ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সিলেটে বিদ্যুৎ বিপর্যয় : টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি, বন্যার আশঙ্কা

22

সিন্টু রঞ্জন চন্দ

ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সিলেটে রবিবার রাত থেকে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়। যা মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। দুদিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সিলেটের প্রধান নদী সুরমার পানি একটি পয়েন্টে মাত্র ২১ ঘণ্টায় বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। এ অবস্থায় সিলেট বিভাগে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তার এবং খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে সিলেট নগরীসহ পুরো বিভাগজুড়ে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দেয়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় সাড়ে তিন লাখ গ্রাহক সোমবার রাত থেকে বিদ্যুৎহীন ছিলেন। তবে মঙ্গলবার দুপুরে বৃষ্টি থামার পর বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কও ব্যাহত হয়। নেটওয়ার্ক না থাকায় জরুরী প্রয়োজনেও মোবাইলেও কল করা যায়নি বলেও জানিয়েছেন গ্রাহকরা।
মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তিনঘন্টায় ৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। এর আগে সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ২৪৯ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। প্রবল বৃষ্টির কারণে নগরীর অনেক স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে গাছ উপড়ে পড়ারও খবর পাওয়া গেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির বলেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে সিলেট বিভাগে গ্রাহক আছেন প্রায় সাড়ে ৭ লাখ। এর মধ্যে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ছিলেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ গ্রাহক। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঝড়ে হওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহের তার ও খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেগুলো মেরামত শেষে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিকের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মোহাম্মদ আবদুল কাদির বলেন, মঙ্গলবার সিলেট বিভাগে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাহকদের চাহিদা ছিল ১৯৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বিদ্যুতের সরবরাহ ছিল ৭৫ মেগাওয়াট।
সিলেট বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ ৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শ্যামল চন্দ্র সরকার জানান, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সোমবার রাতে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তার এবং খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রাত থেকে বেশ কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিলো। এসব বিদ্যুৎ লাইনের মেরামত শেষে মঙ্গলবার বিকেলে পূর্ণরায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নিম্নচাপ সিলেটে অবস্থান করছিল। এ কারণে বৃষ্টিপাত ও ঝড়ের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। তবে দুপুরের পর থেকে বৃষ্টি কমেছে।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ঝড়ো হাওয়া ও প্রবল বর্ষণের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে সিলেটের জনজীবন। মঙ্গলবার সকাল থেকে নগরীর সড়কগুলোতে যানবাহনের সংকট ছিলো। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারেননি মানুষজন। তবে চাকরিজীবিদের নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। অন্যদিকে, স্কুল কলেজ খোলা থাকলেও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম ছিলো। তবে পরীক্ষা থাকায় অনেক শিক্ষার্থীরা প্রতিক‚ল আবহাওয়ার মধ্যেও বিদ্যালয়ে যেতে দেখা গেছে।
