কামরানের অভাব ‘অনুভব’ করেন নগরবাসী

7

সাইফুর তালুকদার :

বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র, দীর্ঘ দিনের নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, আমৃত্যু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। সেই পৌর সভার ওয়ার্ড কমিশনার থেকে নগর পিতা। জীবনের সর্বশেষ দুই সিটি নির্বাচনে দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও জাতীয় রাজনীতির কারণে নির্বাচনে হেরে গেলেও তিনি নগরবাসীর কাছে ছিলেন ‘মেয়র সাব’। রাজপথ থেকে পাড়া মহল্লা। নগরবাসীর যেকোন দুর্যোগে ছুটে চলতেন পাড়া মহল্লায়। মহামারী করোনায় তাকে কেড়ে নিলেও তিনি কর্মের মাঝে বেছে আছেন নগরবাসীর হৃদয়ে। আজ ১৫ জুন। ২০২০ সালের এই দিনে তিনি চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। আজ তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের মৃত্যুর পর এই দুই বছরে তার অভাব তিলে তিলে অনুভব করছেন সিলেটবাসী। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে নগরীতে ভয়াবহ বন্যার সময় বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নগরবাসীর পাশে ছিলেন না। তিনি অবকাশ যাপনে লন্ডনে ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে নগরবাসী পাশে দাঁড়ান কামরান পুত্র ও নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আরমান আহমদ শিপলু। তাকে পাশে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বনবাসী মানুষ।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরান জীবদ্দশায় বন্যার সময় ছুটে চলতেন বনবাসী মানুষদের পাশে। সর্বশেষ করোনা মহামারীর সময়েও দাঁড়িয়েছিলেন কর্মহীন মানুষদের পাশে। এই করোনার সময় খাদ্য সহায়তা বিতরণ করতে গিয়ে তিনি করোনা আক্রান্ত হন এবং মারা যান।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের দীর্ঘ সময়কার মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। জনপ্রতিনিধি হিসেবেও তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। সিলেটের জনগণ বারবার তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে শহর, নগর ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন দীর্ঘদিন।
সদা হাস্যোজ্জ্বল কামরান মাথায় সাদা টুপি পরতেন, মুখে কালো গোঁফ। চোখে সাদা চশমা পড়া লোকটি ছিলেন সিলেটের মানুষের নয়নমণি। ধীরস্থির প্রকৃতির কামরান সর্বদা মানুষের পাশে ছিলেন। তিনি ছিলেন নগরবাসীর বিপদের আশ্রয়স্থল। এ কারণে ১/১১’র সময় জেলে থেকেও মেয়র নির্বাচিত হন।
সিলেট সিটি করপোরেশন হওয়ার পর থেকেই যে নামটি মেয়র হিসেবে মিশে আছে তা হলো বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। শুরু থেকে দশ বছর সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সুখ দুঃখের সাথী ছিলেন তিনি। এরপর নগর পিতার আসনটি ছাড়তে হলেও নামের পাশে থেকে যায় ‘মেয়র কামরান’।
বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের জন্ম ১৯৫৩ সালে, বাবার লিখে রাখা নোটটি হারিয়ে যাওয়ায় তারিখটা আর জানা হয়নি। এখন বছরের প্রথম দিনই পালন করেন নিজের জন্মদিন। জিন্দাবাজার দুর্গাকুমার পাঠশালায় তার পড়াশোনার প্রথম পাঠ। এরপর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের পাট শেষ করেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান।
সিলেট পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয় ২০০২ সালের ২৮ জুলাই। বিলুপ্ত পৌরসভার চেয়ারম্যান বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে নবগঠিত সিলেট সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র করা হয়। এর পর ২০০৩ সালের ২০ মার্চের নির্বাচনে তিনি আনারস প্রতীক নিয়ে তৎকালীন সরকারি দল বিএনপির প্রার্থী এমএ হককে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সিলেটের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৭৩ সালে সিলেট পৌরসভার সর্বকনিষ্ঠ কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন কামরান।
ওয়ান ইলেভেনের সময় জেলে থেকেও কামরান বিএনপির প্রার্থী বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এম এ হককে ফের পরাজিত করে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয় বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হেরে যান তিনি। এরপর ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনেও আরিফের কাছে হেরে যান কামরান। কিন্তু এরপরও তিনি নগরবাসীর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। এ নগরের মানুষের সুখে-দুঃখে তিনি পাশে ছিলেন।
ষাটের দশকে ছাত্রলীগে যোগ দেওয়া এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ ১৯৭৩ সালে যখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র তখন শুরু হয় দেশের প্রথম পৌর নির্বাচন। এ সময় তিনি সিলেট পৌরসভায় ৬৪৪টি ভোট পেয়ে তোপখানা ওয়ার্ডের কমিশনার নির্বাচিত হন। সে সময় সিলেট শহরে মাত্র ৫টি ওয়ার্ড ছিল। তোপখানা ছিল ৩নং ওয়ার্ডের অধীন। এরপর ১৯৭৭ সালে আবার নির্বাচন হলো। কমিশনার নির্বাচিত হলেন তিনি।
