে নারী স্বাধীনতা, ঢাকা: বাংলাদেশে ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট, ২০১১, খ.১, পৃ:৪৩”।
নারীদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হলে বা নির্যাতন করা হলে তার প্রতিবিধানে ইসলাম কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। নারীর শ্লীলতাহানির জন্য নির্যাতন হলে সংশ্লিষ্ট পুরুষকে ব্যভিচারের শাস্তি দিতে হবে। আর্থিক বা অন্য কোনো বৈষয়িক কারণে নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হলে ইসলামী আদালত কিসাসের বিধান অনুসারে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করবে। যতটুকু নির্যাতন নারীকে করা হয়েছে বা যেভাবে তাকে আহত করা হয়েছে কিংবা আঘাত করা হয়েছে, নির্যাতনকারীকেও ঠিক ততোটুকু পরিমাণ আঘাত করতে হবে। কুরআন মাজীদে এ জাতীয় শাস্তির উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, “আমি তাদের জন্য তাওরাতের বিধান দিয়েছিলাম যে, প্রাণের পরিবর্তে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁেতর বদলে দাঁত এবং জখমের বদলে সমান জখম। এরপর কেউ যদি তা ক্ষমা করে তাহলে ক্ষমাকারীর পাপ মোচন হবে। আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুসারে যারা বিচার ফয়সালা করে না তারাই জালিম”। “আল-কুরআন, ৫:৪৫”।
তাই শারীরিকভাবে নারী যতটুকু নির্যাতিত হবে, ইসলামী আইনের আলোকে ততটুকু নির্যাতন নির্যাতনকারীর উপর চালানো যাবে। অবশ্য নারী নিজে এই কাজ করবে না। ইসলামী আদালত নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শাস্তিদানের ব্যবস্থা করবে। নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতনের সাথে সাথে যদি তাকে অসম্মান করার জন্য অশালীন কোনো কাজ করা হয় বা কোনো কথা বলা হয়, অপরাধের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে বিচারক সে জন্যও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এসিড নিক্ষেপ ভয়ানক কাপুরুষতা এবং অমানবিক বর্বরতা। বাংলাদেশে এটি ভীতিকর অবস্থায় এসে উপনীতি হয়েছে। এসিড নিক্ষেপের ব্যাপারে কিসাসের শাস্তিই হবে কার্যকর ব্যবস্থা। “গাজী শাসছুর রহমান, ইসলামে নারী ও শিশু প্রসঙ্গ, ঢাকা: ১৯৮১, পৃ: ৬০”। অর্থাৎ যে এসিড নিক্ষেপ করবে, তাকেও এসিড দিয়ে ঝলসে দেয়া হবে, ততটুকু, যতটুকু সে করেছে। এর পাশাপাশি এসিড নিক্ষেপের সাথে সাথে সন্ত্রাস সৃষ্টির একটি সম্পর্ক রয়েছে বলে সন্ত্রাসীর জন্য ইসলাম যে শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছে এসিড নিক্ষেপকারীর উপর সে শাস্তিও কার্যকর করা যাবে। মহান আল্লাহ বলেন, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের শাস্তি হলো, তাদেরকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ার জীবনে এটাই তাদের লাঞ্ছনা আর আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি”। “আল-কুরআন, ৫:৩৩”।
ইসলামের শাস্তিবিধান অনুসারে এসকল শাস্তি প্রকাশ্যে জনসমাবেশে কার্যকর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো মমতা বা দয়া দেখানো যাবে না। তাহলে মূলত অপরাধী আরো অপরাধ করার উৎসাহ পাবে। শাস্তি যদি জনসমাবেশে প্রকাশ্যে কার্যকর করা হয় তাহলে নতুন করে কেউ আর একই অপরাধ করতে সাহসী হবে না। “এ জেড এম শামসুল আলম, ইসলামী প্রবন্ধমালা, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশণ, ২০০৪, পৃ: ২৮৭”। শাস্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রে এই নীতি ও পদ্ধতি উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর বিধান কার্যকর করায় তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের প্রভাবিত না করে, যদি তোমারা আল্লাহ এবং আখিরাতে বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে”। “আল-কুরআন, ২৪:২”। এমন কঠোর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হলে এসিড নিক্ষেপ থেকে নারীকে সহজেই রক্ষা করা যাবে।
