বিরতিহীন কর্মসূচিতে যাচ্ছে বিএনপি বিজয় না হওয়া পর্যন্ত ‘একদফা’র আন্দোলন চলতেই থাকবে

16

 

কাজির বাজার ডেস্ক

এবার আর ব্যর্থ হতে চায় না বিএনপি। ২০১৫ সালে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচিতে সফলতা না পেলেও এবার সফল হতে চায় দলটি। এবার আগের মতো অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা না দিলেও, বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত টানা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। আগামী ১২ নভেম্বর থেকে তাদের টানা কর্মসূচি শুরু হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ পÐ হওয়ার পর একদিনের হরতাল এবং তিনদিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। আজ রোববার থেকে আবারও শুরু হচ্ছে ৪৮ ঘণ্টার সারাদেশে সড়ক, রেল ও নৌ পথে সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি।
বিএনপির নীতি-নির্ধারণী ফোরামের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার পতনের এক দফার চ‚ড়ান্ত আন্দোলনে এবার টানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। মঙ্গলবার একদিনের বিরতি দিয়ে বুধ ও বৃহস্পতিবার আবারও অবরোধের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে পরের সপ্তাহ থেকে কোনো বিরতি না দিয়ে টানা অবরোধে যাওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিজয় না হওয়া পর্যন্ত ‘একদফা’র আন্দোলন চলতেই থাকবে। আগামীকাল রোববার সকাল থেকে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শান্তিপূর্ণভাবেই পালিত হবে। দলের নেতাকর্মী বা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও সমমনা প্রত্যেকেই সরকারের কোনো উস্কানির মুখে পা না দিয়ে কর্মসূচি পালন করে যাবেন।
দলটির নেতাকর্মীরা জানান, ২৮ অক্টোবর তাদের সমাবেশে হামলা, সংঘর্ষ এবং পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যই তারা সেদিন সবচেয়ে বড় গণজমায়েত করেছিলেন। সংঘর্ষের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান, গ্রেপ্তার, মামলা, হয়রানির মধ্যে শুরুতেই তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। গ্রেপ্তার এড়াতে বাসা-বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় বের করতেই তাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এখনো তারা কেউ নিরাপদ নয়, তবে প্রথমদিকের ধাক্কাটা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। এবার সংগঠিতভাবে মাঠে নামার জন্য তারা সব রকমের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
দলটির মধ্যম সারির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাসমাবেশের পরের দিনই রাজপথের কঠোর আন্দোলনের জন্য তাদের কোনো পূর্ব-পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি ছিল না। সেদিন তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক নেতাকর্মী আহতের পাশাপাশি বেশিসংখ্যক গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনায় তারা এবার নিজেদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছেন। বিচ্ছিন্ন থাকা নেতাকর্মীদের আবারও এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া তারা শেষ করেছেন। এবার রাজপথে সংঘবদ্ধ শক্তি নিয়ে তারা নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিএনপি সূত্র মতে, একদফা দাবিতে চ‚ড়ান্ত ধাপের আন্দোলনের শুরুতে ঢাকায় মহাসমাবেশকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় উ™‚¢ত পরিস্থিতিতে নানামুখী চাপে পড়েছে বিএনপি। তালাবদ্ধ দলীয় কার্যালয়, চলছে গণগ্রেপ্তার। নেতাকর্মীরা পলাতক অবস্থায় রয়েছে। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সর্বত্র নেতাকর্মীদের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে। পুরো দল কার্যত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। যদিও সংঘর্ষের ঘটনার পর যে ‘ক্র্যাকডাউন’ চলছে এবং এটা যে কঠোর হবে, এ ব্যাপারে বিএনপির ধারণা ছিল। তবে এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও আশা দেখছে বিএনপি। দলটির দাবি, জনগণের সমর্থনে হরতাল এবং সদ্য শেষ হওয়া অবরোধ কর্মসূচি সফলভাবে পালিত হয়েছে। যা দাবি আদায়ে বিএনপিকে টানা কর্মসূচি দিতে অনুপ্রাণিত করছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলন সফল হবে- সেই আশা থেকে আগামীকাল রোববার সকাল থেকে দেশব্যাপী ফের টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে দলটি। এই কর্মসূচি আরও কঠোরভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকমান্ড। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই অবরোধ আরও বাড়বে। তবে বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে আগামী ৭ নভেম্বর (মঙ্গলবার) কোনো কর্মসূচি থাকছে না। এরপর বুধ ও বৃহস্পতিবার ফের হরতাল কিংবা অবরোধের কর্মসূচি আসতে পারে। এই কর্মসূচি আগামী সপ্তাহেও গড়াতে পারে। তখন সপ্তাহজুড়ে টানা অবরোধের ডাক দেওয়া হতে পারে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই চলমান আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছাতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, গত কয়েকদিনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মজিবুর রহমান সরোয়ার, ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হকসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তারের পরিপ্রেক্ষিতে উ™‚¢ত পরিস্থিতিতে দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে এখন আন্দোলনের সার্বিক বিষয় মনিটরিং করা হচ্ছে। ফলে শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গ্রেপ্তার হলেও চলমান আন্দোলনে কোনো ছন্দপতন হবে না বলে দাবি বিএনপি নেতাদের। দলটির তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ১১টি মামলায় ১০৪৫ জনের অধিক নেতাকর্মীকে (এজাহার নামীয়সহ অজ্ঞাত) আসামি এবং ২৯২ জনের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ এবং মহাসমাবেশের পর হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে ১০৭টির অধিক মামলায় ৪ হাজার ৮৪৭ জনের অধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার, ৩ হাজার ৪৭৬ জনের অধিক নেতাকর্মী আহত এবং ১ জন সাংবাদিকসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর গত ২৮ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপির কর্মসূচিকে ঘিরে ৫০০টির অধিক মামলায় ৩৭ হাজার ৯৮৫ জন আসামি, ৭ হাজার ৫৩৭ জন গ্রেপ্তার, ৫ হাজার ৭৬৯ জনের অধিক নেতাকর্মী আহত এবং একজন সাংবাদিকসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে ১৭টি মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদÐাদেশ এবং ১১১ জনের অধিক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদÐ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, উ™‚¢ত পরিস্থিতিতে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে নেতাকর্মীদের সর্বতোভাবে গ্রেপ্তার এড়িয়ে কর্মসূচি সফলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারপরও যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন, তাদের স্থলে কমিটির পরবর্তী জনকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতেও দলের ‘চেইন অব কমান্ড’ ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে মহাসমাবেশকে ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, সেটাকে আন্দোলনের পথে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটির দাবি, সহিংসতার ঘটনায় বিএনপিকে জড়ানোর চেষ্টা হলেও প্রকৃত ঘটনা বিদেশিরা ক্রমেই জেনে গেছে। বিএনপির মহাসমাবেশে হামলার ঘটনায় সরকার ও পুলিশকে দায়ী করে গত সোমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ঢাকাস্থ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে দলটি। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশে আগামীতে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় বলে বিভিন্ন সময় জানিয়েছে। বিএনপির অভিযোগ, তাদেরকে বাইরে রেখে আবারও একটি একতরফা নির্বাচনের পাঁয়তারা করছে সরকার। তবে এবার এমন নির্বাচন হলে সেটিকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব অনুমোদন দেবে না বলে দাবি দলটির নেতাদের।
আন্দোলনের বিষয়ে দলের পরবর্তী অবস্থান নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর আব্দুল মঈন খান বলেন, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অটল আছেন। দাবি আদায়ে নেতাকর্মীরা রাজপথে ছিলেন এবং থাকবেন। জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার করে এ দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে নস্যাৎ করা যাবে না।