কাজিরবাজার ডেস্ক :
পদ্মা সেতুতে মানুষের হাঁটা-চলা, ঘোরাঘুরি বন্ধ করা ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নিয়ম মানাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে প্রশাসন ও সেতু কর্তৃপক্ষ। কেউ যাতে গাড়ি থেকে সেতুতে না নামে ও ছবি না তোলে, সেজন্য টোল প্লাজা এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। সোমবার সকাল থেকে সেতুতে টহল দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পদ্মা সেতুতে অবৈধভাবে পার্কিং করার অপরাধে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া প্রান্তে এক প্রাইভেটকার চালককে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল উঠতে না পারায় সোমবার সকালে মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজা কিছু সময়ের জন্য অবরুদ্ধ করেন মোটরসাইকেলের চালকরা। কিছুক্ষণ সেতুতে গাড়ি প্রবেশ বন্ধ করে দেন তারা। পুলিশ এসে তাদের শিমুলিয়া ঘাটে নিয়ে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তেও অবরোধ করেন চালকরা। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের হটিয়ে দিলে প্রায় আধা ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এদিকে নিষেধাজ্ঞা থাকায় সোমবার সকালের দিকে পিকআপে পদ্মা সেতু পারাপার হয় মোটরসাইকেল। কিন্তু দুপুরের পর এসব পিকআপও আটকে দেয় পুলিশ। এ অবস্থায় সেতু পারাপারে যাত্রীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
যান চলাচলের প্রথম দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বেশকিছু ভিডিও। এর একটিতে দেখা গেছে, সেতুর নাট খুলে ফেলছে এক যুবক। পরে তাকে গ্রেফতারও করা হয়। সোমবার ওই যুবকের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ বায়েজিদ নামে ওই যুবক জানিয়েছেন নিজের মোটরসাইকেলের টুলবক্সে থাকা যন্ত্র দিয়েই সেতুর রেলিংয়ের নাটবল্ট খুলে টিকটকের ভিডিও বানিয়েছেন তিনি। আরও অনেক নারী-পুরুষকেই দেখা যায়, সেতুতে দাঁড়িয়ে টিকটকের ভিডিও বানাতে। এমনকি বাইক নিয়ে সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে নানান কসরত করতেও দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে। এছাড়া রবিবার ১০৭ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে গিয়ে দুর্ঘটনায় দুই তরুণ আহত হন। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা মারা যান। অথচ সেতুর ওপর সর্বোচ্চ গতিসীমা ৬০ কিলোমিটার। এমন বাস্তবতায় রবিবার রাতে সেতুতে অনির্দিষ্টকালের জন্য মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। ওই নিষেধাজ্ঞা সোমবার ভোর ছয়টা থেকে কার্যকর হয়।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, গত রবিবার রাতে মন্ত্রী পরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সেতু বিভাগ, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, সেনা কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও সেতুর নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে জাজিরার সার্ভিস এরিয়া-২-এ সভা করেন। সেতুতে নিরাপদে যানবাহন চলাচল, নিরাপত্তা জোরদার, দুর্ঘটনা রোধ করার বিষয় দিকনির্দেশনা দেন। তখন সিদ্ধান্ত হয়, সেতুতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা টহল দেবেন। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হোসেন বলেন, সেতুর চালু হওয়ার দিন মোটরসাইকেল আরোহীদের কারণে কিছু বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। দুটি প্রাণ ঝরেছে। বাধ্য হয়ে সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছে। সেতুসংশ্লিষ্ট সব মহল মিলে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেতুর নিরাপত্তা, মানুষের নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনা রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করবে। তাই সোমবার সকাল থেকে সেতুতে কয়েকটি দলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা টহল দেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, সোমবার সকাল থেকেই পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে যানবাহনের জট ছিল না। ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক সরাসরি টোল দিয়ে সেতু পার হয়েছে। তবে সকালে মাওয়াপ্রান্তে পদ্মা সেতু পার হতে না দেয়ায় কয়েকজন মোটরসাইকেলচালক টোল প্লাজায় জড়ো হন। তারা সেতু পার হওয়ার জন্য জোর দাবি জানাতে থাকেন, তবে টোল প্লাজায় দায়িত্বরত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের বাধায় সেতু পার হতে পারেননি তারা। সকালে সেতু কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বাইকারদের জানানো হয়, মোটরসাইকেলের জন্য ফেরির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে ঘাটে গিয়ে ফেরির ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন অনেক বাইকার। তারা বলছেন, একসঙ্গে দেড়শ মোটরসাইকেল জড়ো না হলে ফেরিতে নেয়া হচ্ছে না। এতে তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। ঘাট থেকে ফিরে এসে আবার অনেককে টোল প্লাজার সামনে ভিড় করতে দেখা গেছে। আবার কেউ কেউ পিকআপ ভাড়া করে কৌশলে বাইক নিয়ে সেতু পার হচ্ছেন। সকালে এমন একটি ভিডিও ফেসবুকে দেখা গেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি পিকআপে সাত-আটজন যুবক কয়েকটি বাইক নিয়ে পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার সামনে অপেক্ষা করছেন। এসময় তাদের ভাড়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে তারা জানান, সেতু পার করাতে প্রতিটি বাইকে গুনতে হয়েছে ৪০০ টাকা করে। রাজধানীর সেগুনবাগিচা থেকে আসা আসাদ মিয়া বলেন, ‘আমি সকাল ১০টায় আসি। সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে দিচ্ছে না। এরপর ফেরিঘাটে যাই। সেখানে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকেও ফেরি না পেয়ে আবারও পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় আসি। আমি ব্যবসা করি। যশোর থেকে আমার কাঁচামাল আসবে। এখন না যেতে পারলে মালামাল নষ্ট হয়ে যাবে।’ আরেকজন মোটরসাইকেলচালক আরিফ হোসেন বলেন, ‘আমার মা অসুস্থ। আমাকে বাড়ি যেতে হবে। কয়েকজনের অপরাধের কারণে লাখ লাখ মোটরসাইকেল চালককে মাশুল দিতে হবে, এটা হতে পারে না। যারা অন্যায় করেছে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।’ মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজার ইনচার্জ ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘সকালে কয়েকজন মোটরসাইকেলচালক সেতু পার হওয়ার জন্য টোল প্লাজায় আসেন। সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক সোমবার থেকে সেতুতে মোটরসাইকেল পারাপার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই আমরা তাদের টোল প্লাজা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছি। সকালে কিছু চাপ থাকলেও পরে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যায়। লৌহজং এসিল্যান্ড ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ ইলিয়াস হোসেন জানান, মোটরসাইকেল পার হতে দেয়া যাচ্ছে না। সেতু এলাকায় মাইকিং করছে প্রশাসন। সেতুতে কোনরকম মোটরসাইকেল ও মাঝ সেতুতে কেউ নামলে বা ছবি তুললে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে সোমবার বেলা ২টার দিকে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে অবরোধ করেছেন মোটরসাইকেলের চালকরা। এ সময় দীর্ঘ যানজট তৈরি হলে সেনাবাহিনী সদস্যরা এসে তাদের হটিয়ে দিলে প্রায় আধা ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সোমবার সকাল থেকে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ ছিল। তবে মোটরসাইকেলগুলো পিকআপে করে পার করছিলেন চালকরা। হঠাৎ দুপুরের দিকে পিকআপে করে মোটরসসাইকেল পারাপারও বন্ধ করে দেন। এ সময় মোটরসাইকেলের চালকরা রাস্তা অবরোধ করেন। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হয়ে অবরোধকারীদের সরিয়ে দেন। অবরোধকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের এভাবে যদি আটকে রাখে, তাহলে আমরা কীভাবে যাব? পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল ওঠানো নিষেধ, পিকআপ তো নয়? তাই আমরা পিকআপ ভাড়া করেছি করে যাওয়ার জন্য। এখন তারা সেটিতে করেও যেতে দেবে না। তাহলে আমাদের বিকল্প পথ দেখিয়ে দিক। এ বিষয়ে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার ম্যানেজার কামাল হোসেন বলেন, পিকআপে মানুষ বা মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারে না। আমাদের কাছে ভারি মালামালসহ পিকআপ যেতে দেয়ার অনুমতি রয়েছে। তাই আমরা মানুষ ও মোটরসাইকেল পারাপার বন্ধ রেখেছি। জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান সোহেল বলেন, ‘সোমবার সকাল থেকেই আমাদের মোবাইল টিম কাজ করছে। কাউকে মোটরসাইকেল নিয়ে সেতুতে উঠতে দেয়া হচ্ছে না। কেউ আসলে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।’
পদ্মা সেতুতে গাড়ি থামিয়ে সেলফি তোলায় জরিমানা : পদ্মা সেতুতে অবৈধভাবে পার্কিং করার অপরাধে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া প্রান্তে এক প্রাইভেটকার চালককে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার বেলা দেড়টার দিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফুল কবীর প্রাইভেটকার চালক ফখরুল আলমকে এক হাজার টাকা জরিমানা করেন। আশরাফুল কবির জানান, কুমিল্লা থেকে প্রাইভেটকারে চালকসহ ছয় যুবক পদ্মা সেতু দেখতে আসেন। মাওয়া টোল প্লাজায় টোল দিয়ে সেতুতে ওঠেন। মাঝ সেতুতে প্রাইভেটকার থামিয়ে সেলফি তুলছিলেন। তিনি আরও জানান, পদ্মা সেতুতে গাড়ি পার্কিং অবৈধ- তাই চালককে জরিমানা করা হয়। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে সেতুতে গাড়ি পার্কিং না করার জন্য তাকে সতর্ক করা হয়েছে।
প্রথম দিন পদ্মা সেতু পার হয়েছে ৫১ হাজার যানবাহন : উদ্বোধনের পর চলাচল শুরুর প্রথম দিন পদ্মা সেতু পার হয়েছে ৫১ হাজারের বেশি যানবাহন; টোল আদায় হয়েছে ২ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ আবুল হোসেন সোমবার সকালে ২০ ঘণ্টার এক হিসাব দেন গণমাধ্যমে। তিনি বলেন, গত রবিবার সকাল ৬টা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। রাত ১২টা পর্যন্ত সময়ে মোট ৫১ হাজার ৩১৬টি যানবাহন সেতু পার হয়েছে। দুই প্রান্তের টোল প্লাজায় এসব যানবাহন দুই কোটি ৯ লাখ টাকা টোল দিয়েছে। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্ত দিয়ে সেতুতে উঠেছে ২৬ হাজার ৫৮৯টি যানবাহন। ওই প্রান্তে টোল আদায় হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ ৯৫ হাজার ৯০০ টাকা। আর জাজিরা প্রান্ত থেকে পার হয়েছে ২৪ হাজার ৭২৭টি ঢাকামুখী যানবাহন। সেসব বাহন ১ কোটি ৪৪ হাজার ৪০০ টাকা টোল দিয়েছে। সব মিলিয়ে ৫১ হাজার ৩১৬টি যানবাহন পার হয়েছে যা থেকে টোল আদায় করা হয়েছে ২ কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার ৩০০ টাকা। আবুল হোসেন বলেন, ‘কত টোল আদায় হচ্ছে, সেসব বিস্তারিত তথ্য আমরা ওয়েবসাইটে দিয়ে দেয়ার কথা ভাবছি।’
পদ্মা সেতুতে যাত্রীদের দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান সেতুমন্ত্রীর : পদ্মা সেতু পারাপারে যাত্রীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সোমবার এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু অবকাঠামো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্থাপনা এবং দেশের এক বড় সম্পদ। এর নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। বিবৃতিতে সেতু পারাপারে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান ওবায়দুল কাদের।