চা বাগান অধ্যুষিত চুনারুঘাট-মাধবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত হবিগঞ্জ-৪ আসন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী তিন হেভিওয়েট প্রার্থী। ভোটের মাঠে তারা সবাই সরব। যোগাযোগ রাখছেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ে। এলাকায় চাইছেন জনসমর্থনও।
বর্তমান এমপি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এলাকায় বিভেদের কারণে কিছুটা কোণঠাসা। এই সুযোগ কাজে লাগাতে চান চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক পিপি আকবর হোসেইন জিতু ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। তারা সবাই মনে করছেন আওয়ামী লীগের এই দুর্গে নৌকা প্রতীক পেলেই জয় নিশ্চিত। এদিকে নীরবে কাজ করছে বিএনপি-জামায়াত। আর জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জামায়াত-বিএনপি বা জাপা থেকে প্রকাশ্যে কোনো প্রার্থী মাঠে নেই। তবে অনেকটা গোপনে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরেজমিন নির্বাচনী এলাকা চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলা ঘুরে জানা যায়, বর্তমান এমপি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এই আসনে ফের মনোনয়ন চাইবেন। তিনি গত দু’বারের এমপি। যদিও ব্যক্তিগতভাবে সজ্জন হিসেবে পরিচিত এই নেতার এলাকায় কাজ কম। আসেনও কম। তবে নির্বাচন সামনে রেখে তিনি ঘন ঘন এলাকায় এসে ভোটারদের কাছে ভোট চাইছেন। গত মেয়াদে তিনি ঢাকায় আইন পেশা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এলাকায় তেমন সময় দেননি বলে অভিযোগ ভোটারদের। এবার প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় এলাকাবাসী নানা স্বপ্ন দেখলেও কার্যত কাঙ্খিত উন্নয়নের দেখা তারা পাননি।
তবে তার সমর্থকরা মনে করেন, এলাকার তৃণমূল মানুষের সঙ্গে মাহবুব আলীর নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। মনোনয়ন ও জয়ের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী। তিনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। সে কারণে গত দুবার যেভাবে নির্বাচনী প্রচার করে পার হয়েছেন, আগামীতেও পার হবেন।
তার পাশাপাশি এই আসনে গত দুবারই মনোনয়ন চেয়েছেন সাবেক ছাত্র ও যুবলীগ নেতা ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এবারও চাইবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় এই নেতা এলাকায় ক্রীড়া কর্মসূচিসহ নানা সামাজিক কাজ করছেন। নিজ অর্থায়নে এলাকায় ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করেছেন। বিতরণ করছেন আম গাছের চারা। কেউ বিপদে পড়লে এগিয়ে যাওয়ায় তার প্রস্তুতি আছে বেশ। এলাকা ঘুরে তার প্রমাণও মেলে।
স্থানীয়রা বলছেন, ব্যারিস্টার সুমন দুই দলের বাইরে স্বতন্ত্র দাঁড়ালেও বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। মন্ত্রী মাহবুব আলীর সরকারি কাজে ব্যস্ততা বা অনেকটা নীরবতায় তিনি এলাকায় সে অবস্থানটা করে নিয়েছেন।
মনোনয়নের বিষয়ে ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমি গত দুবার মনোনয়ন চেয়েছি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অনেক দিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি। আমাকে মনোনয়ন দিলে লোকজন এটা মনে করে যে, সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হব। এবারও মনোনয়ন চাইব। না পেলেও নৌকার প্রার্থীকে জয়ী করতে কাজ করে যাব।
চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক পিপি আকবর হোসেইন জিতুও মনোনয়ন চাইবেন এই আসনে। তিনি মাঠে থেকে কাজ করছেন। নেতাকর্মীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। তিনি বলেন, এই আসনে মনোনয়নে আমি হকদার। ২০০১ সাল থেকে মনোনয়ন চাই। তখন নেত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদকে মনোনয়ন আর আমাকে চিঠি দিয়ে সান্তনা দিয়েছেন। বলেছেন, ভবিষ্যতে আপনাকে মূল্যায়ন করা হবে। সেই ২০০১ থেকে সংসদ নির্বাচনে আমি মনোনয়ন চেয়ে আসছি। এবার আশা করি পাব। নেতাকর্মীরা আমাকে এমপি দেখতে চায়।
