কাজিরবাজার ডেস্ক :
জামিনে গিয়ে কমপক্ষে তিন শতাধিক জঙ্গি গা-ঢাকা দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে জামিনে গিয়ে পলাতক এসব জঙ্গির সন্ধানে মাঠে নেমেছে পুলিশের একাধিক ইউনিট। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্র জানায়, পলাতক এসব জঙ্গিকে ধরতে পুলিশের ইউনিটগুলো রেড এ্যালার্ট জারি করেছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দফতর থেকে যে কোন ভাবে তাদের ধরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনকি বিশে^র সর্বোচ্চ পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমেও ওইসব জঙ্গিকে শনাক্ত করে সতর্কতা জারি করতে অনুরোধ জানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জানায়, পরিচয় গোপন করে তারা দেশের ভেতরেই অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদের বেশিরভাগ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থেকে জঙ্গি তৎপরতা চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার কেউ দেশের বাইরেও পালিয়ে গেছে।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে জঙ্গির সংখ্যা ৫ হাজার ২৮৯ জন। গত ২৭ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৩৪২টি মামলা হয়েছে। মূলত ওইসব মামলার আসামি থেকে এই তালিকা করেছে পুলিশ। যাদের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে ৪ হাজার ৯৯৮ জন। এসব আসামির মধ্যে জামিনে আছে ২ হাজার ৫১২ ও জেলহাজতে রয়েছে ১ হাজার ৬৯৬ জন। পুলিশ সদর দফতরের এক হিসাব থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের অনেকেই আবার উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে। সম্প্রতি জামিন নিয়ে আবারও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে একাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেয়ার কথা থাকলেও তারা তা দিচ্ছে না। এই জন্য তাদের ধরতে পুলিশের সব ক’টি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপারদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাদের ধরতে অনেকটা ইন্টারপোলের মতোই ‘রেড এ্যালার্টই’ জারি করা হয়েছে। তিনি জানান, জামিনপ্রাপ্ত ছাড়াও বাইরে থাকা অন্য জঙ্গিদেরও ধরতে বলা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দেশ থেকে জঙ্গি নির্মূল করতে। কিন্তু এখনও জঙ্গিরা গোপনে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। তার পরও আমরা বেশ সতর্ক আছি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, পলাতক জঙ্গিদের ধরতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ আছে। তার পরও পুলিশ সতর্ক অবস্থায় আছে। প্রতিটি থানা পুলিশ জঙ্গিদের বিষয়ে নজরদারি করছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তৎপর আছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, পুরনো জঙ্গিরা প্রায় কয়েক বছর ধরেই লুট, ছিনতাই ও ডাকাতির মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করছে। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ৭-৮টি ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকাও লুট করেছে। এমনকি খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। এসব ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েক জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হলেও জামিনে বেরিয়ে আবারও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের নেটওয়ার্ক ময়মনসিংহ-জামালপুর উত্তরবঙ্গসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বিস্তৃত রয়েছে। করোনাকালেও অনলাইনে তারা সদস্য সংগ্রহ, বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তারা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে নতুন কর্মী সংগ্রহ, মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাতে অনলাইন ব্যবহার করেছে। সম্প্রতি বোমার সরঞ্জাম কেনে বান্দরবানে গভীর পাহাড়ে অঞ্চলে জঙ্গি ট্রেনিং করেছে কমপক্ষে শতাধিক তরুণ। সংগঠনকে বিস্তৃত করতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করেছে নব্য জেএমবি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি সিটিটিসি ও র্যাবের হাতে অন্তত ২০ জঙ্গি গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর কাহিনী। কিভাবে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চাঙ্গা করার নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা আগের রূপে ফিরে আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। দেশে প্রথম প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গি জোবাইদা সিদ্দিকা নাবিলা নামে এক তরুণী জঙ্গি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তা ছাড়া র্যাবের হাতে ময়মনসিংহে চার জঙ্গি ও ঢাকার বসিলার জঙ্গি আস্তানা থেকে শীর্ষ জঙ্গি এমদাদুল হককে গ্রেফতারের পরই নড়েচড়ে বসেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, সম্প্রতি যেসব জঙ্গি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়েছে তাদের আমরা গ্রেফতার করেছি। আরও বেশ কয়েক জঙ্গি র্যাবের নজরদারির মধ্যে রয়েছে। তাদেরও আমরা আইনের আওতায় আনতে পারব বলে আশা করছি। এই মুহূর্তে র্যাবের গোয়েন্দা তথ্যমতে, জঙ্গিদের আক্রমণাত্মক হওয়ার সামর্থ্য নেই। তিনি জানান, র্যাব বহুমুখী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ দমন কার্যক্রমে কাজ করছে। যখনই জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে, তখনই গ্রেফতার করা হচ্ছে। শুধু অভিযান নয়, জঙ্গিবাদবিরোধী জনমত গড়তে র্যাব ব্যাপক প্রচার চালিয়েছে। অন্যদিকে গ্রেফতারের পাশাপাশি জঙ্গিদের অর্থের উৎস এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রাপ্তি বন্ধ করতেও র্যাবের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিনি জানান, গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বসিলার জঙ্গি আস্তানা থেকে দুর্ধর্ষ জঙ্গি জেএমবি শীর্ষ নেতা এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টারকে গ্রেফতার করে র্যাব। ২০০৩ সালে জেএমবির সাবেক শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের বায়াত গ্রহণ করে সে। বসিলায় জঙ্গি আস্তানাও গড়ে তোলে উজ্জ্বল। জঙ্গিরা লাইম লাইটে আসার চেষ্টা করলেও কাজ হবে না। আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিদের ধরতে র্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে।