তারপর কিছু দিনের জন্য দেশের বাইরে চলে গেলেন কামরান। দেশে এসে ১৯৮৯ সালে আবারও নির্বাচনে অংশ নিলেন। তখনও তিনি একই ওয়ার্ড থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন। তখন তার প্রতীক ছিল আনারস।
সেই সাফল্যের পথ ধরে এভাবে ১৯৯৫ সালে তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। নিজ দল ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থায় অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি দুইবার মেয়র পদে নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েন। কিন্তু ২০১৩ সালে নিজ দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিরোধী দলের প্রার্থীর কাছে পরাজয় মেনে নিতে হলো সাবেক জনপ্রিয় এই মেয়রকে।
একটানা কয়েক বছর ক্ষমতার ধারাবাহিকতায় আকস্মিক এই হোঁচটকে তবুও ব্যক্তি কামরানের পরাজয় বলে দেখেননি সিলেটের কামরান অনুরাগীরা। তারা মনে করতেন, সিলেটের বৃহত্তর স্বার্থে অতীতের সকল অভিজ্ঞতা নিয়ে নবনির্বাচিত মেয়রকে সহযোগিতা করবেন সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান।
সিলেট সিটি করপোরেশন উন্নীত হওয়ার পর ২০০২ সালের ২৮ জুলাই তিনি ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। ওয়ান ইলেভেনের পর ২০০৭ সালের ৬ এপ্রিল গ্রেফতার হন কামরান। এক মাস কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। এরপর ২৮ মে তিনি আবার গ্রেফতার হন। ওই মাসে কারান্তরীণ হন তিনি।
কারাগারে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট তাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়। নির্বাচনী প্রচারণার জন্য তাকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার কথা শোনা গেলেও পরে তা হয়নি। অবশেষে তার নির্বাচন পরিচালনার জন্য গঠিত হয় ৫০১ সদস্য বিশিষ্ট নাগরিক পরিষদ। কারাগারে থেকে ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হয়ে তিনি আবারও ইতিহাস গড়েন। তখন তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ৮৩ হাজার ৩৩৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। সে সময় মেয়র কামরান সবমিলিয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪৩৬ ভোট পান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আ ফ ম কামাল ৩২ হাজার ৯৭ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ১৯৬৮ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি দীর্ঘদিন সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি পদে ছিলেন।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিলে কামরানকে বাদ দিয়ে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদকে। আর কামরানকে করা হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। এর আগের মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির পাশাপাশি দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন কামরান।
মহানগর আওয়ামী লীগের কর্মসূচী
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) প্রথম মেয়র, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, প্রয়াত জননেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান’র দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- দুপুর সাড়ে ১২টায় মানিক পীর (রাহ.) নাগরিক গোরস্থানে মরহুমের কবর জিয়ারত। মহানগরের প্রতিটি ওয়ার্ড নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে তাদের নিজ নিজ ওয়ার্ডের মসজিদে বাদ জোহর মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন।
উক্ত কর্মসূচিতে মহানগর আওয়ামী লীগ, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে অংশগ্রহণের জন্য আহবান জানিয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন।
পারিবারিক কর্মসূচি
মরহুম বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের ১৫ জুন দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে দুই দিন ব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১৪ জুন অসহায় ও নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ ও রাতে খতমে কোরআন ও দোয়া মাহফিল, ১৫ জুন খতমে কোরআন, মিলাদ মাহফিল, সকাল সাড়ে ১১টায় ছড়ারপাড়স্হ বাড়িতে বিশেষ দোয়া এবং বিভন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় শিরনী বিতরণ।
পরিবারের পক্ষ থেকে বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের জান্নাতুল ফেরদৌস কামনা করে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন এবং কর্মসূচিতে সকলের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ কামনা করেছেন তার পুত্র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আরমান আহমদ শিপলু।