দেশের মানুষ তাঁকে মনে রাখবে

19

চলে গেলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। দীর্ঘদিন থেকেই নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি। কিছুদিন ধরে হাসপাতালে ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। কভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর লিভারেও সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া তিনি অপুষ্টিসহ সেপটিসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে তাঁর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
ডা. জাফরুল্লাহর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পড়াশোনা বাদ রেখে দেশের টানে ছুটে আসেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আগরতলা সীমান্তের বিশ্রামগঞ্জে মেলাঘর ক্যাম্পের পাশে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ফিল্ড হাসপাতাল হাজার হাজার আহত মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়েছে এবং জীবন বাঁচিয়েছে। স্বাধীনতার পর মেলাঘরের সেই ফিল্ড হাসপাতালকে ঢাকার ইস্কাটনে নিয়ে আসেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী, পরে গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘চল গ্রামে যাই’ সেøাগান নিয়ে হাসপাতালটি সাভারে স্থানান্তরিত হয়। তখন এর নামকরণ হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। নারীর ক্ষমতায়নে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রায় অর্ধেক কর্মী নেওয়া হয়েছিল নারীদের মধ্য থেকে। পরবর্তী সময়ে সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশে গ্রামীণ গরিব মানুষদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে সামাজিক চিকিৎসার মডেলে বেসরকারি বিকল্প উদ্যোগ ছিল এটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে স্নেহ করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর মহান সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু সেই সামাজিক উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে একে আরো কার্যকর করার জন্য ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ প্রকল্পটির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য সাভারে ৩১ একর জমি প্রদান করেন।
তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ছাত্রজীবনে। মেডিক্যাল কলেজে থাকতে চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শ পাওয়া জাফরুল্লাহ চৌধুরী রাজনৈতিক অঙ্গনেও নানা ভ‚মিকা রেখেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠেছিল তাঁর। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলোকে এক মঞ্চে এনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভ‚মিকা রেখেছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। নিজের সম্পর্কে বলতেন, তিনি মানুষের রাজনীতি করেন। ডা. জাফরুল্লাহর বড় অবদান ছিল জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়নে। জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবাকে আরো কার্যকর করার লক্ষ্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্কারমূলক ও নীতিনির্ধারণী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর ও প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলামের যৌথ প্রয়াসে দেশের বিশিষ্ট চিকিৎসা ও ওষুধবিজ্ঞানীদের নিয়ে প্রণীত জাতীয় ওষুধনীতি ১৯৮২ ছিল দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিদেশি বহুজাতিক ওষুধ কম্পানিগুলোকে হটিয়ে দেশীয় ওষুধশিল্পের আজকের শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণের পেছনে এই ওষুধনীতি ও এর প্রণেতাদের অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। ১১৭টি ওষুধ তাঁরা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা বিদেশি কম্পানিগুলো উৎপাদন করত। ওই সব ওষুধ বিদেশি কম্পানি নিজেদের দেশে তৈরি করতে পারত না। বিদেশি কম্পানিগুলো শুধু এ দেশে ওষুধের নামে বিষ তৈরি করত তা-ই নয়, সেগুলোর কাঁচামাল আমদানির জন্য বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যেত।