দ্রæত বাড়ছে নদ-নদীর পানি: সিলেটে দুদিনের টানা বৃষ্টি ও নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়তে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। সিলেটের প্রধান নদী সুরমার পানি একটি পয়েন্টে মাত্র ২১ ঘণ্টায় বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। এ অবস্থায় সিলেট বিভাগে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সিলেটে বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস আগেই মিলেছিলো। কিন্তু সেটি অবস্থান নেবে সিলেটে- সেই তথ্য আগে পাওয়া যায়নি। হঠাৎ করে সোমবার রাতে উপক‚ল অতিক্রম করে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল সিলেটে অবস্থান নেয় রিমাল। তবে সেটি তখন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। দুর্বল থাকলেও এ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সিলেটে সোমবার দিবাগত রাতভর ভারি বর্ষণ হয়েছে। বৃষ্টি হয়েছে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত। সঙ্গে ছিলো তুমুল ঝড়ো-হাওয়া। এর আগে রবিবার দিবাগত রাতেও বৃষ্টি হয় সিলেটে।
এ ব্যাপারে সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. মোহাম্মদ সজীব হোসাইন জানিয়েছেন- সোমবার সকাল ৬টা পরবর্তী ২৪ ঘন্টায় সিলেটে ২৪৯ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৬ থেকে ৯টা পর্যন্ত ৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে সিলেটে। এছাড়া সিলেটের উজান ভারতের চেরাপুঞ্জিতে একদিনে ১ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এ অঞ্চলের ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সিলেটে বাড়তে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানির পরিমাণ ছিলো স্বাভাবিক উচ্চতা থেকে ৪.৫৯ সেন্টিমিটার উপরে। পরবর্তী মাত্র ২১ ঘণ্টায় সেই উচ্চতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.৬৬ সেন্টিমিটারে। যা ডেঞ্জার লেভের কাছাকাছি। সুরমার ওই পয়েন্টে স্বাভাবিকের থেকে ১২.৭৫ সেন্টিমিটার উচ্চতাকে ডেঞ্জার লেভেল ধরা হয়।
সুরমা ছাড়াও সিলেটের কুশিয়ারা, লোভা, সারীসহ সবগুলো নদ-নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় বাড়ছে দ্রæত গতিতে। এখন পর্যন্ত কোনো নদীর কোনো পয়েন্টে পানি ডেঞ্জার লেভেল অতিক্রম না করলেও সিলেটে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ওসমানী বিমানবন্দরে ফ্লাইটের শিডিউল বিপর্যয়: ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট উঠানামায় শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। মঙ্গলবার সকালে ৬টি ডাইভার্ট ফ্লাইট গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। কোনো কোনো ফ্লাইট একীভ‚ত হয়ে গন্তব্যস্থলের উদ্দেশে উড্ডয়ন করছে বলে জানিয়েছেন ওসমানী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ। তিনি জানান, গত সোমবার ৯টি ডাইভার্ট ফ্লাইট জরুরি অবতরণ করেছিল। এর মধ্যে ৩টি ওইদিনই গন্তব্যের উদ্দেশে চলে গেছে। মঙ্গলবার সকালের দিকে বাকি ৬টি ডাইভার্ট ফ্লাইট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করেছে। সকালের দিকে যাত্রা করা ৬টি ফ্লাইটিই ছিল ইউএস বাংলার বলে জানিয়েছেন এয়ারলাইন্সটির ওসমানী বিমানবন্দরের সহকারী ব্যবস্থাপক বেলায়েত আলী লিমন। তিনি বলেন, ৬টি ফ্লাইটের মধ্যে ৭টা ১৮ মিনিটের দিকে প্রথম ফ্লাইট ঢাকার উদ্দেশে উড্ডয়ন করে। সবশেষ ফ্লাইটটি ৯টা ৩৫ মিনিটের বিমানবন্দর ছেড়ে যায়। সবগুলো ফ্লাইটই সুষ্ঠুভাবে গন্তব্যের উদ্দেশ্য ছেড়ে গেছে।
নগরীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত: প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বৃষ্টিতে সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চরম জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। সড়ক উপচে পানি ঢুকে পড়েছে মানুষের বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এতে নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি। মঙ্গলবার ভোররাতের টানা ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা তৈরী হয় নগরীর নিম্নাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায়। এছাড়াও জেলার জৈন্তুপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারী বৃষ্টির ফলে নগরীর শাহজালাল উপশহর, বিমানবন্দর, মেজরটিলা, শাহপরাণ ও দক্ষিণ সুরমার রেল স্টেশন এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার নিচু জায়গা প্লাবিত হয়। অনেক এলাকায় সড়কে হাঁটুপানি দেখা গেছে। সড়ক উপচে পানি ঢুকে পড়ে মানুষের বাসা-বাড়িতে। অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ঢুকে পড়ে পানি। এদিকে ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত পানি অনেকের বাসা-বাড়িতে ঢুকেছে।