পথে-প্রান্তরে নারী নানা অবাঞ্ছিত পরিরস্থিতির শিকার হয়। বখাটে এবং ভদ্রবেশী বিভিন্ন বয়সের পুরুষরা তাদেরকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে। অশ্লীল কথা বলে, অঙ্গভঙ্গি করে, শীল বাজিয়ে, স্বাভাবিক পথচলা ব্যাহত করে, নানা কুপ্রস্তাব দিয়ে প্রভৃতি রকমারি পদ্ধতিতে নারীকে উত্ত্যক্ত করা হয়। বলা বা লেখায় নারীর প্রতি উত্ত্যক্তকরণের ক্ষতিকর প্রভাব বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। বরং সংশ্লিষ্ট নারীই এই বিড়ম্বনার অন্তহীন কষ্টের কথা বলতে পারেন। যে কারণে আমরা বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে উত্ত্যক্তকরণের শিকার নারীকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে দেখি। “ইসহাক ওবায়দী, যুগে যুগে নারী, ঢাকা: ১৯৯৭, পৃ: ৫৪”। এসব ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হলো, উত্ত্যক্তকরণের কারণে নারী যদি আত্মহননে পথ বেছে নেয় তাহলে সংশ্লিষ্ট উত্ত্যক্তকারী মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হবে। কারণ প্রত্যক্ষভাবে হত্যায় অংশ না নিলেও সেই মূলত হত্যাকারী। তাকে ইসলাম নির্ধারিত হত্যার শাস্তিই দেয়া হবে। আর যদি উত্ত্যক্তকৃত নারী আত্মহননের পথ বেছে না নেয় তাহরে সমাজে বিশৃঙ্খলা-বিপর্যয় এবং অশালীন কার্যকলাপ সৃষ্টির দায়ে উত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দন্ডবিধান কার্যকর করা হবে। “ড. জামাল আল বাদাবী, ইসলামী শিক্ষা সিরিজ, ঢাকা: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট, ২০০৮, পৃ: ৮৭”।
বাংলাদেশে যৌতুক এক ভয়ঙ্কর বিভীষিকা। হিন্দুধর্মবালম্বীদের বিবাহরীতিতে আবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে যে পণপ্রথার ব্যবস্থা রয়েছে তাই যৌতুক হিসেবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দু ধর্মমতে পিতা-মাতার সম্পদে নারীর কোনো অংশ নেই বলে বিবাহের সময় স্বামী-পক্ষ যথাসম্ভব বেশি বেশি অর্থ ও উপহার পণ হিসেবে গ্রহণ করে। বিবাহের আগে দরকষাকষির মাধ্যমে এটা নির্ধারিত হয়ে থাকে। ইসলামে এমন বিধান নিষিদ্ধ। ইসলামে বরং বিবাহের জন্য স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে মোহর প্রদান করতে হয়। যৌতুক তাই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং ইসলাম বিরুদ্ধ প্রথা। মুসলিমদের এ প্রথায় অভ্যস্ত হওয়ার অর্থ হলো ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে যাওয়া। ইসলামী আদালত ইসলামী বিধানের বিরুদ্ধাচরণের জন্য যারা যৌতুক দাবি করবে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থা অনুসারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। “বি আইশা লেমু ও ফাতেমা হীরেন, ইসলামের দৃষ্টিতে নারী, ঢাকা: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট, ২০১০, পৃ: ২১”।
