কাজিরবাজার ডেস্ক :
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত নৌকা মার্কা প্রতীকে ৫০ হাজার ৩০০ ভোট পেয়ে বেসরকারীভাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা সাহেদুন্নবী চৌধুরী রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে এই ফল ঘোষণা করেন। হাড্ডাহাড্ডি এই নির্বাচনে রিফাতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গত দুই মেয়াদের মেয়র বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী (টেবিল ঘড়ি) মনিরুল হক সাক্কু। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এবারের কুসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রখর রোদ ও প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ ভোটাররা লাইনে দাঁড়িয়ে ইভিএমে এ ভোট দেন। ১০৫ কেন্দ্রেই ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা হয়। কঠোর নিরাপত্তায় অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়।
এবার ভোটার উপস্থিতি ছিল শতকরা ৬০ ভাগ। নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে সকল প্রার্থীই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ চলে। ভোটগ্রহণকালে উল্লেখযোগ্য কোন সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।
কুমিল্লা সিটি কর্র্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃৃত টেবিল ঘড়ি প্রতিকের প্রার্থী দুইবারের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। তবে সর্বশেষ বেসরকারী সূত্র থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত জয়ী হয়েছেন।
এর আগে রাত সোয়া ৭টায় নির্বাচনী কন্টোল রুম থেকে ঘোষিত ২২টি কেন্দ্রের ফলাফলে নৌকার প্রার্থী রিফাত পেয়েছেন ৯ হাজার ৩৯৬ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী টেবিল ঘড়ি প্রতিকের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু পেয়েছেন ৮ হাজার ৯১৮ ভোট। তবে বেসরকারীভাবে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৫২টির ফলাফলে রিফাত (নৌকা মার্কা) পেয়েছেন ২৫ হাজার ৩১৯ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু (টেবিল ঘড়ি প্রতীক) পেয়েছেন ২৬ হাজার ৬৫ ভোট। অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার (ঘোড়া মার্কা) পেয়েছেন ১৩ হাজার ৩৩৭ ভোট। এ হিসেবে সাক্কু ও রিফাতের মধ্যে হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে সাক্কুর একান্ত সহকারী কবির হোসেন মজুমদার রাত সাড়ে ৭টার দিকে বলেন, তারা ৬০ কেন্দের বেসরকারী ফলাফল পেয়েছেন, এতে সাক্কু ২ হাজার ভোটে এগিয়ে আছেন। এ ছাড়াও রাত পৌনে ৮টায় ভোটের মাঠের অপর একটি সূত্র জানায়, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ৫০ হাজার ৩৯১ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন। তার নিকটতম প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৬৪ ভোট। এতে নৌকার প্রার্থী ৫২৭ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। তবে নির্বাচন কমিশনের কোন সূত্র থেকে এ ফলাফল নিশ্চিত করা যায়নি। এদিকে রাত সাড়ে ৮টার দিকে সাক্কুর ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, তাদের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু ৯৮৭ ভোট বেশি পেয়ে জয়লাভ করেছেন। এই জয়কে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষ বিজয় মিছিল করেছে।
অন্যদিকে নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, রাতে ফলাফল ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার বিকেলে চূড়ান্ত ফলাফল বিবরণী দেয়া হবে।
শান্তিপূর্ণ ভোট : শুরুতে বৃষ্টি, শেষেও বৃষ্টি। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে বুধবার কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের তৃতীয়বারের নির্বাচন সম্পন্ন হয়। বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে টানা ভোটগ্রহণ। সকালের প্রচ- বৃষ্টিপাত প্রার্থী-ভোটারদের কিছুটা বেকায়দায় ফেললেও ঘণ্টা দুয়েক পরে প্রচ- রৌদ্রের খরতাপ উপেক্ষা করে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। বেলা যত বাড়ে ভোটারদের উপস্থিতিও তত বেড়েছে। তবে ভোটের শেষ সময়ে আবারও শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। এতে ভোটার, প্রার্থী ও ভোটগ্রহণে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব মতে, নগরীতে পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটারদের সংখ্যা বেশি। ফলে ভোট কেন্দ্রগুলোতে নারী ভোটারের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিটি কেন্দ্রে পুলিশ প্রশাসনের কঠোর নজরদারির কারণে ভোট চলাকালে বড় ধরনের কোন দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিংবা সহিংস ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। তবে আচরণবিধি লঙ্ঘন, জাল ভোট দেয়ার চেষ্টাসহ নানা অনিয়মের কারণে দুই এজেন্টসহ ১০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা করা হয়েছে। এদিকে দুই হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত ও মনিরুল হক সাক্কু ভোট দেয়া শেষে ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু বলে জানিয়েছেন। অপর দিকে কেন্দ্রে ভোট দিতে এসে সাংসদ আ.ক.ম বাহা উদ্দিন বাহার সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনী এালাকা ত্যাগের নির্দেশ দিয়ে তাকে দেয়া ইসির চিঠি ছিল এখতিয়ার বহির্ভূত।
