সিন্টু রঞ্জন চন্দ
সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আজ বুধবার সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে ভোটগ্রহণ। অনুষ্ঠেয় সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বর্ধিত ১৫টি ওয়ার্ডসহ ৪২টি ওয়ার্ডে ১৯০টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)’র মাধ্যমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সিসিকের এই ১৯০টি কেন্দ্রের ১৩২টিকেই গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়েছে। তবে দু’একটি কেন্দ্রে পানি প্রবেশ করায় এসব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে কিনা তা জানা যায়নি। অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে ইতোমধ্যে সিসিকের ভোটকেন্দ্রগুলোতে প্রায় সাড়ে ১৭শ’ সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
ভোটগ্রহণ শেষে বুধবার রাতে প্রার্থীদের ফলাফল ঘোষণা করবেন সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা। এবার ৭ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৫৭ পরিষদের সিসিক আসনে কে বসছেন মেয়রের আসনে এনিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। তবে বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচনের প্রার্থী না হওয়ায় নৌকা প্রতীকের আওয়ামী লীগের মনোনিত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী মেয়রের চেয়ারে বসার সম্ভবনা বেশী রয়েছে বলে অধিকাংশের ধারণা।
তবে জনতার জরিপে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল পিছিয়ে নেই। ভোটের লড়াইয়ে চোখে পড়ার মতো তৎপরতা ও প্রচারে দেখা গিয়েছিলো মেয়র প্রার্থী মাহমুদুল হাসানকে। প্রচারের ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর চেয়ে কয়েকগুন এগিয়ে ছিলেন তিনি। তবে নির্বাচন বর্জন করায় ভোটের লড়াইয়ে এখন মুখোমুখি অবস্থানে আছেন আওয়ামী লীগের মনোনিত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও জাতীয় পার্টির মনোনিত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল।
এদিকে মঙ্গলবার সকাল ১১টায় সিলেটের আবুল মাল আব্দুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনের সরঞ্জামাদি বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়। পরে সেসব সামগ্রী ভোট কেন্দ্রে নেওয়া হয়। এসময় রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ফয়সাল কাদির উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ভোট শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার এবং আর্মড পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। তিনি জানান, প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুরো নির্বাচনী এলাকায় সাতজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত থাকবেন।
মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে মহানগরে কাজ করছে ২ হাজার ৬০০ পুলিশ সদস্য, ১৪ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ৪২টি ওয়ার্ডে ৪২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। নির্বাচনে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তারা তাৎক্ষনিক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রতি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে পুলিশের ৪২টি মোবাইল টিম, প্রতি তিনটি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে ১৪টি স্ট্রাইকিং টিম এবং প্রতি থানায় একটি করে ৬টি করে ৬টি রিজার্ভ স্ট্রাইকিং টিম থাকবে। এর পাশাপাশি থাকবে ২টি ওয়ার্ডে ১টি করে র্যাবের মোট ২২টি ও ৫টি ওয়ার্ডে এক প্লাটুন করে মোট ১০ প্লাটুন বিজিবি টহল দিবে। এসএমপি কমিশনার নির্ভয়ে ভোট দিতে যাওয়ার জন্য সবাইকে আহŸান জানান।
সিসিকে এবার কাউন্সিলর পদে ৩৬০ জন প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন। যাদের মধ্যে ২৭৩ জন সাধারণ ওয়ার্ডে এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডে (নারী কাউন্সিলর) ৮৭ জন নারী প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন। আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী যেসব ওয়ার্ডে: ১নং ওয়ার্ডে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুফতি কমর উদ্দিন ও সিনিয়র সদস্য আনোয়ারুস সাদত। ৩নং ওয়ার্ডে মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য আমজাদ হোসেন আবজাদ ও আওয়ামী লীগ নেতা বর্তমান কাউন্সিলর লায়েক আহমদ। ৪নং ওয়ার্ডে মহানগর যুবলীগের সভাপতি আলম খান মুক্তি ও শ্রমিক লীগ নেতা শেখ তোফায়েল আহমেদ সেফুল। ৮নং ওয়ার্ডে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জগদীশ দাশ ও নগর আওয়ামী লীগের সদস্য বর্তমান কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান ইলিয়াস। ২০নং ওয়ার্ডে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বর্তমান কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মিটু তালুকদার। ৩২নং ওয়ার্ডে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এডভোকেট আফসর আহমদ ও ছাত্রলীগ নেতা রুয়েল আহমদ।
এদিকে মেয়র পদে প্রার্থী না দিলেও কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় বিএনপির প্রার্থীর ছড়াছড়ি। ১নং ওয়ার্ডে মহানগর বিএনপির সদস্য বর্তমান কাউন্সিলর সৈয়দ তৌফিকুল হাদী। ৫নং ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা বর্তমান কাউন্সিলর রেজোয়ান আহমদ। ৬নং ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি বর্তমান কাউন্সিলর ফরহাদ চৌধুরী শামিম। ১২নং ওয়ার্ডে মহানগর বিএনপির সদস্য বর্তমান কাউন্সিলর সিকন্দর আলী। ১৪নং ওয়ার্ডে মহানগর বিএনপির সদস্য বর্তমান কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনিম। ১৮নং ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা বর্তমান কাউন্সিলর এবিএম জিল্লুর রহমান উজ্জ্বল। ২৫নং ওয়ার্ডে মহিলা দলের জেলা সভাপতি এডভোকেট রোকসানা বেগম শাহনাজ। ৩৮নং ওয়ার্ডে জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আলতাফ হোসেন সুমন। অবশ্য বিএনপি দলীয় নির্দেশ উপেক্ষা করে প্রার্থী হওয়া নেতাদের বহিষ্কার করেছে।
