কাজির বাজার ডেস্ক
নির্বাচনকালীন ‘রাজনৈতিক মামলায়’ প্রার্থীর এজেন্টেরদের গ্রেপ্তার চান না প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, এতে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আমরা কলঙ্কিত হবো। তাই বারবার সরকারকে এটি জানাবো, যদি তাদের অ্যারেস্ট (গ্রেফতার) করতে হয় ছ’মাস আগেই করে ফেলেন, নয়তো নির্বাচনের পরে অ্যারেস্ট করেন। বুধবার নির্বাচন ভবনে আয়োজিত এক কর্মশালায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব মন্তব্য করেন। আগে থেকেই পোলিং এজেন্টদের তালিকা প্রার্থীর কাছ থেকে নেওয়ার প্রসঙ্গে সাবেক এ বিচারক বলেন, পোলিং এজেন্টের নাম প্রার্থীরা সাধারণত গোপন রাখেন। সকালবেলা দেওয়া হয়, যাতে তারা নিরাপদে ওখানে পৌঁছাতে পারেন। আমাদের কাছে তারা একশজনের তালিকা দেবেন, দেড়শ জনের নাম দিলেন। দিলে পরে যদি আমরা দেখি দেড়শজনই অ্যারেস্ট হয়ে গেছেন তখন আমাদের একটি নেগেটিভ ইমপ্রেশন নিতে হবে। কেন তারা একমাস আগে অ্যারেস্ট হলেন না। কেন তারা দু’মাস আগে অ্যারেস্ট হলেন না। ভোটের আগের দিনই সবাই উধাও হয়ে গেল কেন। যেহেতু আমরা নির্বাচন করি, আমরা সৎভাবে করতে চাচ্ছি, আন্তরিকভাবে করতে চাচ্ছি। কোনো দলের পক্ষপাতিত্ব করার জন্য কিন্তু আমরা এ দায়িত্ব গ্রহণ করিনি।
তিনি আরও বলেন, এটিও হতে পারে একটি লিস্ট যদি আগেই দেওয়া হলো আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দেবো। এরপর যদি সবাই পটাপট অ্যারেস্ট হতে থাকলো, যে ১৫০ জন আছে এরমধ্যে ১৪০ জনই অ্যারেস্ট গেছে, তখন এটিই সুনির্দিষ্টভাবে বুঝাবে, যে তাদের অ্যারেস্ট করা হয়েছে বিশেষ একটা উদ্দেশে। আমরা ওই ক্ষেত্রেটিকেই কখনো চাই না। আমরা আশা করবো, আমরা বারবার সরকারকে এটি জানাবো, যদি তাদের অ্যারেস্ট করতে হয় ছ’মাস আগেই অ্যারেস্ট করে ফেলেন সবাইকে। নয়তো নির্বাচনের পরে গিয়ে অ্যারেস্ট করেন। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত হবে না। আামরাও কলঙ্কিত হবো সেই ক্ষেত্রে, এটি আমি আন্তরিকভাবে মনে করি। এটিই সবাই বলবেন, পোলিং এজেন্ট যদি না থাকে, নির্বাচন তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে নেতিবাচক জনমত তৈরি হবে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, অভিযোগগুলো আসে একজন শক্তিশালী প্রার্থী দুর্বল প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়। বের করে দিলে তারা যদি আগে থেকে তালিকাভুক্ত এজেন্ট হয়ে থাকে, প্রিসাইডিং অফিসারকে বিষয়টি জানাতে হবে। প্রিসাইডিং অফিসার শতশত সাংবাদিক দাঁড়িয়ে থাকে, আমরা নির্বাচনকে চিত্র ধারণ করে ট্রান্সপারেন্ট করতে পারি। আমাদের দায়িত্বটা খুব কম। আমরা দেখতে চাই ভোটাররা আসছে, তারা লাইনে দাঁড়িয়েছে। আবার তারা বেরিয়ে আসছে। সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করবে ভোট দিতে পেরেছেন? আবার একটি প্রশ্ন আসতে পারে-কিসের ভোট, ভেতরে তো ভোটই নেই। সেই জিনিসটাই আমরা সবাইকে বলতে চাইবো ভোটটা ভোটকেন্দ্রে হয়। প্রতিটি ভোটকেন্দ্র যদি শুদ্ধ হয়, তাহলে ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্র শুদ্ধ হবে, সে বিষয়টি আমরা মাথায় রাখতে চাই।
সিইসি বলেন, নির্বাচনি কালচারের অপরিহার্য অংশ হচ্ছে কারচুপি। এটি কোথায় হয় কিভাবে হয় আমরা কিন্তু অভিজ্ঞ ব্যক্তি নই। অনেকে বলেন ভোটকেন্দ্রের ভেতরে হয়, যদি ভোটকেন্দ্রের ভেতরে হয় আমরা জানতাম সেখানে একজন পোলিং এজেন্ট থাকে। যেমন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কিন্তু একজনের পক্ষ নিতে পারে। তাই বলে আমার মা যদি আমাকে ইয়ে করে, তাহলে কী আমি আমরা মায়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবো? তাতে করবো না।
