নির্বাচনে কে কোন জোটে

13

কাজির বাজার ডেস্ক

এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ২১টি দলই আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিয়েছে। দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৪টি। নির্বাচনে এখন পর্যন্ত বিএনপি না এলেও দলটির সঙ্গে সরকার পতনের আন্দোলনে থাকা দুটি দলও নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচনে আসা রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে যে তথ্য দিয়েছে, তাতে এখন পর্যন্ত তিনটি নির্বাচনী জোট হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো হলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট, আর তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্বে হওয়া রাজনৈতিক জোট।
অন্যদিকে ঘোষণা না এলেও জাতীয় পার্টি ও বিকল্প ধারা বাংলাদেশের মধ্যেও আরেকটি জোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য জাতীয় পার্টির নেতারা বলেছেন, এবার তারা কোনো জোট করবেন না। ৩০০টি আসনেই একক প্রার্থী দেবে জাতীয় পার্টি। গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সিইসি জানান, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৭ জানুয়ারি।
তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ৩০ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর আর প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর। প্রচার শুরু হবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে, চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত।
১৪ দলীয় জোট : বর্তমানে ভোটের মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো জোট বলা যেতে পারে ১৪ দলীয় জোটকে। বিএনপি-জামায়াতকে প্রতিহত করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে ২০০৪ সালে গঠিত হয় রাজনৈতিক জোট কেন্দ্রীয় ১৪ দল। জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ। শুরু থেকেই এই জোটের সমন্বয়ক ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা মোহাম্মদ নাসিম। তাঁর মৃত্যুর পর এ দায়িত্ব পান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামÐলীর সদস্য আমির হোসেন আমু। মূলত তিনটি বিষয় মাথায় রেখে গঠন হয় ১৪ দল। এগুলো হলোÑজঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান; উন্নয়নমূলক কাজের ভিশন এবং সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান।
আওয়ামী লীগ ছাড়াও ১৪ দলে আছেÑজাতীয় পার্টি (জেপি), সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও তরিকত ফেডারেশন। ২০০৯ সালে এক-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর জোট মহাজোট ক্ষমতায় আসে। এ সময় ১৪ দলের শরিক দলগুলোর কয়েকজন নেতা মন্ত্রিসভায়ও স্থান পান। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও এ ধারা অব্যাহত ছিল। টানা দুই মেয়াদে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শরিক দলের কোনো নেতাই মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। একাদশ সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ১৭৫ জন। জোট শরিকদের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ৭ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৬ জন, তরীকত ফেডারেশনের ২ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ২ জন এবং বিএনএফের আছেন ১ জন সংসদ সদস্য। এ নিয়ে জোটনেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মতবিরোধ তৈরি হয়। জোটের অনেক নেতাই প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনাও করেন। অবশ্য বরফ গলতেও সময় লাগেনি। গত জুলাইয়ে জোটনেতারা আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে আসার ঘোষণা দেন। আগের মতো এবারও আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে নামবে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের প্রার্থীরা। আগামী শনিবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী চ‚ড়ান্ত করবে আওয়ামী লীগ। এরপরই জানা যাবে শরিকদের জন্য কতটি আসন ছাড়ছে তারা।
যুক্তফ্রন্ট : নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বড় চমক হয়ে ধরা দিয়েছে কল্যাণ পার্টির নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। এই জোটে কল্যাণ পার্টির শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ।
কল্যাণ পার্টি দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপির সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত ছিল। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির মহাসমাবেশের দিন একই দাবিতে বিজয়নগর এলাকায় আলাদা সমাবেশও করেছে কল্যাণ পার্টি। তবে আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে গত বুধবার অন্য দুই শরিককে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয় দলটি।