আকবর হোসেইন জিতু আরও বলেন, এই আসনে যিনি এখন এমপি ও প্রতিমন্ত্রী তার সম্পর্কে আমি বলব কেন, আপনি জরিপ নিয়ে দেখেন- তার অবস্থান কোথায়? মাধবপুর উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা এবং চুনারুঘাট উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন একটি পৌরসভা। প্রত্যেক ইউনিয়নের সভাপতি-সম্পাদককে জিজ্ঞেস করে দেখেন, সবাই আমার কথা বলবে।
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন চৌধুরী অসীমও মনোনয়ন চাইবেন এই আসনে। জনসেবাতে ডুবে থাকতেই পছন্দ করেন তিনি। সাধারণ মানুষের কাছে রয়েছে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিটি জনবান্ধব পদক্ষেপ আর উন্নয়নের বার্তা জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াই যেন তার কাজ। এ জন্য এলাকায় তার জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।
এ আসনটিতে স্বাধীনতার পর দুবার জাতীয় পার্টির এমপি ছিল। পরে আওয়ামী লীগের হাতে এলে আর হাতছাড়া হয়নি। ১৯৯১ থেকে চারবারের এমপি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও প্রয়াত সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ। তার মৃত্যুর পর বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী গত দুবারের এমপি। ভোটের হিসাবে এখানে সবসময় আওয়ামী লীগ এগিয়ে, বিএনপি ৪০ শতাংশ ভোট পেলে আওয়ামী লীগ পায় ৫০ শতাংশ।
চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৪২ নম্বর আসন হবিগঞ্জ-৪। এতে মোট ভোটার ৪ লাখ ২৭ হাজার ৫২৫। পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১৩ হাজার ২৯৪ ও নারী ভোটার ২ লাখ ১৪ হাজার ২৩১।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৮) আওয়ামী লীগের মাহবুব আলী পান ৩ লাখ ৮ হাজার ৭২৭ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট শরিক খেলাফত মজলিশ মহাসচিব আহমেদ আব্দুল কাদের ৪৬ হাজার ১৮৩ ভোট পান।
১০ম সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) আওয়ামী লীগের মাহবুব আলী নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ২২ হাজার ৪৩৩ ভোট পান। নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ তানভীর আহমেদ তালা প্রতীকে পান ১৪ হাজার ৭৬০ ভোট। ৯ম সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) আওয়ামী লীগের এনামুল হক (মোস্তফা শহীদ) নৌকা প্রতীকে পান ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৯৬ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপির সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সাল ধানের শীষ প্রতীকে পান ১ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৮ ভোট।
৮ম সংসদ নির্বাচনে (২০০১) আওয়ামী লীগের এনামুল হক (মোস্তফা শহীদ) নৌকা প্রতীকে পান ১ লাখ ৭ হাজার ৩৭৬ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপির সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সাল ধানের শীষ প্রতীকে পান ৯৩ হাজার ৩১ ভোট। ৭ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) আওয়ামী লীগের এনামুল হক (মোস্তফা শহীদ) নৌকা প্রতীকে ৭০ হাজার ২৪০ ভোট পান। বিএনপির সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সাল ধানের শীষ প্রতীকে পান ৫৯ হাজার ৬৬৬ ভোট। ৫ম সংসদ নির্বাচন (১৯৯১) আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনামুল হক (মোস্তফা শহীদ) নৌকা প্রতীকে পান ৬৭ হাজার ৮৪৭ ভোট। তার নিকটতম বিএনপির সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সাল পান ৫১ হাজার ৬৯৪ ভোট।
এবারও এই আসনে নৌকার বিজয় হবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, এটি বরাবরই নৌকার ঘাঁটি। যেই নৌকা পাক, জিতবে। কারণ এলাকাটি চা বাগান অধ্যুষিত। চুনারুঘাটে ১৮টি বাগান, মাধবপুরে পাঁচটি। এসব বাগানের চা শ্রমিকরা একচেটিয়া নৌকায় ভোট দেন। তবে মাধবপুরে বিএনপির আধিক্য আছে। সেখানে সায়হাম গ্রæপের মালিক সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সাল নাগরিকদের বিভিন্ন সুবিধা দেন। সেজন্য তারা তার পক্ষে ভোট দেন। তবে তিনি নির্বাচন করবেন কি না সুষ্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।