অপরদিকে বিএনপির মতো তাদের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীও এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। তবু দলটির অন্তত ৬ জন নেতা কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন বর্তমান ও একজন সাবেক কাউন্সিলর রয়েছেন। ২৪নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর সুহেল আহমদ রিপন ও ২৭নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আব্দুল জলিল নজরুল এবারো প্রার্থী হয়েছেন। এছাড়া জামায়াত নেতাদের মধ্যে ১০নং ওয়ার্ডে আব্দুল হাকিম, ২৮নং ওয়ার্ডে সুহেল রানা, ৩৩নং ওয়ার্ডে মঞ্জুরুল ইসলাম ও ৪১নং ওয়ার্ডে মঞ্জুরুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন ওয়ার্ডে পরস্পরের প্রতিদ্ব›দ্বী আওয়ামী লীগ নেতারা ভোটের দিন উত্তেজনা ছড়াতে পারেন। তাছাড়া বিএনপি ও জামায়াতের যেসব নেতা প্রার্থী হয়েছেন- নিজ নিজ এলাকায় তারাও প্রভাবশালী। এদের কারণে বাড়তে উত্তেজনা সৃষ্টি আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না সাধারণ ভোটার থেকে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কেউই।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে সিটি নির্বাচনে সিলেট নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৪৪ এবং নারী ১ লাখ ৫০ হাজার ২৮৮ জন। কেন্দ্র ছিল ১৩৪টি, ভোট কক্ষ ছিল ৯২৬টি এবং অস্থায়ী কক্ষ ছিল ৩৪টি। এবার ৪২টি ওয়ার্ডে কেন্দ্র বেড়ে হয়েছে ১৯০টি এবং ভোট কক্ষ ১ হাজার ৩৬৭টি। ২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সিলেটের সকল ওয়ার্ডে এবারই প্রথম হচ্ছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এর মাধ্যমে ভোট গ্রহণ। এর আগে সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা বিভিন্ন ওয়ার্ডে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এর মাধ্যমে ভোটগ্রহণের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
সূত্র আরো জানায়, ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হেরেছিলেন তখনকার জনপ্রিয় মেয়র আওয়ামী লীগের বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। ভোটের পর তিনি ও তার সমর্থকরা সেই পরাজয়ের পেছনে নৌকার ব্যাজ পরে ধানের শীষে ভোট দেয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। বিএনপিবিহীন এবারের নির্বাচনেও সেই শঙ্কা কাটছে না। কারণ ভোটে বিএনপি না থাকলেও চ‚ড়ায় উঠেছে উত্তেজনার পারদ। বিএনপি কর্মী-সমর্থকদের ভোট কোন দিকে যাচ্ছে আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভোট আদতে নৌকায় পড়ছে কিনা- এর ওপর নির্ভর করছে ভোটের অঙ্কের শেষ ফল। নির্বাচনী হিসেবে লাঙ্গল, হাতপাখার প্রার্থীসহ অন্তত তিনজনের ভরসা বিএনপির ‘নীরব ভোট’। আওয়ামী লীগের আশা, সরকারের উন্নয়ন, দলীয় প্রার্থীর ইমেজ, বিএনপির ভোট ভাগাভাগিতে অতি সহজেই বিজয় গন্তব্যে পৌঁছাবে নৌকা।
ভোটের দিন কেমন থাকবে আবহাওয়া : ভোটের দিন আবহাওয়া কেমন থাকবে তা নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। এদিকে, জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে সিলেটে বৃষ্টি ঝরছে। সেটি অব্যাহত আছে মঙ্গলবার আষাঢ়ের ষষ্ঠ দিন পর্যন্ত।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এ ধারা আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকবে। সে হিসাবে আজ বুধবার সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিনও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। শঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রার্থীরাও। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সোমবার রাতে সর্বশেষ নির্বাচনী সমাবেশে ভোটারদের কেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদানের আহŸান জানিয়েছেন। বৃষ্টি উপেক্ষা করে উন্নয়নের স্বার্থে ভোট দেওয়ার আহŸান জানিয়েছেন তিনি। একই ভাবে জাতীয় পার্টির মেয়রপ্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল সর্বশেষ নির্বাচনী সভায় ভোটারদের ভোটের দিন সকাল সকাল কেন্দ্রে যাওয়ার আহŸান জানান।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, জুন মাসে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ৩০ বছরের বৃষ্টিপাত পর্যালোচনা করে একটি অঞ্চলের স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাত ধরা হয়। সে হিসাবে সিলেট অঞ্চলে জুন মাসে স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাত ৮১৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার। তবে গত বছরের জুন মাসে ১ হাজার ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তবে জুন মাসে ১৯ দিনে সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১ হাজার ৮৫ দশমিক ৯ মিলিমিটার। বাকি ১১ দিনে সিলেটে আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। গত বছরের বৃষ্টিপাতের রেকর্ড ভেঙে যেতে পারে চলতি মাসে।
সিলেটের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোঃ সজীব হোসাইন গণমাধ্যমকে জানান, সিলেটে আরও কয়েক দিন ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।