সুনামগঞ্জে নির্ধারিত সময়ের আগেই শতাধিক বাঁধের কাজ সম্পন্ন, তাহিরপুর ও দিরাই উপজেলায় অনিয়মের অভিযোগ

43

সুনামগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
ঠিকাদারী প্রথা বাতিল করে হাওর পারের প্রকৃত কৃষক দিয়ে (পিআইসি) গঠন করে বাঁধের কাজ করায় নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রায় শতাধিক বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ সদর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার সবগুলো বাঁধের কাজই শেষ হয়েছে। কিন্তু বাঁধের কাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে দিরাই, শাল্লা ও তাহিরপুর উপজেলায়। এ পর্যন্ত সম্পাদিত বাঁধগুলো হল দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের দেখার হাওরের ৩৯,৩৭,৩৫,২৪,১৯ নং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। সাংহাই হাওরের ৪, ১৬, দেখার হাওরের ১৮,১৯,২৪,২৫,২৭,২৮ নং পিআইসি। দরগাপাশা ইউনিয়নের কাচিভাঙ্গা হাওরের ১,২,৩,৭, খাই হাওরের ১৪,১৫, জামখলা হাওরের ২,৩,৭,৮,২৬ নং (পিআইসি)। পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের সাংহাই হাওরের ৬, খাই হাওরের ৮,১৩,৩৪,৪০,৪১,৪৩,৪৪, পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের দেখার হাওরের ২০,২১,২২,২৩ নং (পিআইসি)। পূর্ব বীরগাও ইউনিয়নের জামখলা হাওরের ৯,১০ খাই হাওরের ১৬,১৭,১৮,১৯,২০,২১,২২,২৫,৪৭,৪৮,৪৯ নং (পিআইসি)। পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের দেখার হাওরের ,১২,১৩,২৯,৩০,৩১,৩২,৩৩ ও কাচিভাঙ্গা হাওরের ১১ নং (পিআইসি)। পাথারিয়া ইউনিয়নের সাংহাই হাওরের ৪,৫,২৩ খাই হাওরের ৫,৬,১৪ নং (পিআইসি)। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের জোয়াল ভাঙ্গা বাঁধের ৪৮,৩৯,৪০,৪১,৪৩,৪৬,৪৫ নং পিআইসি। করচার হাওরের ৩৬,৩৭,৩৮, ৪২ নং পিআইসি। কাঠইর ইউনিয়নের ৩৪,৩৫ পিআইসি। কুরবান নগর ইউনিয়নের দেখার হাওরের ৩ ও ৪ নং পিআইসি। রঙ্গারচর ইউনিয়নের ৫,৬,৭ নং পিআইসি। লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের ১০,১১,১২,১৩,১৪,১৫ ও ১৬ নং পিআইসি। সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের ১৭,১৮,১৯,২০,২১,২২ নম্বর (পিআইসির) বেরী বাঁেধর নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শতভাগ কাজ হয়েছে। সারা জেলার মধ্যে সবচেয়ে ভাল কাজ হয়েছে মোল্লাপাড়া ইউনিয়নে বলে চ্যালেঞ্জ করেছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান নুরুল হক। মোহনপুর ইউনিয়নের ২৫,২৬,২৭ নম্বর (পিআইসি)। কাঠইর ইউনিয়নের ৩৪ ও ৩৫ নম্বর (পিআইসি) এর কাজও শেষ পর্যায়ে। বাঁধের কাজ সময়মতো শেষ হওয়ায় কৃষকরা দু:চিন্তা থেকে মুক্ত রয়েছেন। গেল বছর ফসল হারিয়ে সারা বছর চরম অভাব অনটনে কাটতে হয়েছে কৃষকদের। ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে মহাজনি দাদনে কোন রকম কৃষি কাজ করলেও চলতি বোরো ফসল ঘরে উঠবে কি-না তা নিয়ে সংশয় কাটছেনা কৃষকদের। হাওরের বাঁধের কারণে ফসল হারিয়ে অনেক কৃষককেই পথে বসতে হয়েছে। শুধু তাই নয় গৃহ-পালিত পশু-পাখি কম দামে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহের জন্য ঢাকায় চলে যান অনেক কৃষক। চলতি বছর বাঁধের কারণে ফসলের কোন সমস্যা হলে কৃষকদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে বাঁচার তাগিদে চলে যেতে হবে। হাওরের বাঁধ নির্মানের কাজ ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা। ওই উপজেলার মহালিয়া হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধেরও একই অবস্থা। জেলার ফসল রক্ষায় অনুমোদিত বাকি প্রকল্পগুলোতেও বিলম্বে কাজ শুরু করেছিলো প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইসি) কমিটি। এ কারণে নির্ধারিত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষকরা জানিয়েছেন, উপজেলা থেকে স্থানীয় অনেক ইউপি চেয়ারম্যানদের অলিখিত সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ায় তারা নানা অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ৯৪৭ টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় এক শতাদিক প্রকল্পের কাজ শেষ। প্রথমে এক হাজারের মতো পিআইসি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছিলো পরে প্রায় দেড় শতাধিক পিআইসি বাতিল করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। তবে এখনও ফসল রক্ষার নামে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। জানা যায় কাবিটা