পর্যটন খাতের জটিলতা নিরসন

4

পৃথিবীতে পর্যটন খাতের আয় ২০১৯ সালে ছিল ১০ ট্রিলিয়ন বা ১০ লাখ কোটি মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে আয় অনেক কমে গিয়েছিল। ২০২১ সালে এক ট্রিলিয়ন ডলার বেড়ে আবার তা ৫.৮১ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৩ সালে আবার তা ১০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
অনেক দেশের মোট রাজস্ব আয়ের বেশির ভাগ আসে পর্যটন খাত থেকে। সেখানে বাংলাদেশের আয় কত? বছরে মাত্র ৩৩ কোটি ডলারের মতো। বিশ্বখ্যাত রেটিং সংস্থা মুন্ডি ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, পর্যটনশিল্পে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম। এশিয়ার ৪৬টি দেশের মধ্যেও বাংলাদেশ ৪২তম। ভারত তো বটেই, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও মিয়ানমারের মতো দেশগুলোও আমাদের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। কেন আমরা এভাবে পিছিয়ে আছি? এই খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ যেটুকু এগিয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে মূলত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের কারণে। খাতটিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা নেই বললেই চলে। উপরন্তু আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। তাঁদের মতে, পর্যটন খাতের উন্নয়নে সরকারকে মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অবশেষে সরকার সেই সত্যটি উপলব্ধি করেছে। পর্যটন খাতের সুপরিকল্পিত উন্নয়নে ৩০ বছর মেয়াদি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। চলতি ডিসেম্বরে মহাপরিকল্পনার খসড়া প্রণয়ন শেষ হবে এবং মার্চের মধ্যে তা চ‚ড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে। এতে দেশের এক হাজার ৫১টি গন্তব্যকে পর্যটন পণ্য হিসেবে উন্নয়নের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে যে পরিমাণ নদী রয়েছে পৃথিবীর খুব কম দেশেই তা আছে; কিন্তু নদীকেন্দ্রিক পর্যটনকে উপভোগ্য ও আকর্ষণীয় করতে বাস্তবে আমরা কিছুই করছি না। আমাদের রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, যা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। সুন্দরবনের একটি ক্ষুদ্র অংশ রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেখানকার পর্যটন থেকে পশ্চিমবঙ্গের যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়, তার সঙ্গে বাংলাদেশের আয়ের কোনো তুলনাই হয় না। অথচ বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবন নানা দিক থেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। আমাদের রয়েছে বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত, তারও যথাযথ সুবিধা আমরা নিতে পারছি না। আমাদের বিশাল সব হাওর রয়েছে। আছে বিস্তীর্ণ উপক‚ল, পাহাড়, বন, বরেন্দ্রভ‚মি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভ‚মি। পর্যটনে আমরা সেগুলো কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। গঙ্গাঋদ্ধি অঞ্চল হিসেবে খ্যাত এই অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ শতকেরও আগের সভ্যতার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গ্রিক, লাতিন ঐতিহাসিকদের রচনায়ও তার উল্লেখ রয়েছে। উয়ারী-বটেশ্বর (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০), মহাস্থানগড় (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক), অষ্টম শতাব্দীর পাহাড়পুর, ময়নামতিসহ আরো অনেক স্থান ও স্থাপনা রয়েছে, যেগুলো অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। ঐতিহ্যকেন্দ্রিক ভ্রমণের সুযোগকেও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। আছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ধর্মীয় পর্যটনেরও অনেক সুযোগ আছে; কিন্তু কোনো সুযোগকেই আমরা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারিনি।
আমরা আশা করি, দেশের পর্যটন খাতকে এগিয়ে নেওয়ার যে মহাপরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে, তার সুষ্ঠু ও সর্বাঙ্গীণ বাস্তবায়ন হবে। সেখানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যেন বাধার কারণ না হয় সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে।