কাজিরবাজার ডেস্ক :
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ঝাঁজ শেষ হতে না হতেই এবার প্রস্তুতি চলছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবিত পাইকারি দাম ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাবনার বিপরীতে অন্তত ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। যার ঘোষণা চলতি মাসেই আসছে। এতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র শিকার জনগণের দুর্ভোগের সীমা চরমে পৌঁছবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার প্রভাব এবং দেশের জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর লক্ষ্যে গত ৫ আগস্ট সব ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেয় সরকার। যা ওইদিন রাত ১২টার পর থেকেই কার্যকর হয়। এই ঘোষণায় ভোক্তা পর্যায়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ১১৪ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এর ঠিক দুই মাস আগে ৫ জুন গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হয় প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও।
কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে গণশুনানি করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। শুনানির তিন মাসের মাথায় ৫ জুন প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২২ দশমিক ৭৮ ভাগ বৃদ্ধি করে প্রতি ঘনমিটার ১১ টাকা ৯১ পয়সা করা হয়। এছাড়া আবাসিকে এক চুলার দাম ৯৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা এবং দুই চুলায় ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা করা হয়। প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের গ্যাসের দাম ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা করা হয়।
তখন বিইআরসি জানায়, নতুন এই দাম ১ জুন থেকেই কার্যকর করা হয়েছে। ওই সময় এক সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই খাতে ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঘাটতি হবে। এই টাকার মধ্যে সরকার ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ভর্তুকি হিসেবে বাজেটে দেবে। অন্যদিকে জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল এবং কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দেয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ক্যাপটিভ বিদ্যুত কেন্দ্রে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা, সার উৎপাদনে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা, বৃহৎ শিল্পে ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা, মাঝারি শিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা করা হয়। তবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে গ্যাসের দাম কমে। এ খাতে আগে গ্যাসের দাম ছিল ১৭ টাকা ০৪ পয়সা।
সেখানে করা হয় ১০ টাকা ৭৮ পয়সা। বাণিজ্যিক (হোটেল রেস্টুরেন্টে) ২৩ টাকা থেকে ২৬ টাকা ৬৪ টাকা করা হয়। চা শিল্পে ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ১১ টাকা ৯৩ পয়সা করা হয়। তবে ওই সময় অপরিবর্তিত থাকে সিএনজি গ্যাসের দাম।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে উৎপাদন খরচ বাড়বে এই অজুহাতে গত মার্চ মাসে বিদ্যুতেরও দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা বিইআরসির কাছে জমা দেয় বিদ্যুতের একক ক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এই প্রস্তাবনার বিপরীতে গত ১৮ মে গণশুনানি করে বিইআরসি। নিয়ম অনুযায়ী আগামী বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১৮ আগস্ট শেষ হচ্ছে শুনানির পর তিন মাস।
নিয়ম অনুযায়ী শুনানির পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসাবে চলতি মাসের শেষেই বিদ্যুতেরও দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গণশুনানিতে পাইকারি পর্যায়ে গড়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। তারা একই সঙ্গে বলে, ভোক্তা পর্যায়ে দাম না বাড়ালে পাইকারি মূল্যহার কার্যকর করা সম্ভব হবে না। গণশুনানিতে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি পাইকারি ৩ টাকা ৩৯ পয়সা বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৬ পয়সা করার প্রস্তাব করে বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড। এতদিন সরকার ৩ টাকা ৩৯ পয়সা ভর্তুকি দিয়ে আসছিল। বিপিডিবির এই প্রস্তাব ছিল গ্যাসের তখনকার দর বিবেচনায়।
এ বিষয়ে বিইআরসির বিদ্যুত বিভাগের পরিচালক রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে অনুষ্ঠিত গণশুনানির প্রস্তাব ও সুপারিশ বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে কিছু না কিছু দাম বাড়বেই, এতে কোন সন্দেহ নেই।
এদিকে বিপিডিবি বলছে, কতটুকু দাম বাড়ালে জনগণের সহনীয় পর্যায়ে থাকবে সেটি বিবেচনা করা হবে। বিদ্যুতে যে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সেটা কমানো দরকার। বিপিডিবিও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিপিসির মতো লোকসানে চলছে উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা জিজ্ঞাসার সুরে বলেন, সরকারের কাছ থেকে আমরা আর কত ভর্তুকি চাইতে পারি। তাই আমরা চাইছি দামটা যেন সমন্বয় করা হয়।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন খোদ বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও। চলতি মাসের শুরুতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের ব্যাপারে আমরা অপেক্ষায় আছি। গ্যাসের ব্যাপারে আমরা আরেকটা সমন্বয়ে যেতে চাচ্ছি।
তবে গ্যাস, তেলের পর এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেন বিশেষজ্ঞরা। কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাইকারি বিদ্যুতে আর্থিক ঘাটতি প্রায় ৩০ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। বিদ্যমান পাইকারি মূল্য হার ৫ টাকা ১৭ পয়সা।
মূল্যহার ঘাটতি বিবেচনায় নিয়ে পাইকারি বিদ্যুতের রাজস্ব চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে এবং মূল্যহার ৮ টাকা ৫৮ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ঘাটতি সমন্বয়ে সরকারী ভর্তুকি বিবেচনা করা হয়নি।