অসহনীয় তাপ কমাতে সবুজের সমারোহ বাড়াতে হবে

2

দেশ এখন যেন আগুনে পুড়ছে। একদিকে খরা, তাপপ্রবাহ, আরেক দিকে জিনিসপত্রের লাগামছাড়া দাম। শহর-নগর-গ্রামে উত্তাপ, বাজারেও উত্তাপ। এ এক অসহনীয় পরিস্থিতি। সৌদি আরব, দুবাই, কাতার বা আরব দেশের শহরগুলোর তাপমাত্রা যখন ২৬ থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তখন ঢাকার তাপমাত্রা উঠেছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওদিকে চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা টানা কয়েক দিন ধরে প্রায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাশাপাশি বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় গরমের আঁচ আরও বেশি অনুভ‚ত হচ্ছে। আমরা যেন নরককুÐে বসবাস করছি। যদিও ঈদের দু-তিন দিন আবহাওয়া খানিকটা ঠান্ডা ছিল। কিন্তু তাপমাত্রা আবারও বাড়তে শুরু করেছে।
বৈশাখে প্রকৃতি তপ্ত হয়। এটা আবহমানকাল ধরেই হচ্ছে। কিন্তু দিন দিন তা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কয়েক দিন ধরে ঢাকা ও রাজশাহীর অধিবাসীরা রীতিমতো মরুভ‚মির মতো লু হাওয়ার অনুভ‚তি পাচ্ছে। এতে করে খেটে খাওয়া মানুষ সীমাহীন কষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। পৃথিবীজুড়েই উষ্ণায়নের যে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছিল, সেটাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দেশের মানুষ। কয়েক বছর ধরেই দেশের মেগাসিটিগুলোতে উত্তাপের বহর বাড়ছিল হু হু করে। ঘরবন্দী হয়ে থাকার সুযোগ কিছু ভাগ্যবান মানুষের কপালে জুটলেও বেশির ভাগ গরিব-মধ্যবিত্ত কিংবা দিন আনি দিন খাই ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষের জন্য তা আকাশ-কুসুম কল্পনা।
প্রশ্ন হলো, কেন এই অসহনীয় তাপমাত্রা? কেন ক্রমেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে আমাদের প্রিয় রাজধানী? ইতিমধ্যে স্বীকৃত যে জলবায়ুর এই বিষম গতি বাড়ছে বিকৃত এবং দ্রæত নগরায়ণের ফলে উষ্ণায়নের হাত ধরে। এখন দেশের ৩ শতাংশ জায়গাজুড়ে থাকা শহর-শহরতলি এলাকায় থাকে দেশের ৩৫ শতাংশ মানুষ, যারা তৈরি করছে দেশের ৬৩ শতাংশ সম্পদ। ভৌগোলিক মাপের নিরিখে নগরায়ণের বিপদের উৎসস্থল মাত্র শহুরে ৩ শতাংশ এলাকায় হলেও পরিবেশ দূষিত হয়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে শহরের সীমা ছাড়িয়ে জেলা-গ্রামগঞ্জÑসর্বত্র। যত মানুষ ঢাকামুখী হয়েছে, তত চাপ বেড়েছে তার পরিবেশের ওপর। অল্প জায়গায় অনেক মানুষের মাথা গোঁজার লক্ষ্যে নির্মাণ করা হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা।
সবুজ ধ্বংস করে কিংবা জলা-জমি বুজিয়ে নির্মাণও চলছে তরতরিয়ে। বহুতল ভবনের উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে বাড়ির দেয়ালের মোট ক্ষেত্রফল বাড়ছে শহরজুড়ে। ফলে উত্তপ্ত সেই দেয়ালজুড়ে বাড়ছে তাপের প্রতিফলন এবং প্রতিসরণ। এখন চুন-সুরকির দেয়াল কিংবা খড়খড়ি দেওয়া জানালার দিন শেষ। এখন কংক্রিট, স্টিল, কাচ, অ্যালুমিনিয়ামের রাজত্ব। ফলে নতুন নির্মাণের ধাক্কায় নতুন প্রযুক্তির প্রভাবে তাপের ঘনঘটা বেড়ে চলছে শহরজুড়ে। বাড়ছে বাড়ির ঘনত্ব, পিচঢালা রাস্তার পরিমাণ, কংক্রিট আর ইস্পাতে তৈরি উড়ালসেতু। পিচের কালো রাস্তা কিংবা সাদা সিমেন্ট কংক্রিট কাঠামো, এরা আমাদের বায়ুমÐলের তাপ শুষে নিয়ে নিজেরা আরও বেশি তেতে ওঠে। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যখন ৪০ ডিগ্রি, তখন তেতে ওঠা নির্মাণকাঠামোর উষ্ণতা তার দেড় থেকে দুই গুণ বেশি। সেই তেতে থাকা নির্মাণকাঠামোয় জমে থাকা তাপ বেরিয়ে স্বাভাবিক হতে লাগে দীর্ঘ সময়। তাই কেবল দিনের বেলায় সূর্যের তেজে দহন নয়, দহনজ্বালা বজায় থাকে রাতেও। এমন বিষম নির্মাণকাঠামো বৃদ্ধির জন্য আটকে যাচ্ছে শহরজুড়ে বায়ু চলাচলের স্বাভাবিক গতিপথ। অবরুদ্ধ হচ্ছে উত্তুরে কিংবা দখিনা বাতাস। উচ্চবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তের ঘরে ঢুকে পড়েছে এসির বাক্স। ঘর সাময়িক ঠান্ডা হচ্ছে বটে, কিন্তু সেই মেশিনের গরম হাওয়ার ঝাপটা আছড়ে পড়ছে ঘরের বাইরে, শহরজুড়েই। শহরগুলো এখন তাপরুদ্ধ দ্বীপের মতো।
এতকাল ছিল গ্রীষ্মকালে আর্দ্রতার বিপদ। এবার তাতে যোগ হচ্ছে তাপপ্রবাহের বিপদ। নগরায়ণের নিয়ন্ত্রণ না এলে এই বিপদ এড়ানো অসম্ভব। এই অস্বাভাবিক ও অসহনীয় গরমে মানুষ যে কেবল কষ্ট পাচ্ছে তা-ই নয়, এর ফলে আরও নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি যা কমছে তা হলো, মানুষের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা।।
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। নদী-খাল-বিল উদ্ধার ও খনন করতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ব্যস্ত আছেন সব মেগা প্রকল্প আর উন্নয়নের ধারাপাত শোনানো নিয়ে। দেশ তাপে পুড়ুক, দেশের মানুষ গোল্লায় যাক, তাতে কার কী?
এই রাত রোধে পরিকল্পিত নগরায়ণে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। নগরে আনাচে কানাচে সবুজের সমারোহ আরো বাড়াতে হবে। গাছ লাগাতে উদ্ভুদ্ধ হতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।