যদি পোলিং এজেন্টরা শক্ত অবস্থান নেন, তাহলে নির্বাচনে কারচুপি করা কতটা সহজ আমি অনেকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, অনেকে বলেছেন কারচুপি করা খুবই ডিফিকাল্ট। কারণ পোলিং এজেন্টকে যে শিক্ষা দেওয়া হয় সেখানে সেনাপ্রধান বা পুলিশের আইজি সাহেবও যদি সেখানে আসেন, উনি তো ভোটার নন, পোলিং এজেন্ট যদি এটি জানেন, উনার নলেজটা যদি থাকে, আর সে যদি দৃষ্টি রাখে ভোটের কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি-না, সঙ্গে সঙ্গে যদি প্রিসাইডিং অফিসারকে অবহিত করেন। আবার পোলিং নিজেও দুষ্ট হতে পারেন। এটি একটি উভয় সংকট। আমরা ভাবছিলাম যদি প্রতিদ্বি›িদ্বতামূলক নির্বাচন হয়, সেখানে যদি প্রকৃত প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী তাদের দক্ষ, সাহসী এবং বলিষ্ঠ পোলিং এজেন্ট নিয়োজিত করতে পারেন, তারাই যদি চারিদিকে দৃষ্টি রাখে, তাহলে ওই কারচুপিগুলো রোধে সহায়ক হতে পারে। এটি কিভাবে ব্যালেন্স করা যেতে পারে আমরা এ নিয়ে চিন্তা করবো যে কিভাবে পোলিং এজেন্টের রোলকে নির্বাচনমুখী করা যায়।
তিনি আরও বলেন, যেখানেই অনাচার হয় প্রিসাইডিং অফিসারকে জানাতে হবে। তখন তাকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য আমরা কিন্তু প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সম্প্রতি একটি আইনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছি। কোনো অনিয়ম হলে প্রিসাইডিং অফিসার প্রতিহত করবেন, নিজে না পারলে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশকে বলবে, তারা ভোটের অনুক‚ল পরিবেশ প্রতিস্থাপন করবে। তারা যদি প্রবল পেশিশক্তির কারণে না পারেন তাহলে ভোটবন্ধ করে ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসবেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা।
সিইসি বলেন, আমাদের দায়িত্ব খুব কম, যদি ইলেকশনটা ইফেক্টিভলি কনটেস্টেন্ড হয়। অনেকে যেটি বলছে পাার্টিসিপেটরি, কেউ ব্যবহার করছেন ইনক্লুসিভ। এটি আমি একটু কনফিউশনে পড়ে গেছি, যে ইনক্লুসিভের অর্থ কী, পার্টিসিপেটরি অর্থ কী। পার্টিসিপেটরি অর্থ আমি যেটি বুঝেছি ব্যাপক ভোটার যদি এসে ভোটদান করেন। কে এলো, এলো না সেটা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাবো না। জেনুইন টার্নআউট হয়েছে সেভেনটি পারসেন্ট, তারপরে যদি কনটেস্টেন্ড হয়, এক্ষেত্রে আমাদের কেবল অল্প একটু রেফারির ভ‚মিকা থাকবে। কনটেস্ট হবে পার্টিগুলোর মধ্যে। ওরাই ওদের অবস্থান সুদৃঢ় রাখবে। সেক্ষেত্রে আমরা বিশ্বাস করি ইফেক্টিভ কনটেস্ট হলে ভোটকেন্দ্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। আমাদের দায়িত্বটা অনেক কমে যায়। সেজন্য আমরা ইনক্লুসিভ নির্বাচন লাইক করি। আমাদের দায়িত্ব না কাউকে নিয়ে আসা। তবু আমরাও আমাদের নৈতিক অবস্থা থেকে অনেকবার দাওয়াত দিয়েছি। আসুন, আমাদের সঙ্গে চা খান। ডিও লেটার পর্যন্ত লিখেছি। এর বেশি আমরা আর কিছু করতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের যদি ওয়ান পারসেন্ট ভোট পড়ে, টোটাল, নিরানব্বই পারসেন্ট ভোট না পড়ে লিগ্যালি দ্যাট ইজ ভেলিড। হয়তো কোশ্চেন অফ লেজিটিমিসি এরাইজ করবো, কোশ্চেন অব লিগেলিটি নট উ্ইল এরাইজ। আমরা লেজিটিমিসি নিয়ে মাথা ঘামাবো না। এটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ফাইট করবো। নির্বাচন কমিশন এটি নিয়ে ফাইট করবে না। আমরা দেখবো ভোট অবাধ, নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এক শতাংশ লোক ভোট দিলে আমরা যদি দেখি তারা ভোট দিতে এসেছেন তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন, নির্বিঘেœ প্রয়োগ করেছেন, স্বাধীনভাবেই প্রয়োগ করেছেন, তাহলেই কিন্তু…। সংলাপের মাধ্যমে একটি অনুক‚ল পরিবেশ যদি গড়ে ওঠে আমাদের জন্য নির্বাচনটা সহজ হতো। সিভিল সোসাইটিও পলিটিক্যালি ডিভাইডেড। আশাকরি ভবিষ্যতে এটি থাকবে না।
কর্মশালায় অন্য নির্বাচন কমিশনার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার, সাবেক নির্বাচন কমিশন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।