২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময় আত্মপ্রকাশ করে কল্যাণ পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। যুক্তফ্রন্ট গঠনের আগে কল্যাণ পার্টি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে ছিল। পরে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) নেতৃত্বে হওয়া ১২ দলীয় জোটে যুক্ত হয়।
নতুন দলের জোট : কল্যাণ পার্টির মতোই চমক তৈরি করেছিল তৃণমূল বিএনপিও। ঘোষণা অনুযায়ী দলটি প্রগতিশীল ইসলামিক জোটকে সঙ্গে নিয়ে এবার প্রথমবারের মতো ভোটের মাঠে নামবে। তৃণমুল বিএনপির লক্ষ্য দ্বাদশ সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভ‚মিকায় যাওয়া। তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির সাবেক নেতা নাজমুল হুদা। তিনি ১৯৯১ ও ২০০১ সালে দুই দফায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তবে ২০১২ সালে তিনি বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বিএনএফ নামে নতুন একটি দল গঠন করেন। সেখান থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর, ২০১৫ সালে গঠন করেন তৃণমূল বিএনপি। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত এই দলের প্রতীক সোনালি আঁশ।
তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার দুজনই বিএনপির সাবেক নেতা। শমসের মবিন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন আমেরিকায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও। অবসরের পর ২০০৮ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। এর পরের বছরই দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মনোনিত হন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে শমসের মবিন হঠাৎ করেই বিএনপির রাজনীতি থেকে সরে আসেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে যোগ দিয়েছিলেন বিকল্প ধারা বাংলাদেশে। তিনি দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেব দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যদিকে তৈমুর আলম খন্দকার দীর্ঘসময় নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাও হন। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটির প্রথম নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। ২০২২ সালে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
আরও জোট : এই তিন জোট ছাড়াও জাতীয় পার্টি ও বিকল্পধারা নির্বাচন কমিশনে জোট করার কথা জানিয়েছে। নির্বাচন কমিশনে জোট করার কথা জানালেও জাতীয় পার্টি নেতারা বলছেন, এবার ৩০০ আসনেই একক প্রাথী দেবে দল। অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোট করার পরিকল্পনা না থাকার কথাও জানিয়েছে তারা।
নব্বইয়ের দশকে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে জোট করেছে দলটি। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠন করতে জাতীয় পার্টির সহায়তা নেয় আওয়ামী লীগ। সেই নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৪৬টি। জাতীয় পার্টি পায় ৩২টি এবং বিএনপির আসন ছিল ১১৬টি। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের দুই বছর আগে বিএনপি, জামায়াত এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে জোট গঠন করে এরশাদের জাতীয় পার্টি। ভোটের ঠিক আগমুহ‚র্তে জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায় দলটি। তবে দল ভেঙে একটি অংশ বিজেপি নামে থেকে যায় সেই জোটের সাথে।
২০০৭ সালে জাসদ, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম ও এলডিপির সাথে জাতীয় পার্টিকেও জোটে নেয় আওয়ামী লীগ। অবশ্য এই জোট টেকেনি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে বাদ পড়ে এলডিপি ও গণফোরাম। সে সময় জোটে জাতীয় পার্টিই ছিল আওয়ামী লীগের মূল শরিক। সেই নির্বাচনে মহাজোটের কাছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট কোনো পাত্তাই পায়নি। নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে এই জোট।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বর্জনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালে আরেক দফা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া আসনে ভোট করে জাতীয় পাটি। নির্বাচনের পর সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবেও মর্যাদা পায় দলটি। বিরোধী দলে থাকলেও দলটির বেশ কয়েকজন নেতা সেই সরকারে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ নিয়ে সে সময় দলটিকে নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
এরপর বহুবার জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের জোট থেকে বের হয়ে যেতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত জোটে থেকে যায়। ২০১৮ সালেও আওয়ামী লীগের সাথে অনেকটা সমঝোতা করেই নির্বাচনে আসে তারা। ওই নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হলে ২২টি আসন নিয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের স্থান ধরে রাখে জাতীয় পার্টি।
এরা ছাড়াও আসন্ন নির্বাচনে ইসলামপন্থী কয়েকটি দল জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বলে জানা গেছে।