নীতিমালায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ সম্পন্ন করতে প্রতিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রকল্প অনুমোদন ও প্রকল্প গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গণশুনানী করে হাওর এলাকার কৃষকদের পরামর্শ ও অংশগ্রহণে পিআইসি গঠনের নির্দেশনা থাকলেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে পরামর্শ করেই বেশির ভাগ প্রকল্প গ্রহণ করেন। এতে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান পছন্দের লোকদের দিয়ে পিআইসি করে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পও গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক পিআইসিতে চেয়ারম্যানরা তাদের ভাই,ভাতিজাসহ আত্মীয় স্বজনদের দিয়ে কমিটি করে দিয়েছেন।
জানা গেছে, সরকারের ফসল রক্ষার বরাদ্ধ ভিন্ন কাজে ব্যবহার হচ্ছে বলে সরেজমিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে জানিয়েছেন হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। গত কয়েক দিন পূর্বে দিরাই উপজেলার জগদল এলাকার হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ পরিদর্শন করেন হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। এসময় উপকারভোগী কৃষকরা তাদেরকে জানান, প্রকল্পে বাঁধ এলাকার কৃষকদের বদলে ইউপি চেয়ারম্যানরা তাদের ঘনিষ্ঠদের দায়িত্ব দিয়েছেন। জেলার অন্যতম বড় হাওর তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওরের বোয়ালমারা এলাকার দুটি ইউনিয়নে প্রায় ১০টি পিআইসি গঠন করা হয়েছে। প্রকল্পগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। গত বুধবার পর্যন্ত এই প্রকল্পগুলোতে কাজ শুরু হয়নি। পাশের মহালিয়া হাওরেও মাত্র কাজ শুরু হয়েছে। কাজ শুরু না কারার বিষয়টি স্বীকার করে সংশ্লিষ্টরা জানান, বিলম্বে পানি নামার কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে ২-৩ দিনের মধ্যে কাজ শুরু হয়ে যাবে বলে তারা জানিয়েছেন। তারা আরো জানিয়েছেন, এই দুটি হাওরের যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। শাল্লা উপজেলার আটগাঁও ইউনিয়নের উজানগাঁওয়ের খালের বাঁধ, শর্মার খাল, গোবিন্দপুর-শর্শারকান্দা বেড়িবাঁধ এবং জয়পুর বাঁধের কাজ এখনো শুরু হয়নি। এসব এলাকায় প্রায় ৬টির মতো প্রকল্প রয়েছে। জিরাগের খাড়া দিয়েই গত বছর জোয়ালভাঙ্গা হাওরের ফসল ডুবে ছিলো। এভাবে জেলার
বিভিন্ন উপজেলার অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ এখনও শুরুই হয়নি।হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, গত রোববার আমি শাল্লা উপজেলার ৭টি প্রকল্প ঘুরে এসেছি। সেই সাতটির একটিতেও কাজ শুরু হয়নি। কবে কাজ শুরু হবে কেউ জানেনা। উল্লেখ্য গৌরারং ইউনিয়নের ৪৫,৪৬,৪৭,৩ নম্বর পিআইসির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে কিন্তু এখন পর্যন্ত বরাদ্দকৃত টাকার এক কানাকড়িও পাননি পিআইসির সভাপতি সদস্যসচিবরা। গৌরারং ইউপি চেয়ারম্যান ফুল মিয়া বলেন, আমার ইউনিয়নের মোট ১২টি পিআইসির মধ্যে সবগুলোর কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু অতীব দু:খের সাথে বলতে হচ্ছে ৪টি পিআইসির কাজ শেষ করলেও এই পিআইসিগুলো বরাদ্দকৃত টাকা পায়নি।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা কমিটির সভাপতি ইসরাত জাহান বলেন, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অধিকাংশ বেরী বাঁধের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। গৌরারং ইউনিয়নের যেসব পিআইসি ১ম ও ২য় কিস্তির টাকা পায়নি তাদের বরাদ্ধকৃত টাকা দুএকদিনের মধ্যে প্রদান করা হবে। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা কমিটির সভাপতি পূর্ণেন্দু দেব বলেন, তাহিরপুরের মাটিয়ান ও মহালিয়া হাওরের প্রায় ১৫টির মতো প্রকল্পে কাজ শুরু করা যায়নি আশপাশে পানি থাকার কারণে। তবে এখন পানি নেমে যাওয়ায় আগামীকাল থেকে কাজ শুরু করা হবে। আশা করি এক সপ্তাহের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা কমিটির সভাপতি মো: হারুনুর রশিদ বলেন, সরকার নির্ধারিত সময়ের ভিতরে যদি কোন (পিআইসি) বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ না করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভূইয়া বলেন,জেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় বাঁধ প্রায় ৬৫ পার্সেন্ট হয়েছে, বাকী বাধের কাজ ১৫ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।