মো. শাহজাহান মিয়া জগন্নাথপুর থেকে :
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে ফের স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্রাণহানির মতো ক্ষতি কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তবে অন্যান্য ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। এখনো রাস্তাঘাট ও কাঁচা ঘরবাড়িতে বন্যার ক্ষতিচিহ্ন রয়ে গেছে।
এর মধ্যে বন্যার প্রায় এক মাস পর বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। ২৫ জুলাই সোমবার দেখা যায়, আগের মতো অফিসপাড়া, ব্যাংক, বীমা সহ সকল সরকারি ও বেসসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। উপজেলার প্রতিটি হাট-বাজারে রয়েছে মানুষের সমাগম। চলছে দূরপাল্লার যানবাহন। আবারো মানুষ নিজ কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সর্বক্ষেত্রে ফের স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে পুরো জগন্নাথপুর উপজেলায়। তবে আগামী প্রজন্মের জন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে ২০২২ সালের ভয়াল এ বন্যার স্মৃতিকথা। যা কখনো ভুলা যাবে না।
ফিরে দেখা-চলতি ২০২২ সালের সেই ১৭ জুন শুক্রবার দিন থেকে জগন্নাথপুরে আশঙ্কাজনক ভাবে বন্যার পানি বাড়তে শুরু করে। ১৮ জুন শনিবারের মধ্যে প্লাবিত হয়ে যায় অফিসপাড়া সহ পুরো জগন্নাথপুর উপজেলা। চলে টানা ভারি বৃষ্টিপাত। ডুবে যায় সকল রাস্তাঘাট। বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন চলাচল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছিল না বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক। সারা দেশ থেকে জগন্নাথপুর ছিল রীতিমতো বিচ্ছিন্ন। জগন্নাথপুর থেকে কেউ দেশের অন্য কোথাও যেতে পারেননি। আবার দেশের অন্যস্থান থেকে জগন্নাথপুর আসতে পারেননি। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় কেউ কারো সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করতে পারেননি। এতে মানুষ আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। যতো সময় যায়, ততোই বাড়তে থাকে পানি। দেখতে দেখতে চোখের সামনে তলিয়ে যায় বাড়িঘর। পানির দাপটে মানুষ অসহায় ও নিরুপায় হয়ে যান। চারদিকে শুরু হয় বেঁচে থাকার হাহাকার। নিজ বাড়িঘর ফেলে বৃষ্টিতে ভিজে অসহায় মানুষ ছুটে চলেন উঁচু স্থানে একটু আশ্রয়ের আশায়। এমনও হয়েছে-যে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন, এক সময় সেই স্থানটিও চোখের সামনে ডুবে যায়। আবারো চলে দিশেহারা মানুষের আশ্রয়ের সন্ধান। যে যেভাবে পারছেন, উঁচু স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
আশ্রয় পাওয়ার পর শুরু হয় অন্ন, বস্ত্র ও বিশুদ্ধ পানির অভাব। এ সময় টয়লেট সংকটে বেশি কষ্ট পান মানুষ। ঘরে থাকা জরুরী মালামাল রক্ষা করা ও গবাদিপশুকে বাঁচানো নিয়ে মানুষের কষ্টের যেন শেষ ছিল না। ছিল না পর্যাপ্ত নৌকা। যে কারণে মানুষের দুর্ভোগ হয়েছে বেশি। এর মধ্যে উপজেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ডাকাত আতঙ্ক। মোমবাতি, গ্যাস সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামালের দাম বেড়ে যায়। এতে অসহায় মানুষজন আরো নিরুপায় হয়ে যান। তখন বাজার নিয়ন্ত্রনে মাঠে নামেন উপজেলা প্রশাসন। ডাকাত প্রতিরোধে জনতার পাশে ছিলেন থানা পুলিশ। বন্যায় নৌকা ডুবিতে উপজেলার সাতহাল গ্রামের আনকার মিয়া নামের এক ফল ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। পানিতে তলিয়ে ইছগাঁও গ্রামের শানুর মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি নিখোঁজ হন।
তবে বন্যার ৫ দিনের মাথায় জগন্নাথপুরে ফের বিদ্যুৎ আসলে নেটওয়ার্ক স্বাভাবিক হয়। এর পর থেকে দুর্গত মানুষকে সহযোগিতা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বচ্ছল মানুষগণ। সরকারের পাশাপাশি প্রবাসী সহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। উপজেলা প্রশাসনের সাথে মাঠে নামেন সেনাবাহিনী, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, প্রবাসী সহ সকল হৃদয়বান মানুষ। অবশেষে মহান আল্লাহ পাকের অশেষ দয়ায় ও সকল মানুষের প্রাণপন প্রচেষ্টায় টানা ৩ সপ্তাহ পর পানি কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। ৭ জুলাইয়ের পর মানুষ ক্রমান্বয়ে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেন। তখন দেখা দেয় সাপ আতঙ্ক। এ সময় বাড়িতে সাপ আছে, এমন খবর পেলেই ছুটে যান চিলাউড়া গ্রামের রাজা জালালী। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিষধর সাপ ধরে মানুষকে আতঙ্কমুক্ত করেন। এর মধ্যে বন্যা চলাকালীন সময়ে ১০ জুলাই পবিত্র ঈদুল আযহা পালিত হয়। এ ঈদ ছিল আনন্দ ও বেদনার।