এবার নির্বাচনে ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ করা হয়। এটি নতুন পদ্ধতি হওয়ায় কারও কারও কাছে ইভিএমে ভোটদান প্রক্রিয়া ছিল জটিল। তাই ভোটদানে কিছুটা ধীরগতি ছিল। ইভিএমে ভোট দিতে কম বয়সীদের চেয়ে বয়স্কদের একটু সময় বেশি লেগেছে। এছাড়া কেউ কেউ জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে না আনায় এবং কারও কারও আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। তবে শেষদিকে ভোটদানের গতি কিছুটা বাড়ে। বিকেল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গণনার পর ফল ঘোষণা করা হয়। পরে সব কেন্দ্রের ভোটের হিসাব যোগ করে রিটার্নিং কর্মকর্তা মেয়র ও কাউন্সিলর পদে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেন।
সর্বস্তরের মানুষ এবং মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা এবারের নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেন। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। তাই নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। প্রার্থীদের কর্মী সমর্থকরা প্রতিটি অলি-গলি ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। বিশেষ করে বয়স্ক ভোটারদের বিশেষ ব্যবস্থায় কেন্দ্রে এনে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ কারণেই ভোটারদের উপস্থিতি ছিল বেশি।
ভোট শেষে ৩ মেয়র প্রার্থীর প্রতিক্রিয়া : বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নগরীর ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রে ভোট দেন নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত এবং পৌনে ৯টার দিকে একই কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার ভোট দেন। অপরদিকে সকাল সাড়ে ৯টায় নগরীর হোচ্ছাম হায়দার উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন সাবেক মেয়র ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। ওই সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিজয়ের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেন ৩ মেয়র প্রার্থীই। ভোট দিয়ে নৌকার প্রার্থী রিফাত সাংবাদিকদের বলেন, শান্তির কুমিল্লায় শান্তিপূর্ণভাবে ভোট চলছে। ফলাফলে তিনি ২য় হওয়ার সুযোগ নাই, তিনি বিজয়ে শতভাগ আশাবাদী। নির্বাচনে ভোটের পরিবেশ কেমন? এমন প্রশ্নের জবাবে রিফাত বলেন, আমি নালিশ পার্টির নেতা নই, তাই এ নিয়ে কোন নালিশ নাই। একই কেন্দ্রে ভোট দেয়া শেষে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে তিনিই বেশি কাজ করেছেন, তাই ভোটাররাও আসছেন। এতে তিনি বিজয়ে আশাবাদী বলেও জানান। সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্রে আসতে ভোটারদের বাধা দেয়ার খবর আসছে। তারপরও এখন পর্যন্ত ভোটের পরিবেশ যা আছে তা বহাল থাকলে তিনি বিজয়ে শতভাগ আশাবাদী বলেও সাংবাদিকদের জানান।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ১০ জনকে সাজা : নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে ভোটের আগেরদিন থেকেই কঠোর নিরাপত্তাবলয়ে আনা হয় পুরো নির্বাচনী এলাকা। র্যাব, বিজিবি, পুলিশের স্পেশাল টিম, সাধারণ পুলিশ, আর্মড পুলিশ, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার টিম মাঠে নামানো হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে কেন্দ্র দখল কিংবা সহিংস ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘন, জাল ভোট দেয়ার চেষ্টা ও বহিরাগতদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশের দায়ে নৌকা ও ঘোড়া প্রতীকের ২ এজেন্টসহ ১০ জনকে জরিমানা ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। দ-প্রাপ্তরা হলেন শালবন বিহার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে জালভোট দেয়ার দায়ে হাবিবুর রহমানকে ৩ মাসের, আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ের কালিয়াজুড়ি এলাকায় বিল্লাল হোসেন, শরীফ হোসেন, ফরিদা বিদ্যায়তন কেন্দ্র এলাকায় সোহানুর, রেদোয়ান ও মেহেদীকে ৩ মাস করে সাজা দেয়া হয়েছে। প্রার্থীর পক্ষে লিফলেট বিতরণকালে বজ্রপুর এলাকার ২টি কেন্দ্রে হিরণময় ও এনামুল হককে সাতদিন করে সাজা দেয়া হয়। অপরদিকে নগরীর রামকৃষ্ণপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থীর এজেন্ট জয়নাল আবদীন বিধি ভঙ্গ করে কেন্দ্রের ভেতরে-বাইরে যাওয়া-আসা করায় এবং ঘোড়া প্রতীকের এজেন্ট মোবাইল ফোন ব্যবহার করায় তাদের ৫০০ ও ৩০০ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। বিকেলে জেলা পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বুধবার অনুষ্ঠিত কুসিক নির্বাচনে ২৭ ওয়ার্ডের ১০৫ ভোট কেন্দ্রের সবকটিতেই ভোট হয় ইভিএমে। এবারের নির্বাচনে ভোটার ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। এর আগে এ সিটির ২০১৭ সালের নির্বাচনে ভোটার ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬ জন। ওই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৬৯০। এর মধ্যে ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন ধানের শীষের প্রার্থী ও সদ্য সাবেক মেয়র মোঃ মনিরুল হক সাক্কু। ওই নির্বাচনে সাক্কু ১১ হাজার ৮৫ ভোট বেশি পেয়ে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে হারিয়ে ছিলেন।