নারী হওয়ার কারণে তার প্রতি কোনো প্রকার অসম আচরণ করা যাবে না। “মুহাম্মদ আবদুর রহীম, পরিবার ও পারিবারিক জীবন, ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ১৯৮৮, পৃ:৮৮”। যেমন মেয়ে শিশুকে কম খেতে দেয়া, ছেলে শিশুকে বেশি খেতে দেয়া, মেয়ে শিশুকে কম আদর করা বা অবহেলা করা আর ছেলে শিশুকে বেশি আদর করা, নারীকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা আর পুরুষকে সকল উত্তারধিকারের মালিক করে দেয়া। নারী বলে কাউকে কাজে নিয়োগ না দেয়া (যদি সে কাজে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে শরীয়তের নিষেধাজ্ঞা থাকে, সে কথা স্বতন্ত্র), নারী হওয়ার কারণে তাকে লেখাপড়া থেকে দূরে রাখা ইত্যাদি বিষয়গুলো ইসলাম সমর্থন করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলাম বরং মেয়ে শিশু ও নারীকেই পুরুষের উপর অধিক মর্যাদা এবং অধিকতর অধিকার প্রদান করে থাকে। “মুহাম্মদ আবদুর রহীম, নারী, ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ২০০৮, পৃ: ৪৭”।
বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নারীরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। এ দেশের পুরুষরা ইসলামের বিধি-বিধান সত্যিকারার্থে অনুশীলন করে না। তারা নারীকে মর্যাদা দেয়ার পরিবর্তে কখনো ভোগের সামগ্রী মনে করে। এমতাবস্থায় যে সকল নারীর ক্ষমতা আছে তারা ব্যক্তি পর্যায় থেকে জীবনের সকল পর্যায়ে ইসলামের উন্নত নৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, সন্তানদের ইসলামের নৈতিকতা সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন, নিজেরা ইসলামের শালীনতার বিধান মেনে চলতে পারেন। তাহরে আশা করা যায়, অনেক বিব্রতকর অবস্থা থেকে তারা এমনিতেই রক্ষা পাবেন। বাংলাদেশে যত নারী এসিডদগ্ধ হয়েছে তাদের কেউ-ই পর্দানশীল বা বোরখা পরিহিতা নারী নন। এ থেকে এটাও প্রমাণ হয়, এ সকল নারীর অনেকেই আন্তরিকভাবে পর্দাবিধান না মেনে চললেও কেবল বোরখা পরার কারণে যেখানে অনেকখানি নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছেন, সেখানে তারা যদি ইসলামের সকল বিধান মেনে চলেন, তাহলে তারা যে নির্যাতন থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাবেন, তা সহজেই প্রতীয়মান হয়। সাথে সাথে সমাজের পুরুষগন যদি ইসলামের বিধান মেনে নারীর অধিকার আদায় এবং নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে এগিয়ে আসেন, তাহলে আলাদা করে নারী দিসব ঘোষণা করার প্রয়োজন হবে না। বরং প্রতিদিনই নারীর সম্মান ও অধিকার যথাযথভাবে রক্ষিত হবে। এই বাংলাদেশে একজন নারীও আর নির্যাতনের শিকার হবেন না। “অধ্যক্ষ যাইনুল আবেদীন, নারী নির্যাতন রোধে ইমামগণের ভূমিকা, ঢাকা: ২০০৬, পৃ: ১৩”।
উপসংহার: সনাতন, খ্রিস্ট, বৌদ্ধ বা ইসলাম কোনো ধর্মীয় আইনই নারী নির্যাতন সমর্থন করে না বরং নারীকে নির্যাতন থেকে সুরক্ষার জন্য সর্বোতভাবে চেষ্টা করে। বিশেষত ইসলাম ধর্মে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য যেমন বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট আইন প্রদান করা হয়েছে তাতে ইসলাম ধর্মের অনুসারী কোনো ব্যক্তির পক্ষে ধর্মীয় কারণেই কোনো ধরনের নারী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। সনাতন, খ্রিস্ট ও বৌদ্ধ ধর্মের নারী নীতিও একান্তভাবে এটাই প্রমাণ করে ধর্মগুলোর নিষ্ঠাবান কোনো অনুসারী নারী নির্যাতন করতে পারে না। এমনকি তাদের সামনে কোনো নারী নির্যাতনে শিকার হতে পারে না। ধর্মীয় শিক্ষা ও আবেগের জন্যই তারা নারীকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এ দেশে সনাতন, বৌদ্ধ ও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী লোক সংখ্যাও কম নয়। সকল ধর্মানুসারী লোকের মধ্যে তাদের স্ব স্ব ধর্ম অনুসারে নারী নির্যাতন প্রতিরোধক শিক্ষা ও বিধি সমূহের নির্মোহ, নিরপেক্ষ এবং সঠিক প্রচারণা চালানো হলে এবং তাদেরকে ধর্মীয় আর্দশ ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা গেলে বাংলাদেশে সমন্বিতভাবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সম্ভব হবে। (সমাপ্ত)