দুর্নীতির লাগাম টানতেই হবে

36

 

বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন সরকারি কর্মকর্তারা। সরকারি প্রশাসনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে দুর্নীতি প্রবল আকারে ছড়িয়ে পড়েনি। গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশ থেকে মুদ্রাপাচারের ক্ষেত্রে একসময় রাজনীতিবিদদের প্রাধান্য থাকলেও বর্তমানে সবাইকে টপকে গেছেন দুর্নীতিবাজ আমলারা।
অভিযোগ আছে, এর পরও ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা তাঁদেরই তোষণ করে চলেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের এক রায়ে যথার্থই বলা হয়েছে যে রাষ্ট্রের পদমর্যাদাক্রমের (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) আওতাভুক্ত ব্যক্তিরা দুর্নীতিমুক্ত হলে বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত দেশ হতে বাধ্য। ‘মো. কামরুজ্জামান সরকার বনাম রাষ্ট্র ও অন্য’ শীর্ষক মামলার রায়ে এই অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর এই মামলার রায় দেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক বেঞ্চ।
৭৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
আমলাতন্ত্রের ঘুষ, দুর্নীতি ও অন্যান্য অনিয়ম আগেও ছিল, কিন্তু গত কয়েক দশকে তা যেন রকেটগতিতে এগিয়েছে। মানুষ মজা করে বলে, সরকারি দপ্তরের ইট-কাঠও নাকি এখন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের মাথা থেকে পা পর্যন্ত পচন ধরেছে।
উল্লেখ পাওয়া যায়, কোনো ব্যক্তি ২৭ বছরের কর্মজীবনে বেতন পেয়েছেন মোট ২৫ লাখ টাকা, অথচ সম্পদ গড়েছেন শতকোটি টাকার। এই অবস্থা সম্ভব হয়েছে মাথায় পচন ধরার কারণে। আদালত বলেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের আওতাভুক্ত ব্যক্তিরা যদি দুর্নীতিমুক্ত হন, তাহলে কোনো ব্যক্তির পক্ষে দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। সুতরাং বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমের আওতাভুক্ত ব্যক্তিদের দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।’ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, কমিশন শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শ্রম, মেধা ও অর্থ ব্যয় না করে পাঁচ-দশ হাজার টাকার দুর্নীতির পেছনে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করছে।
রায়ে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদকে একগুচ্ছ পরামর্শও দেওয়া হয়। সেখানে দুদকের জন্য একটি স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস গঠন করে তার মাধ্যমে কর্মকর্তা নিয়োগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন নিয়োগ বোর্ড গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। একসময় সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে যোগদানের আগে তাঁদের সম্পদের বিবরণ প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। পরে তা তুলে দেওয়া হয়। সেটি আবার বাধ্যতামূলক করার কথাও বলা হয়েছে। দুদকের কর্মকাÐে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে কমিশনের চেয়ারম্যান এবং হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি থেকে সদস্য নির্বাচন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালতে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজীবীদের সমন্বয়ে আলাদা প্রসিকিউশন প্যানেল গঠনের পরামর্শ দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, তিন বছর পর পর এসব প্যানেল পুনর্গঠন করতে হবে এবং আইনজীবীকে উপযুক্ত সম্মানী ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে হবে।
বিজ্ঞজনরা বলেন, কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না, যদি দুর্নীতি এভাবে সর্বগ্রাসী রূপ নিতে থাকে। সে কারণে দুর্নীতির লাগাম টানতেই হবে। আমরা মনে করি, হাইকোর্টের রায়ে প্রদত্ত পরামর্শগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।