জানা গেছে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) একটি গাড়িতে পেট্রোল বোমা মারতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে দেলোয়ার নামে এক জঙ্গি। বাংলাদেশে হামলা করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার টার্গেট ছিল তার। তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবির কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সিটিটিসির উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, দেলোয়ার ‘সেলফ রেডিকালাইজড। কিছু দিন জাপান ছিল। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর। তার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তার কাছ থেকে একটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। ব্যাগের ভেতরে এক লিটারের বেশি তরল পদার্থ ও দুটি লোহার তৈরি ছুরি ছিল। এই বিষয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেলোয়ার ঠান্ডা মাথার জঙ্গি। গুলশানে এআইইউবির একটি মাইক্রোবাসে বোমা মারার চেষ্টা করেছিল। পথচারীর সহায়তায় তাকে ধরা সম্ভব হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্টাফদের ওপর বড় ধরনের হামলা চালিয়ে প্রাণহানি ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার ছক ছিল তার। অনলাইনে উগ্রপন্থী বিভিন্ন অডিও-ভিডিও দেখত দেলোয়ার। কয়েক সহযোগীর নামও বলেছে দেলোয়ার। তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ১৯৯৪ সাল থেকে গত বছরের ৩০ আগষ্ট পর্যন্ত জঙ্গি মামলার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৩৪২টি জঙ্গি মামলার মধ্যে পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে ১ হাজার ২৬টি। চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে ৪৩টির। তদন্তাধীন মামলা আছে ২৭৩টি। যেসব মামলার অভিযোগপত্র হয়েছে সেগুলোতে ৪ হাজার ৬৩৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে ৫১ জনকে। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে ৫২৮ জনকে। খালাসপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ৫৯৭ জন। বিগত ২৭ বছরের জঙ্গি মামলাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ২০০৫ সালে ২০১টি মামলা হয়েছে। এরপর সর্বাধিক ১৮৪টি মামলা হয়েছে ২০১৬ সালে। এ ছাড়া ২০১৭ সালে ১২২টি ও ২০১৮ সালে মামলা হয়েছে ১০৩টি। চলতি বছর জঙ্গি মামলা হয়েছে ৬৯টি। চলতি বছর ৬৯ মামলায় মোট আসামি সংখ্যা ১৯৩ জন। যাদের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে ১৩৫ জন। চলতি বছর গ্রেফতার হওয়া আসামিদের মধ্যে জামিনে আছে ১ জন এবং জেলা হাজতে ১২৪ জন ও পলাতক আছেন ৪৬ জন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, র্যাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত আড়াই হাজার জঙ্গি গ্রেফতার করেছে। শুধু হলি আর্টিজান হামলার পরে এখন পর্যন্ত ১৬শ’র বেশি জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে ৮৬৪ জন জেএমবি সদস্য, ৪০৬ জন আনসার আল ইসলামের সদস্য, আল্লাহর দলের ২০১ জন, হিযবুত তাহরীরের ৮৮ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৮৬ ও হুজির ৩০ সদস্য রয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশী-বিদেশী ৬৫টি অস্ত্র, ২৫২ রাউন্ড গোলাবারুদ, ১০২টি গ্রেনেড ও ককটেল, ৮০টি ডেটোনেটর ও সাড়ে ১৬ কেজি বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক জব্দ করা হয়।
সারাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে সফল পুলিশের এ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। এটিইউয়ের পুলিশ সুপার (মিডিয়া এ্যান্ড এ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান জানান, জঙ্গিরা যাতে জামিনে বের হতে না পারে সে জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার রাতে যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া সুন্দলীবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির পরোয়ানাভুক্ত পলাতক আসামি ভয়ঙ্কর জঙ্গি মোঃ মেহেদী ওরফে মেহেদী হাসান (৩০) গ্রেফতার করেছে পুলিশের এ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। তার বাড়ি লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধায়। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম খান জানান, হলি আর্টিজান হামলার পর ১০৮ অভিযানে ১৭৩ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের এ্যান্টি টেররিজম ইউনিট। ২০১৯ সালে ২৭ জন, ২০২০ সালে ৬৩ জন, ২০২১ সালে ৫৬ জন এবং চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে ২৭ জঙ্গি। ১৭৩ জঙ্গির মধ্যে জেএমবির ১৪, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৪৮, আল্লাহর দলের ৩১, হিযবুত তাহ্রীরের ২৫, আনসার আল ইসলাম ২৪, অনলাইন প্রতারক ১১, হেফাজতে ইসলাম ৪ ও অন্যান্য ৫ জন।
জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিরা কতটা নজরদারিতে: বাংলাদেশে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট ও আল নুসরা ফ্রন্টের হয়ে সদস্য সংগ্রহের কাজ করছিল বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান ইবনে হামদান। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কমলাপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তিন বছর পর ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে সে গা-ঢাকা দেয়। পরে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। সেখানে সে বাংলাদেশ-ভারতের জঙ্গিদের সংগঠিত করছিল। কিন্তু ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতার হয়। সেখানে কিছুদিন কারাভোগের পর সামিউন জামিনে বেরিয়ে পালিয়ে যায়। এ নিয়ে সে সময় ঢাকায় তোলপাড় শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, শুধু সামিউন নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ অনেক নেতা ও সাধারণ সদস্য জামিনে বেরিয়ে ফের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা জানান, আদালত থেকে জঙ্গিরা একে একে জামিনে বেরিয়ে গা-ঢাকা দিচ্ছে। তা নিয়ে কোন নজরদারি নেই। জঙ্গিরা জামিন পেলে কারাগার থেকে বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে জানিয়ে দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এ নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। জামিনের ক্ষেত্রে পুলিশের নজরদারি নেই। গোঁজামিল করে মামলা দেয়া হয়। কোন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার দিয়ে মামলা করা হয় না। এ জন্য জঙ্গিরা জামিন পাচ্ছে। জামিন থেকে বেরিয়ে আবার তারা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। এতে প্রশ্ন থেকে যায়, জঙ্গিদের নজরদারিতে গাফিলতি রয়েছে। তা তদন্ত করা দরকার। তা না হলে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্র জানায়, শীর্ষ পর্যায়ের জঙ্গিরা জামিনে বের হলে কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণত সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বা পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যদের জানিয়ে থাকে। এরপর জামিন পাওয়া জঙ্গি সদস্যের ওপর নজরদারি করা হয়। তবে সব জঙ্গির ক্ষেত্রে এটি করা হয় না। সাধারণত শীর্ষ জঙ্গিদের ক্ষেত্রে নজরদারি করা হয়।
জঙ্গিবাদ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন এমন বিশ্লেষকরা জানান, জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়মিত নজরদারির কথা বলা হলেও তা আসলে অপ্রতুল। আমরা মাঝে মধ্যেই দেখতে পাচ্ছি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতেই এমন জঙ্গি সদস্য গ্রেফতার হচ্ছে, যারা আগেও গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় ছিল। জামিনে বের হয়ে এসে আবারও জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশের কর্মকর্তা জানান, জামিনে থাকা জঙ্গিদের শতভাগ নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে যারা একটু নেতা টাইপের, তাদের নজরদারি করা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ছোটখাটো বা সদস্য পর্যায়ের ব্যক্তিদের নজরদারি করা যায় না। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর এত জনবল নেই।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কয়েক কর্মকর্তা জানান, ঢাকার কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট জঙ্গিবাদ দমনে সফল হলেও তাদের অধিক্ষেত্র হলো রাজধানী ঢাকার মধ্যে। ঢাকার বাইরে অপারেশন করতে হলে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশ বা পুলিশ সদর দফতরের অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর সারাদেশের জঙ্গিবাদ দমনে ২০১৮ সালে এ্যান্টি টেররিজম ইউনিট গঠন করা হলেও এখনও জনবল সঙ্কটের কারণে তারা প্রত্যেক জেলায় কার্যক্রম চালাতে পারছে না। ঢাকা থেকে টিম পাঠিয়ে তাদের কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসির প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, আমরা জামিনে বের হয়ে আসা শীর্ষ জঙ্গিদের নজরদারি করি। তারা কেউ পুনরায় জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে কিনা, তা নজরদারি করা হয়। এ ছাড়া তারা জামিনে বের হয়ে এসে কার সঙ্গে যোগাযোগ করছে বা কোথায় যাতায়াত করছে, তাও পর্যবেক্ষণ করা হয়।
জঙ্গি নিয়ে কাজ করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ছোটখাটো ও বা আত্মঘাতী কিছু হামলার ঘটনা হলেও জঙ্গিদের সর্ববৃহৎ হামলা ছিল ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে। ওই হামলায় ১৮ বিদেশী নাগরিকসহ মোট ২২ জন নিহত হন। নিহতের মধ্যে ইতালির ৯ জন ও জাপানের নাগরিক ছিলেন ৭ জন। এই মামলায় আদালত সাত জঙ্গিকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গিদের ৫ জন ঘটনার দিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কমান্ডো অভিযান মারা যায়।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় কারাগারে ডির্যাডিকালাইজেশন কর্মসূচী রয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ, র্যাব, সিটিটিসি ও এটিইউ বিভিন্ন সময় ডির্যাডিকালাইজেশনে বিভিন্ন কাজ করে থাকে। নানামুখী অভিযানে জঙ্গিদের সামর্থ্য নষ্ট করা সম্ভব। কিন্তু তাদের আদর্শ থাকে ব্রেনে। কারও ভেতর ভুল মতাদর্শ থাকলে সেটা শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না। সেটার জন্য বিভিন্ন ‘মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।